অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
১৯৯৯ সালের ৩০ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত হয়েছিল বিএনপি-জামায়াত-জাতীয় পার্টি ও ইসলামী ঐক্যজোটের সমন্বয়ে চারদলীয় জোট। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের কিছু অগণতান্ত্রিক, দেশ ও ইসলাম বিরোধী কর্মকা-ের শক্ত প্রতিবাদ করার লক্ষ্যে মূলত গঠিত হয় বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এই জোট গঠনের চিন্তা আসছিল জামায়াতের তৎকালীন আমির অধ্যাপক গোলাম আযমের মাথা থেকে। অধ্যাপক গোলাম আযম বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে বলেছিলেন পৃথক আন্দোলন ও নির্বাচন করে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে হঠানো যাবে না। জোটবদ্ধভাবে আন্দোলন ও নির্বাচন করতে পারলেই আওয়ামী লীগের পতন হবে। এছাড়া সম্ভব নয়। গোলাম আযমের এই পরামর্শেই খালেদা জিয়া আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ আন্দোলনে আগ্রহী হন।
কারণ হিসেবে অ্যানালাইসিস বিডির অনুসন্ধানে জানা গেছে, ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনের পর কোনো স্বার্থ ছাড়াই সরকার গঠনে জামায়াত বিএনপিকে সমর্থন দিয়েছিল। আর ৯৬ সালের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ সরকার গঠনে জামায়াতের সমর্থন চেয়েছিল। কিন্তু, জামায়াত আওয়ামী লীগকে সমর্থন দেয়নি। এসব কারণে জামায়াতের উপর খালেদা জিয়ার আস্থা ছিল যে জামায়াত নেতারা বিশ্বাস ঘাতকতা করবে না।
পরে জোটবদ্ধ আন্দোলন ও পরবর্তীতে ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট বিপুল আসনে জয় লাভ করে।
এরপর ২০০৯ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে ফখরুদ্দিন-মঈনুদ্দিনের সহযোগিতায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেই বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট ভাঙার কাজে হাত দেয়। বিশেষ করে জামায়াতকে বিএনপি থেকে আলাদা করার জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
বিএনপি থেকে জামায়াতকে আলাদা করতে সরকার প্রথমেই নিপীড়ন চালায় জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীদের ওপর। এমনকি বিএনপিকে না ছাড়ার কারণেই যুদ্ধাপরাধের মামলা দিয়ে শীর্ষ নেতাদেরকে ফাঁসি দিয়েছে এবং মামলা দিয়ে জামায়াত শিবিরের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে নির্যাতন করেছে। সেই নির্যাতন এখনও অব্যাহত আছে।
অপরদিকে বিএনপির ভেতর থেকেও একটি অংশকে সরকার কাজে লাগিয়েছে। বিএনপি নেতা জেনারেল মাহবুবু রহমান, ড. আব্দুল মঈন খান, শামসুজ্জামান দুদু, জয়নাল আবদীন ফারুক, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানীসহ কয়েকজন নেতা প্রকাশ্যেই জামায়াতের বিরুদ্ধে মিডিয়ায় কথা বলেছেন। জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীরা না গেলে সভা-সমাবেশ শান্তিপূর্ণভাবে হয় এমন কথাও বিভিন্ন টিভি চ্যানেলকে বলেছেন তারা।
তারপর ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের পরও ২০১৫ সালের টানা অবরোধ আন্দোলনের পর বিএনপির ওপর চাপ সৃষ্টি হতে থাকে জামায়াতকে বাদ দেয়ার জন্য। বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবী প্রফেসর এমাজউদ্দিন আহমদ ও ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী প্রকাশ্যেই বিএনপিকে বলে আসছেন জোট থেকে জামায়াতকে বাদ দিতে।
তবে, খালেদা জিয়া তাদের এসব বক্তব্যকে মোটেও পাত্তা দেন নি। খালেদা জিয়ার কাছে তথ্য আছে যে, বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করতেই সরকার জামায়াতকে জোট থেকে আলাদা করার ষড়যন্ত্র করছে। বিএনপির সঙ্গে থাকার কারণেই সরকার জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করেছে। আর ২০ দলীয় জোট থেকে জামায়াত বেরিয়ে গেলে বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়াও কঠিন হয়ে যাবে।
এদিকে, বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন জোট ভাঙতে না পেরে সরকার এখন বিদেশিদের দ্বারস্থ হয়েছে। সম্প্রতি গণমাধ্যমকে দেয়া ঢাকায় নিযুক্ত জার্মান রাষ্ট্রদূত থমাজ প্রিনজ ও নরওয়ের রাষ্ট্রদূতের একটি সাক্ষাৎকারে সেটার প্রমাণ মিলেছে।
বুধবার বেসরকারি টিভি চ্যানেল২৪কে দেয়া সাক্ষাৎকারে জার্মান রাষ্ট্রদূত ডক্টর থমাজ প্রিন্জ বিএনপিকে পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, রাজনৈতিক দল হিসেবে ওই নির্বাচনে অংশ না নিয়ে গুরুতর ভুল করেছে বিএনপি। তার মতে, ভুলের এখানেই শেষ নয়। জামায়াতের মতো সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলকে জোটে রেখে, নিজেদের রাজনৈতিক মতাদর্শকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে বিএনপি। আধুনিক রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতার স্থান নেই। তাই বিএনপির উচিত, বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা।
দুই রাষ্ট্রদূত বিএনপির অভন্তরীণ বিষয়েও হস্তক্ষেপ করেছেন। বলেছেন, বিএনপি এখন কার্যত দুভাগে বিভক্ত। নেতাদের একে অপরের প্রতি আস্থা নেই। দলের একটি অংশ খালেদা জিয়াকে নিয়ে নির্বাচনে যেতে চাইলেও, অন্য অংশের চাওয়া তাকে বাদ দিয়েই নির্বাচন।
জার্মান রাষ্ট্রদূতের এ বক্তব্য নিয়ে এখন রাজনৈতিক অঙ্গনে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। অনেকেই মনে করছেন জার্মান রাষ্ট্রদূত থমাজ প্রিনজ সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নে মাঠে নেমেছেন।
বিশিষ্টজনেরা বলছেন, সরকারের মন্ত্রী-এমপি ও আওয়ামী লীগপন্থী বুদ্ধিজীবীদের বক্তব্য ও জার্মান রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। বিগত ৯ বছর ধরেই সরকার বিএনপি থেকে জামায়াতকে আলাদা করতে বিভিন্নভাবে চেষ্টা করে আসছে। কোনো কাজই হচ্ছে না। জার্মান রাষ্ট্রদূত এখন সরকারের সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মাঠে নেমেছেন। তার বক্তব্যে মনে হচ্ছে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনতে তিনি কাজ করছেন।
কেউ কেউ বলছেন, একটি দলের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা কোনো কূটনৈতিক শিষ্টাচারের মধ্যে পড়ে না। তার বক্তব্য শুনে মনে হচ্ছে দলের ভেতর যারা খালেদা জিয়াকে ছাড়া নির্বাচনে যেতে চান তাদের সঙ্গে রাষ্ট্রদূতের সম্পর্ক আছে। তারাই মনে হয় দলের মধ্যে ভাঙন ধরানোর চেষ্টা করছেন।