৭ দফা দাবি ও ১১টি লক্ষ্যের খসড়া প্রায় চূড়ান্ত করেছে ‘বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য’। দাবি সাতটি থাকলেও তাঁদের প্রথম দাবিটিই আসলে মূল দাবি। আর তা হলো—সরকারের পদত্যাগ, নিরপেক্ষ সরকার গঠন ও খালেদা জিয়ার মুক্তি। এ দাবির সঙ্গে বাকি ছয়টি দাবি নিয়ে তাঁরা এগোতে চান।
গতকাল শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর উত্তরায় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রবের বাসায় বৈঠকে বসেন বিএনপি, বিকল্পধারা, জেএসডি ও নাগরিক ঐক্যের নেতারা। এর মধ্যে রাজনৈতিক জোট যুক্তফ্রন্টের তিন দল বিকল্পধারা, জেএসডি ও নাগরিক ঐক্য। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত তাঁদের বৈঠক চলে।
বৈঠকসূত্রে জানা গেছে, খসড়া নিয়ে আলোচনা ছাড়াও বৈঠকে এই বৃহত্তর ঐক্যের একটি সম্ভাব্য নাম নিয়ে আলোচনা হয়। সেখানে ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’ নামটি আলোচনায় আসে। এ ছাড়া বিভাগীয় শহরে সমাবেশ করার মধ্য দিয়ে কর্মসূচি শুরুর বিষয় নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয় বলে জানা গেছে।
বৈঠক শেষে নাগরিক ঐক্যের নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না সাংবাদিকদের বলেন, বৈঠকে অভিন্ন দাবি ও লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। একটি খসড়াও ঠিক করা হয়েছে। আজ শনিবার তা চূড়ান্ত হবে এবং শনিবারই তা প্রকাশ করা হতে পারে। তবে বৈঠকের ব্যাপারে এর বেশি কিছু জানাতে চাননি তিনি।
২০১৮ সালের মাঝামাঝি থেকেই এ ধরনের একটি ঐক্য গড়ে তোলার প্রক্রিয়া শুরু হয়। বৈঠকের পর বৈঠক, নানান হিসাব-নিকাশের পর এখন ঐক্য প্রক্রিয়ায় আসা দলগুলো অভিন্ন দাবি ও লক্ষ্যে এক হয়েছে।
ঐক্য প্রক্রিয়ার একটি সূত্র জানায়, গতকালের ওই বৈঠকের খসড়ায় ৭ দফা দাবি ও ১১টি লক্ষ্য নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এগুলো চূড়ান্ত হলেই দলগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে কর্মসূচিতে যাবে। নির্বাচন কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এই জোটের কাছে প্রথম দাবিটিই তাদের কর্মসূচিতে প্রাধান্য পাবে।
বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের ৭ দফা দাবিগুলো হলো—
১. অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের লক্ষ্যে সরকারের পদত্যাগ, জাতীয় সংসদ বাতিল, আলোচনা করে নিরপেক্ষ সরকার গঠন এবং খালেদা জিয়াসহ সব রাজবন্দীর মুক্তি ও মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার।
২. নির্বাচন কমিশনের পুনর্গঠন ও নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করার নিশ্চয়তা দিতে হবে।
৩. বাক্, ব্যক্তি, সংবাদপত্র, টেলিভিশন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও সব রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে।
৪. কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন, সামাজিক গণমাধ্যমে মতপ্রকাশের অভিযোগে দায়েরকৃত মামলা প্রত্যাহার ও গ্রেপ্তারকৃতদের মুক্তি দিতে হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করতে হবে।
৫. নির্বাচনের ১০ দিন আগে থেকে নির্বাচনের পর সরকার গঠন পর্যন্ত বিচারিক ক্ষমতাসহ সেনাবাহিনী মোতায়েন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়োজিত ও নিয়ন্ত্রণের পূর্ণ ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনকে দিতে হবে।
৬. নির্বাচনে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা নিশ্চিত এবং সম্পূর্ণ নির্বাচন প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণে তাঁদের ওপর কোনো ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ না করা এবং গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা যাবে না।
৭. তফসিল ঘোষণার তারিখ থেকে নির্বাচনের চূড়ান্ত ফল প্রকাশিত না হওয়া পর্যন্ত চলমান সব রাজনৈতিক মামলা স্থগিত রাখা এবং নতুন কোনো মামলা না দেওয়ার নিশ্চয়তা দিতে হবে।
বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে ১১টি লক্ষ্য চূড়ান্ত করা নিয়েও আলোচনা হয়েছে।
লক্ষ্যগুলো হলো—
১. মুক্তিসংগ্রামের চেতনাভিত্তিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক নির্বাহী ক্ষমতা অবসানের জন্য সংসদে, সরকারে, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনা এবং প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণ, ন্যায়পাল নিয়োগ করা।
২. সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদে নির্দলীয়, নিরপেক্ষ ও সৎ–যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগের জন্য সাংবিধানিক কমিশন গঠন করা।
৩. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও ক্ষমতা নিশ্চিত করা।
৪. দুর্নীতি দমন কমিশনকে যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কার নিশ্চিত করা হবে। দুর্নীতিমুক্ত, দক্ষ ও জবাবদিহিমূলক প্রশাসন গড়ে তুলে সুশাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে দুর্নীতি কঠোর হাতে দমন ও দুর্নীতির দায়ে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনা।
৫. বিনিয়োগ বৃদ্ধির পরিবেশ সৃষ্টি, বেকারত্বের অবসান ও শিক্ষিত যুবসমাজের সৃজনশীলতা ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধাকে একমাত্র যোগ্যতা হিসেবে বিবেচনা করা।
৬. জনগণের মৌলিক মানবাধিকার, নারীর ক্ষমতায়ন, কৃষক-শ্রমিক ও দরিদ্র মানুষের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সরকারি অর্থায়নে সুনিশ্চিত করা।
৭. জনপ্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, স্থানীয় সরকারসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে দুর্নীতি ও দলীয়করণ থেকে মুক্ত করা।
৮. বাংলাদেশ ব্যাংকসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানে শৃঙ্খলা আনা, সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার, সুষম বণ্টন ও জনকল্যাণমুখী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করা।
৯. জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে জাতীয় ঐকমত্য গঠন এবং প্রতিশোধ, প্রতিহিংসা ও নেতিবাচক রাজনীতির বিপরীতে ইতিবাচক সৃজনশীল এবং কার্যকর ভারসাম্যের রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করা।
১০. ‘সকল দেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়’—এই নীতির আলোকে পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করা।
১১. প্রতিরক্ষা বাহিনীকে আধুনিক প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি ও সমরসম্ভারে সুসজ্জিত, সুসংগঠিত ও যুগোপযোগী করা।
গতকালের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও মওদুদ আহমদ, গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি সুব্রত চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসিন মন্টু, সুলতান মোহাম্মদ মনসুর, বিকল্পধারার যুগ্ম মহাসচিব মাহী বি. চৌধুরী, কেন্দ্রীয় নেতা ওমর ফারুক, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, শহীদুল্লাহ কায়সার, জাহিদুর রহমান, জেএসডির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা জাফরুল্লাহ চৌধুরী।
প্রসঙ্গত, গত বৃহস্পতিবার রাত নয়টায় এই বৈঠকটি হওয়ার কথা থাকলেও পরে তা বাতিল করা হয়। এর আগে ৭ ও ৮ অক্টোবর এই দলগুলোর নেতারা খন্দকার মোশাররফ ও আ স ম রবের বাসায় দুটি বৈঠক করেন। গতকালের আগের বৈঠকগুলোতে যুক্তফ্রন্ট ও ঐক্য প্রক্রিয়া ঘোষিত ৯ দফা লক্ষ্য এবং বিএনপির ১২ দফা লক্ষ্যের মধ্যে মৌলিক ব্যবধান কী, তা নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ হয়। পরে ৯ ও ১২ দফার লক্ষ্য সমন্বয় করতে জেএসডির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন ও গণফোরামের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ হ ম শফিউল্লাহকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তখন বলা হয়, এর খসড়া তৈরি করে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার আহ্বায়ক ড. কামাল হোসেনকে দেওয়া হবে। গতকাল শুক্রবারের বৈঠকে সেই খসড়া নিয়েই আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে। যদিও শুক্রবারের বৈঠকে যুক্তফ্রন্টের চেয়ারম্যান ও জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার আহ্বায়ক ড. কামাল হোসেন উপস্থিত ছিলেন না।
সূত্র: প্রথম আলো