মুসাফির রাফি
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক ও সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাহেব সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে অভিযোগ করে বলেছেন যে, একটিমহল উঠে পড়ে লেগেছে যাতে কোন না কোনভাবে ছাত্রলীগের ইমেজ খারাপ করা যায়, ছাত্রলীগকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে দেখানো যায়। জানিনা এর প্রতিক্রিয়া হিসেবেই কিনা, ছাত্রলীগের নব গঠিত কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যরা খুব উঠে পড়ে লেগেছেন যাতে কোন না কোনভাবে তাদের ইমেজটি একটু ভাল করা যায়।
রাস্তায় বা দেশে কোন অসহায় মানুষকে তাদের চোখে পড়েনা। নির্যাতিত বা অপহৃত মানুষের চোখের পানি তাদেরকে স্পর্শ করেনা। তারা বেছে নিয়েছেন দুই একজন অভাবী রিকশা চালককে। তাদের সাথে একটি সেলফি তুলে কিছু ভাল কথা দিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস ছেড়ে দিচ্ছেন। যাতে মানুষ ছাত্রলীগের নেতাদেরকে মানববন্ধু হিসেবে গন্য করে।
আমার কাছে ছাত্রলীগের এই স্ট্যান্টবাজিকে রীতিমতো কমেডি অব দ্য ইয়ার বলেই মনে হয়েছে। মানুষ এতটা বোকা হয় আমার জানা ছিল না। এই সোশ্যাল মিডিয়ার জমানায় যেখানে জনকন্ঠের মত একটি পুরনো পত্রিকা ৬ বছর আগের একটি মিথ্যা ছবি নতুন করে ছাপাতে গিয়ে ধরা খেয়ে পরের দিনে পাঠকের কাছে কর্তৃপক্ষকে মাফ চাইতে হয়, সেখানে ছাত্রলীগের গত ১০ বছরের অকাম কুকামের ছবি আর ভিডিও তো ঘরে ঘরে মানুষের কাছে আছে, সেই সব বর্বরতম ইতিহাস মানুষ এরকম মিথ্যা সেলফি দেখে এক নিমিষে ভুলে যাবে- এটা বোধ হয় পাগলেও বিশ্বাস করবে না।
বিগত ১০ বছরে আওয়ামী লীগের সীমাহীন দুর্নীতির বাইরে সবচেয়ে বেশী যে ইস্যুতে সরকারকে বিব্রত হতে হয়েছে সেটা হলো ছাত্রলীগ। এটাভুলে গেলে চলবেনা যে স্বয়ং শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের কার্যক্রমে অতিষ্ঠ হয়ে ছাত্রলীগের কার্যকরী সভাপতির পদ থেকে সরে যেতে চেয়েছিলেন একাধিকবার। ছাত্রলীগের বিগত এক যুগের ইতিহাস হত্যার ইতিহাস। এরও আগে, ৯৬-২০০০ সালে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায়, তখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ নেতা মানিক ধর্ষনের সেঞ্চুরির যে রেকর্ড করেছিলো, এবার ক্ষমতায় এসে ছাত্রলীগ যেন সেই ধর্ষনগাঁথাকে গোটারাষ্ট্রে ছড়িয়ে দেয়ার কাজে লিপ্ত হয়েছে। ভার্সিটিগুলোর ক্যাম্পাস নয়, বরং রাজপথগুলোতে এবার তারা প্রকাশ্যে নারীদের শ্নীলতাহানি করেছে। ছাত্রলীগ কোন ছবি দিয়ে সেই দুর্নাম কাটাবে?
