বন্যা, চালের মূল্যবৃদ্ধি, ষোড়শ সংশোধনীর রায়ের পর সৃষ্ট সংকট, রোহিঙ্গা সমস্যাসহ একের পর এক ঘটনায় কয়েক মাস ধরে অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে রয়েছে সরকার। এই পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে চেষ্টা করছে সরকার ও আওয়ামী লীগ।
সরকার ও দলের উচ্চপর্যায়ের একাধিক সূত্র জানায়, এরই মধ্যে নির্বাচনের বছর সামনে রেখে নতুন করে রাজনৈতিক সংকট তৈরি হতে পারে বলে তারা আশঙ্কা করছে। বিশেষ করে নির্বাচনকালীন সরকার ও নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো কী করে, সে বিষয়ে সতর্ক রয়েছে সরকার। আগামী বছরের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের চতুর্থ বর্ষপূর্তির সময়টায় বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করা হবে বলেও জানা গেছে।
আওয়ামী লীগের সূত্রগুলো বলছে, পরপর নানা পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়ায় আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচন সামনে রেখে আগাম যেসব পরিকল্পনা-প্রস্তুতি নিয়ে কার্যক্রম শুরু করেছিল, তা বিঘ্নিত হয়েছে। এর মধ্যে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার লম্বা সময় লন্ডনে থাকাকেও সন্দেহের চোখে দেখছে সরকার।
হাওরাঞ্চলে বন্যা, ফসলহানি, এরপর দেশের উত্তরাঞ্চলে বন্যা, চালের মূল্যবৃদ্ধিসহ নানা সংকট গত মে মাস থেকেই শুরু হয়। ১ আগস্ট ষোড়শ সংশোধনী মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর বেশ অস্বস্তিতে পড়ে সরকার। ওই সময় এ নিয়ে সৃষ্ট বিতর্কে নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ, জাতীয় সংসদ ও রাজনৈতিক দলও জড়িয়ে পড়ে। সরকার ও রাজনীতিতে একটা গুমোট ভাব সৃষ্টি হয়। এরপর প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার ছুটি নিয়ে বিদেশ যাওয়ার ঘটনায় জনমনে সন্দেহ ও অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে। অবশ্য ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকেরা মনে করছেন, প্রধান বিচারপতির বিদেশ যাওয়ার মধ্য দিয়ে সৃষ্ট পরিস্থিতির আপাত-সমাধান হয়েছে।
২৫ আগস্ট মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের আসা শুরু হলে নতুন পরিস্থিতিতে পড়ে সরকার। তবে রোহিঙ্গা সমস্যা দীর্ঘায়িত হবে বলে মনে করা হচ্ছে। এর ফলে সামাজিক ও অর্থনৈতিক চাপ বৃদ্ধির পাশাপাশি নিরাপত্তার ঝুঁকির আশঙ্কাও রয়েছে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খান প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ নিয়ে ৪৫ বছর ধরেই চক্রান্ত চলেছে। এখনো চলছে। চক্রান্ত এমন জিনিস, একটা শেষ হলে আরেকটা আসে। কিন্তু শেখ হাসিনার নেতৃত্ব ও একতাবদ্ধতার কারণে কোনো চক্রান্তই সফল হবে না। এরপরও সতর্ক থাকতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগদান, যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসাসহ প্রায় তিন সপ্তাহের সফর শেষে ৭ অক্টোবর দেশে ফিরলেও চিকিৎসকের পরামর্শে বিশ্রাম নিচ্ছেন। সরকারি গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছাড়া খুব বেশি কর্মসূচিতে এখনো যোগ দিচ্ছেন না। দলের নেতারা বলছেন, বিশ্রামের সময়টাতে জটিল পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য প্রধানমন্ত্রী ঠান্ডা মাথায় কাজ করছেন।
আওয়ামী লীগের একজন দায়িত্বশীল নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচনকালীন সরকার ও নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েনের বিষয়টি বিএনপি নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপে তুলেছে। যদিও এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের কিছু করার নেই। বিএনপি এই দাবিগুলোর পক্ষে জনমত সৃষ্টির জন্য মাঠে তৎপরতা চালাতে পারে। এ ক্ষেত্রে আগামী ৫ জানুয়ারি ঘিরে তাদের পরিকল্পনা রয়েছে বলে সরকারের কাছে তথ্য আছে। তবে ২০১৫ সালের মতো সহিংস আন্দোলন করবে, নাকি দাবি দুটি জনপ্রিয় আন্দোলনে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করবে, তা নিয়ে ভাবছে আওয়ামী লীগ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘৫ জানুয়ারিকে ঘিরে বিএনপির কোনো কর্মসূচি আছে বলে আমার জানা নেই। তবে এটা তো ঘোষিতই আছে যে নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের রূপরেখা দেওয়ার পর আমরা জনমত সৃষ্টির জন্য কর্মসূচি দেব।’
আওয়ামী লীগের আরেকটি সূত্র জানায়, বিএনপি ও খালেদা জিয়াকে নিয়ে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে কিছুটা দোটানা আছে। তাঁর দীর্ঘদিন লন্ডনে অবস্থানকেও সন্দেহের চোখে দেখছে আওয়ামী লীগ। এখন খালেদা জিয়ার মামলাগুলো দ্রুততার সঙ্গে শেষ করা হবে, নাকি ধীরে চলো নীতি নেবে, তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব আছে। আর বিএনপিকে স্বাভাবিক রাজনীতি করার সুযোগ দেওয়া হবে কি হবে না, এটা নিয়েও দোটানা আছে। খালেদা জিয়া লন্ডন থেকে দেশে ফেরার পর তাঁর অভ্যর্থনায় বিমানবন্দর এলাকায় বিএনপির নেতা-কর্মীদের জমায়েত হওয়ার সুযোগ দিয়ে সরকার পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করেছে। ওই দিন বিমানবন্দর থেকে গুলশানের পথে বিপুল মানুষের উপস্থিতি নিয়ে আওয়ামী লীগের মধ্যেও আলোচনা শুরু হয়েছে। এ অবস্থায় স্বাভাবিক রাজনীতি করার সুযোগ দিলে বিএনপি নির্বাচনকালীন সরকার ও নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েনের দাবি জোরালো করার সুযোগ পাবে বলে মনে করছেন সরকারি দলের নেতারা। এখন বিএনপির পরবর্তী কার্যক্রমের ওপর নজর রাখা হচ্ছে বলে সরকারি সূত্রগুলো জানিয়েছে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম প্রথম আলোকে বলেন, সরকারে থাকলে রাজনৈতিকসহ নানা চ্যালেঞ্জ আসবে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধান, গণতন্ত্র ও জনগণের শক্তিতে বিশ্বাস করে। এ জন্য কোনো সমস্যাই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদের মতে, বিএনপি জানে তাকে এবারের নির্বাচনে আসতে হবে। সরকারও তা জানে। আন্তর্জাতিক মহলও সবার অংশগ্রহণে একটা নির্বাচন চায়। এ অবস্থায় সরকার নিশ্চয় বিএনপির জন্য লালগালিচা বিছিয়ে দেবে না। বরং আরও কোণঠাসা করার চেষ্টা করবে। তিনি বলেন, সরকার রোহিঙ্গা সমস্যার মধ্যে আছে। তা দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমাধানের দিকে হাঁটছে। উদ্দেশ্য রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন শুরু করা। এই কাজে একটা অগ্রগতি অর্জন করার আগে হয়তো অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হাত দেবে না সরকার।
সূত্র: প্রথম আলো
Discussion about this post