পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে প্রশ্নফাঁস থেমে নেই। একের পর এক পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁস চলছেই। প্রাথমিক সমাপনী থেকে শুরু করে প্রতিটি পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁস গোটা জাতির জন্য মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। চলমান এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় একের পর এক প্রশ্নফাঁস চলছেই। গতকাল এসএসসির আটটি সাধারণ শিক্ষাবোর্ডে অভিন্ন প্রশ্নপত্রে বাংলা দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
এ পরীক্ষার প্রায় ১ ঘণ্টা আগে (খ সেট) নৈর্ব্যক্তিক ৩০টি প্রশ্নই ফাঁস হয়ে যায়। মুহূর্তেই তা ভাইরাল হয়ে যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। শিক্ষাসংশ্লিষ্টসহ অভিভাবকরাও বলছেন, এ প্রশ্নফাঁসের শেষ কোথায়? শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদও বলছেন, প্রশ্নফাঁস বন্ধে তারা খুবই ‘ডেসপারেট’। সব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে প্রশ্নফাঁস ঠেকাতে। কিন্তু এরপরও ঠেকানো যায়নি প্রশ্নফাঁস। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. ছিদ্দিকুর রহমান বলেন, ফাঁস হওয়া প্রশ্নে যদি পরীক্ষা নেওয়া হয় তবে সেটিকে পরীক্ষা বলা যায় না। এটি জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক।
প্রশ্নফাঁসের ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি প্রবণতা তৈরি হচ্ছে যে, সারা বছর না পড়ে ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়ে তারা ভালো ফল করবে। এতে হয়তো ছাত্র-ছাত্রীরা জিপিএ ৫ পাবে কিন্তু তারা দেশকে একদিন পঙ্গু করে দেবে। এরা কর্মজীবনে গিয়ে জাতিকে কিছু দিতে পারবে না। এ ক্ষতির প্রভাব জাতির ওপর সুদূরপ্রসারী। প্রশ্নফাঁসকারীরা আটক না হওয়ার ব্যাপারে এ শিক্ষাবিদ বলেন, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কেউ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছু রটালে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে আটক করা হচ্ছে কিন্তু যারা প্রশ্ন ছড়িয়ে দিচ্ছে তাদের আটক করা হচ্ছে না। ড. ছিদ্দিকুর রহমান বলেন, আমরা মনে করি প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে জড়িতদের ধরতে প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছা রয়েছে। কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয় কেন জড়িতদের আটক করতে পারছে না? এসএসসি পরীক্ষাকে ঘিরে ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরীক্ষার আগেই প্রশ্ন দেওয়ার প্রচারণা চালাচ্ছে ফাঁসকারী চক্র। এক্ষেত্রে ব্যবহার করা হচ্ছে মোবাইল নম্বরও। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, প্রশ্নফাঁসের কারণে এসব পরীক্ষার ওপর কারও আস্থা থাকছে না।
বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার থেকে পরীক্ষাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেখানে শিক্ষামন্ত্রী নিজেই বলছেন, এখানে দুর্নীতি রয়েছে, তাহলে আমরা কার ওপর নির্ভর করব? দুর্নীতিবাজরা এখানে পার পেয়ে যাচ্ছে। প্রশ্নফাঁসের ক্ষেত্রে তারা একের পর এক কৌশল পাল্টাচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার পরীক্ষার প্রায় ৪০ মিনিট আগেই ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয় এসএসসির বাংলা প্রথম পত্রের এমসিকিউ ৩০টি প্রশ্ন। গতকালও একইভাবে বাংলা দ্বিতীয় পত্রের এমসিকিউ ৩০টি প্রশ্ন ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এক্ষেত্রে ‘SSC Exam question 2018’ ফেসবুক পেজ, ‘PSC • JSC • SSC • HSC Exam Helping Center’ পাবলিক গ্রুপসহ বিভিন্ন প্লাটফর্ম ব্যবহার করছে প্রশ্নফাঁস চক্র। এ ছাড়া 01640734378, 01764439100, 01640570751 সহ বিভিন্ন মোবাইল নম্বরও ব্যবহার করছে তারা। সচেতন মহল বলছে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে সহজেই এ চক্রের সদস্যদের আটক করা সম্ভব।
প্রশ্ন দেওয়ার কথা বলে মাত্র ২০০ থেকে শুরু করে ২০০০ টাকা পর্যন্ত প্রতি শিক্ষার্থীর কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে এই চক্রের সদস্যরা। অভিভাবকরা বলছেন, কেউ প্রশ্নফাঁস করে পরে সেটি বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়াচ্ছে। তাই আগে প্রশ্নফাঁসের উৎস খুঁজে বের করে সেটি নির্মূল করতে হবে। এ ছাড়া রাঘব-বোয়ালরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই রয়ে যাবে। ফেসবুকের কয়েকটি গ্রুপ ও পেজে একাধিক আইডি থেকে প্রশ্নফাঁসের ‘প্রমাণ’ দিয়ে তারা বলছেন প্রতিটি পরীক্ষার প্রশ্নই তারা পরীক্ষার আগে ছাত্র-ছাত্রীদের দেবেন। আগামীকাল এসএসসিতে ইংরেজি প্রথম পত্রের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু প্রশ্নফাঁস চক্রের সদস্যরা গতকাল থেকেই সামাজিক বিভিন্ন যোগাযোগ মাধ্যমে ইংরেজি প্রশ্নফাঁস করে দেওয়ার ‘প্রচারণা’ অব্যাহত রেখেছেন। বলা হচ্ছে তারা প্রতিটি প্রশ্নই নিশ্চিতভাবে ফাঁস করবে। প্রশ্ন পেতে ইনবক্সে যোগাযোগ করতেও বলা হচ্ছে আগ্রহীদের।
বাংলা প্রথম পত্র পরীক্ষার এমসিকিউ প্রশ্ন পরীক্ষার আগেই ফাঁস হলেও সেদিন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ জানিয়েছিলেন, ফাঁস হওয়া প্রশ্নের সঙ্গে মূল প্রশ্নের কোনো মিল নেই! পরীক্ষা শুরুর আগের দিন সংবাদ সম্মেলন করে শিক্ষামন্ত্রী নাহিদ বলেছিলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁস হলে সেটি বাতিল করে দেওয়া হবে। কিন্তু প্রশ্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফাঁস হওয়ার পর শিক্ষামন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কোনো বক্তব্য আসেনি। গতকালও ফোন ধরেননি তিনি।
সূত্র: পূর্বপশ্চিমবিডি