হাসান রূহী
ঢাবি ভিসি প্রফেসর আক্তারুজ্জামান হলেন সেই বিতর্কিত ব্যক্তি যিনি বাংলার নাস্তিককূলের আনুকুল্য পেতে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তকে মুসলমানদের কোরবানী আর হিন্দুদের দেব দেবীর নামে পশু বলী দেয়াকে একাকার করে ফেলেছিলেন। এতে ব্যাপক সমালোচনা ও নিন্দার শিকার হয়েছিল ক্ষমতাসীন সরকার। এমন করিৎকর্মা ব্যক্তিকেই একসময়ে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাতি লাভ করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
গতকাল এই মহান উপাচার্যের একটি বক্তব্যের ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। সেখানে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গর্ব করার মত যে ঐতিহ্য খুঁজে পেয়েছেন তা হলো, মাত্র দশ টাকায় টিএসসির এক কাপ চা, একটি সিঙ্গারা, একটি সমুচা এবং একটা চপ।
উপাচার্য সাহেব বলেছেন, দশ টাকায় এক কাপ চা, একটা সিঙ্গারা, একটা চপ এবং একটি সমুচা পৃথিবীর ইতিহাসে কোথাও পাওয়া যাবে না। বাংলাদেশে এটা পাওয়া যায়। তিনি আরও চমকপ্রদ তথ্য দিয়েছেন। তিনি বলেছেন- এটি যদি কোনো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় জানতে পারে, তাহলে নাকি এটা গিনেস বুকে রেকর্ড হবে!
বেরসিক জনগণ অবশ্য বিষয়টাকে তার মত করে গ্রহণ করতে পারেননি। কারণ তারা মনে করেন- গিনেস বুকে রেকর্ড যদি চা-সিঙ্গারা ১০ টাকায় বিক্রি করে করতে হয় তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন? চায়ের দোকান কিংবা হোটেল দিলেই তো উনি পারতেন! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হয়ে চায়ের দোকান দেয়াও তো কম কথা না! আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এটা জানতে পারলে এটাও তো গিনেস বুকে রেকর্ড হতে পারে!
সে যাইহোক, আহমদ ছফার গাভী বিত্তান্ত যারা পড়েছেন তারা এই ঢাবি উপাচার্যের সাথে মিয়া মুহাম্মদ আবু জুনায়েদের অনেক সাদৃশ্যই খুঁজে পাবেন। কিন্তু আমি সেই তুলনায় যেতে চাচ্ছি না। গাভী বিত্তান্তের মিয়া আবু জুনায়েদ আর জনাব আক্তারুজ্জামানের সাথে যদি তুলনা করতে বলেন তাহলে এতটুকু বলা যায় যে, আবু জুনায়েদ আর যাইহোক আক্তারুজ্জামানের মত বেফাঁস মন্তব্য করতে এতবেশী পটু ছিলেন না।
গত বছরের জুলাই মাসে যখন কোটা সংস্কার আন্দোলনে ঢাবি শিক্ষার্থীরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন, সেই আন্দোলনরত মেধাবী শিক্ষার্থীদের তিনি জঙ্গি বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। ভয়ঙ্কর জঙ্গিগোষ্ঠী বোকো হারাম ও তালেবানের সাথে তুলনা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন- ‘কোটা আন্দোলনকারীরা ফেসবুক লাইভে এসে জঙ্গিদের মতো করে ভিডিওবার্তা দিয়ে কর্মসূচি বা কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করেন। তাদের এমন মনোভাবের সঙ্গে জঙ্গি কর্মকাণ্ডের মিল আছে। তারা কারা?…উদাহরণ হিসেবে বলব- ফেসবুক লাইভে তাদের ভিডিওবার্তার কথা। আমার কয়েকজন সহকর্মী একটি লাইভ ভিডিও দেখিয়েছেন। সেটি দেখলাম। দেখার পর মনে হল- জঙ্গিগোষ্ঠী তালেবান ও বোকো হারাম যেমন ভিডিওবার্তার মাধ্যমে বিভিন্ন উসকানি ও নাশকতার অপপ্রয়াস নেয়, কোটা আন্দোলনকারীদের ভিডিওতেও ঠিক তেমন একটি প্রতিচ্ছবি দেখতে পেয়েছি।’