ছাত্রলীগের সন্ত্রাস আর হানাহানির মাঝে পড়ে বুলেটবিদ্ধ হয়েছে গর্ভবর্তী মা আর তার পেটের ভেতরে থাকা সন্তান। ছাত্রলীগের দুইপক্ষের গোলাগুলির মাঝে পড়ে জীবন হারাতে হয়েছে মেধাবী ছাত্রদের। বাংলাদেশের এমন কোন বিশ্ববিদ্যালয় নেই, যা ছাত্রলীগের সন্ত্রাসের কারণে দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকেনি। অবাক লাগে, যেখানে বিরোধী দলই নেই, যেখানে ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্রদল বা ছাত্রশিবির প্রকাশ্যে কাজ করতে পারে না, সেখানে ছাত্রলীগ নিজেরা নিজেরাই টেন্ডারবাজি আর হানাহানি করে ক্যাম্পাসে রক্তপাত ঘটাচ্ছে দিনের পর দিন। ছাত্রলীগ নেতারা কোন সেলফি দিয়ে সেই বাস্তবতাকে অস্বীকার করবেন?
শিক্ষক লাঞ্ছনার নতুন রেকর্ড করেছে ছাত্রলীগ। অধ্যক্ষের রুমে তার চেয়ারে জনৈক ছাত্রলীগ নেতা বসে শিক্ষককে হেনস্তা করছেন- সেই ছবি ভাইরাল হয়েছে বহু আগেই। এখন নতুন করে মানবতাবাদী ছবি ভাইরাল করে সেই কুখ্যাত ছাত্রলীগ কি তার ইমেজ ফেরাতে পারবে?
মেগা প্রোজেক্টের সব টেন্ডার আর ঠিকাদারি ছাত্রলীগ নেতাদের হাতে। তারা নিজেদের প্রয়োজনে গণজাগরনে গিয়েছে আবার যখন চেয়েছে তখন নিজেরাই গণজাগরন মঞ্চকে বিতর্কিত করেছে। আঘাত করে রক্তাক্ত করেছে তথাকথিত সেই প্রগতিশীলদের। এখন ভাল ছবি দিলেই কি সেই প্রগতিশীলেরা ছাত্রলীগকে ক্ষমা করে দেবেন? মাদ্রাসার ছাত্রছাত্রীদেরকে পশুর মত পিটিয়েছে ছাত্রলীগ। গ্রামের মাদ্রাসার সুপারকে মেরে পুকুরে ফেলে রেখেছে ছাত্রলীগ। মাদ্রাসার হুজুরের মাথায় মানুষের মল ঢেলে দিয়েছে ছাত্রলীগ। বোরখা পড়া নারীদেরকে শারীরিকভাবে হেনস্তা করেছে ছাত্রলীগ। সারাজীবন শিবিরকে প্রবঞ্চনা করে রগকাটা বলেগালি দিলেও এবার ক্ষমতায় এসে রগকাটার নতুন সিলসিলা চালু করেছে ছাত্রলীগ নিজেরাই।
মানুষ খুন, ইভটিজিং, ধর্ষন, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, শিক্ষক-ছাত্রকে অপমান, ধর্মীয় নেতাদেরকে অসম্মান, সন্ত্রাস, রাহাজানি, মাদক খোর, অন্যের বউ ভাগিয়ে নিয়ে যাওয়া, হাতেনাতে পরনারীর সাথে ধরা পড়া, হিন্দুদের সম্পত্তি দখল, মন্দির ভাংচুর থেকে শুরু করে এমন কোন অন্যায় অপকর্ম নেই যার সাথে ছাত্রলীগের নাম পাওয়া যায়নি। এখন দু-তিনটা লোক দেখানো ছবি দিলেই কি জনগন সব ভুলে যাবে?
সর্বশেষ ছাত্র আন্দোলন এবং তার আগের কোটা আন্দোলনে ছাত্রলীগ যেভাবে ন্যাক্কারজনকভাবে সাধারন ছাত্র এমনকি ছাত্রীদের উপর হামলা করেছে তা বাংলাদেশের ইতিহাসে কখনো দেখা যায়নি। ছাত্রলীগের মহিলা নেত্রীরা হলগুলোতে কোটা আন্দোলনের নেত্রীদেরকে রাতের আঁধারে যেভাবে নির্যাতন করেছে তা আইয়ামে জাহেলিয়াতকেও হার মানায়। এবারের নিরাপদ সড়কের দাবীতে স্কুলের ছেলে মেয়েরা যে আন্দোলন করলো, তার উপরও ভয়াবহ হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগ।
একবিংশ শতাব্দীতে এসে আবার নতুন করে রামদা আর কিরিচের ব্যবহার শুরু করেছে তারা। শত শত ছাত্রের শরীরের কোপের চিহ্ন, শরীরে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ। বাচ্চা বাচ্চা মেয়েরাও রেহাই পায়নি তাদের নির্যাতন থেকে। অভিভাবক, সুশীল সমাজ যারাই এই ছাত্রদের পাশে দাঁড়িয়েছে তাদের উপরই হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগের পিশাচ ক্যাডাররা। এখন অভিনয় করে দু একটা ছবি তুলেই কি ছাত্রলীগ তার ক্ষতিপূরন দিতে পারবে?
ছাত্রলীগের হামলা থেকে বাঁচেনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত কিংবা সুজনের সম্পাদক। ফ্যাসিজম কত প্রকার ও কি কি তা বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছে এই আওয়ামীলীগ। তাই তারা মানুষের লাশের সাথেও শত্রুতা করেছে। অনেক বুদ্ধিজীবির মৃতদেহকে তারা জনগনের সামনে নিতে দেয়নি, কেননা তারা জীবিত অবস্থায় আওয়ামীলীগের সমালোচনা করেছিলেন। ছাত্রলীগের সোনার ছেলেরা আলজাজিরাতে আন্দোলনরত ছাত্রদের পক্ষে সাক্ষাতকার দেয়ায় তাদের ঘরানার ফটোগ্রাফার শহীদুল আলমকেও আঘাত হানতে ছাড়েনি। ছাত্রলীগ একটা বিষধর সাপ। ফ্যাসিজমের নিকৃষ্টতম ডান হাত। যা কাউকে মাথা উুঁচ করে কথা বলতে দেবে না, ছোবল মেরে থামিয়ে দেবে।
ছাত্রলীগ এখন আর ছাত্রদের সংগঠন নয়, মেধাবীদের তো নয়ই। ছাত্রলীগের সদ্য বিদায়ী সভাপতি সোহাগ তার জ্বলজ্যান্ত উদাহরন। তার আজগুবি, জগাখিচুড়ি মার্কা হাস্যকর কথায় সাধারন মানুষ অট্টহাসি দেয়, আর তাদের ঘরানার উপস্থাপক বা উপস্থাপিকারাই বিস্ময়ে বোবা হয়ে যান। হয়তো তারাও সোহাগকে নিয়ে ভাবেন, এত বোকার মত করে মিথ্যা কথাএকজন মানুষ কিভাবে বলতে পারে। আমার মনে হয় বাংলাসিনেমায় মরহুম দিলদারের মৃত্যুর পর কমেডি চরিত্রায়নের ক্ষেত্রে যে ভীষনরকম খরা চলছে সোহাগকে দিয়ে তা অনেকটাই মেটানো সম্ভব।
সার কথা হলো, ছাত্রলীগের নতুন কমিটির নেতাদের সেলফি ছবি তোলার মত ফানি এবং সস্তা লোক দেখানো কৌশল থেকে বেরিয়ে আসা উচিত। মানুষ এত বোকা নয়- এটা তারা এখনো না বুঝলে আর কবে বুঝবে। মানবিকতা এভাবে আসেনা, আসে মন থেকে, আর্দশ থেকে, চেতনা থেকে, যেটা কোনদিনই ছাত্রলীগের ছিলনা, ভবিষ্যতেও হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। ছাত্রলীগের ইমেজ জনগনের কাছে এতটাই নেতিবাচক হয়ে গিয়েছে যে তারা যতই সাধনা করুক, স্ট্যান্টবাজি বা লোক দেখানো মানবিকতা দেখাক, জনগনের হৃদয়ে আর কোনদিনই তাদের ঠাঁই হবে না।