অবশ্য এই বক্তব্য পরবর্তীতে তিনি অস্বীকার করে দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন।
প্রশ্ন হতে পারে, এমন একজন হালকা ও স্থুল বুদ্ধির লোক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হলেন কিভাবে? কোন বিবেচনায়? সে উত্তর দিতে হলে খুঁজতে হবে তার নিয়োগ প্রক্রিয়া। তাতে হয়তো কেঁচো খুঁড়তে হাতিও বেরিয়ে আসতে পারে। তাই সে পথে আপাতত পা বাড়াচ্ছি না।
শিক্ষা ও গবেষণার মান কোথায় পৌঁছেছে তা নিয়ে কেউ কি চিন্তা করছেন? ব্যাপারটা যেন এমন দাঁড়িয়েছে যে, শিক্ষা-গবেষণা দিয়ে কি হবে? ১০ টাকায় চা-সিঙ্গারা পাচ্ছো তাই নিয়েই গর্ব করো। গিনেস বুকে নাম লেখাও। প্রতিবছর এ দেশ থেকে মেধা পাচার হয়ে যাচ্ছে। উচ্চতর গবেষণা ও ডিগ্রির জন্য হাজার হাজার মেধাবী শিক্ষার্থী বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। কিন্তু কেন এমনটি হচ্ছে তা কি একবারও কি কেউ ভেবে দেখেছেন?
উচ্চতর গবেষণা ও ডিগ্রীর জন্য যখন থাকা খাওয়াসহ সার্বিক সুবিধা নিশ্চিত করে স্কলারশিপ দিয়ে উন্নত দেশগুলো এদেশ থেকে মেধাবীদের দাওয়াত দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, ঠিক সে সময়ে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে উচ্চতর গবেষণা ও ডিগ্রির জন্য শিক্ষার্থী ও গবেষকদের গুনতে হয় হাজার হাজার টাকা। কখনও কখনও এই খরচ লাখের কোটাও ছাড়িয়ে যায়।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্দেশ্যই হলো উচ্চতর গবেষণার পথ উন্মুক্ত করে দেয়া। অথচ বাংলাদেশের চিত্র ভিন্ন। সরকারের পক্ষ থেকে সবসময়ই বলা হয়ে থাকে গবেষণা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হবে। কিন্তু কতটুকু কি বাড়ানো হয়েছে বা হচ্ছে তা যারা উচ্চতর গবেষণার সাথে যুক্ত তারাই ভালো বলতে পারবেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গর্ব করার মত কি কি ঐতিহ্য আছে তা আক্তারুজ্জামান সাহেবের জানা না থাকলেও দেশের মানুষ ভালোই জানেন। আক্তারুজ্জামানের মত লোকেরাই এই বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘ডাকাতদের গ্রাম’ বানিয়েছিলেন। আবার অনেক গুণী মানুষও এখানে ছিলেন যারা এদেশকে সঠিক পথে পরিচালিত করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন।
মাছের পচন নাকি শুরু হয় তার মাথা থেকে। আক্তারুজ্জামানের মত স্থুল বুদ্ধির মানুষেরা যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়, তখন ধরেই নিতে পারেন সেখানে পচন শুরু হয়েছে। ভয়ানকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে যাবতীয় অসুখের জীবানু। হাজারও ঐতিহ্যের মোড়কে ঘেরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবিষ্যত কি তা সময়ই বলে দেবে। তবে আজ আহমদ ছফার অনুসরণে অন্তত এতটুকু বলা যায়, আক্তারুজ্জামানের উপাচার্য পদে নিয়োগপ্রাপ্তির ঘটনাটি প্রমাণ করে দিল আমাদের এই যুগেও আশ্চার্য ঘটনা ঘটে।
আহমদ ছফার অনুসরণে আরও একটি কথা বলা যায়, অতীতের গৌরব গরিমার ভার বইবার ক্ষমতা বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের নেই। তাই হয়তো উপাচার্য সাহেবের এই চা, সিঙ্গারা, সমুচা আর চপের মধ্যেই গৌরবের উপাদান খুঁজে ফেরা!
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট