রবিবার (২২ অক্টোবর) রাতে ঢাকায় বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের বৈঠক ‘নেহাত ফরমালিটি’র চেয়ে বেশি কিছু নয় বলে ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র এদিন বাংলা ট্রিবিউনের কাছে দাবি করেছে। এই বৈঠকের গুরুত্বকে রীতিমতো খাটো করে দেখিয়ে সূত্রটি আরও জানায়, ‘বিএনপির চেয়ারপারসনের সঙ্গে অনুষ্ঠিত এই বৈঠক নিয়ে আদৌ চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই এবং আমরা নিশ্চিত আওয়ামী লীগও সেটা জানে।’
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বাংলাদেশের তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী হলেও এই মুহূর্তে তিনি দেশের কোনও সাংবিধানিক পদে নেই। তার পরেও কেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দ্বিপাক্ষিক সফরে গিয়ে খালেদা জিয়া ও তার দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা করলেন, সে প্রশ্ন ওঠাটা স্বাভাবিক এবং উঠছেও।
মঙ্গলবার (২৪ অক্টোবর) বিকালে যখন সাউথ ব্লকে এই প্রশ্নটা রেখেছিলাম ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অত্যন্ত সিনিয়র একজন কর্মকর্তার কাছে, তিনি এক এক করে ব্যাখ্যা করলেন এই বৈঠকের পরিপ্রেক্ষিত। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই কর্মকর্তার দেওয়া সেই উত্তরগুলো হলো-
১. প্রায় চার বছর হতে চললো খালেদা জিয়া বাংলাদেশের বিরোধীদলীয় নেত্রীও আর নন। তারপরেও কিন্তু আমাদের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যখন ২০১৫ সালের জুনে বাংলাদেশ সফরে গিয়েছিলেন, খালেদা জিয়া তার হোটেলে এসে দেখা করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী মোদি যেখানে তাকে সময় দিয়েছেন, সেখানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী কেন দেবেন না? সুষমা স্বরাজ যখন ২০১৪ সালে ঢাকা সফরে যান, তখনও তিনি খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করেছিলেন।
২. বছরপাঁচেক আগে এই খালেদা জিয়াই কিন্তু ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির ঢাকা সফরের সময় তার সঙ্গে দেখা করেননি। জামায়াতে ইসলামী হরতাল ডেকেছে এই খোঁড়া অজুহাতে। আর সেই তিনিই এখন বারেবারে ভারতীয় নেতৃত্বের সঙ্গে দেখা করার অনুরোধ জানাচ্ছেন। প্রতিনিধিদল নিয়ে হোটেলে চলে এসেছেন আধাঘণ্টা কী চল্লিশ মিনিট কথা বলার জন্য। তো সেই অনুরোধ ভারত কেন ফেরাবে? বরং বৈঠকটি হলেই বরং আমরা বোঝাতে পারবো যে, গরজটা কার বেশি এবং কার মানসিকতায় পরিবর্তন এসেছে।
৩. নরেন্দ্র মোদি বা সুষমা স্বরাজ দুজনেই কিন্তু খালেদা জিয়াকে ঠিক তার প্রাপ্য সম্মানটুকু দিয়েছেন- বেশিও নয়, কমও নয়। ২০১৫ সালে আমার পরিষ্কার মনে আছে, আমাদের প্রধানমন্ত্রীর হোটেল স্যুইটের বাইরে খালেদা জিয়াকে আধাঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছিল। বাংলাদেশের তথ্যমন্ত্রী তথা জাসদ নেতা হাসানুল হক ইনুকেও আধাঘণ্টা বসতে হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী মোদি তখন বোধহয় কথা বলছিলেন বিরোধী নেত্রী রওশন এরশাদের সঙ্গে। এবারে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরেও প্রোটোকলের বাইরে গিয়ে ভারত কিছু করেনি। আবার বিএনপি নেত্রীকে কোনও অমর্যাদাও করা হয়নি।
৪. এছাড়া এই বৈঠকে বিএনপিকে ভারতের একটা বার্তা দেওয়ার ছিল। ধরে নিতে পারেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ সেই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়েছেন। এই বার্তাটা আর কিছুই নয়- ‘বাংলাদেশের পরবর্তী নির্বাচনে যদি বিএনপি অংশ না নেয়, তার দায় সম্পূর্ণ তাদেরই । পরে আন্তর্জাতিক বিশ্বকে তার জন্য দোষারোপ করে কোনও লাভ হবে না।’ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর বিএনপি ক্রমাগত বলে গেছে, স্রেফ ভারতের সমর্থনের জোরেই সরকার (আওয়ামী লীগ) নির্বাচনকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করে গেছে। ভারত আজ তাদের মনে করিয়ে দিলো, নির্বাচনে না লড়ার সিদ্ধান্ত ছিল বিএনপিরই, আর তার পরিণামও তাদেরই ভুগতে হবে।
৫. ভারত খুব ভালোভাবে জানে এই বৈঠক নিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাদের ভুল বোঝাবুঝি হওয়ার কোনও অবকাশ নেই। শেখ হাসিনা হলেন প্রতিবেশীদের মধ্যে আমাদের সবচেয়ে পরীক্ষিত ও আস্থাভাজন (‘টেস্টেড অ্যান্ড ট্রাস্টেড’) বন্ধু । তার সঙ্গে খালেদা জিয়ার কোনও তুলনাই হতে পারে না। এটাতো দুজনের শাসন আমলের ট্র্যাক রেকর্ড দেখলেই বোঝা যাবে। কিন্তু তারপরও কূটনৈতিক সৌজন্যের খাতিরে ভারতীয় নেতৃত্বকে অনেকের সঙ্গেই কথা বলতে হয়। অনেকের সঙ্গেই যোগাযোগ রক্ষা করতে হয়। এটুকু বোঝার মতো পরিণতিবোধ ও বিচক্ষণতা আওয়ামী লীগের আছে। সেটা নিশ্চয় আমাদের বলে দিতে হবে না! ফলে তারাও খুব ভালোভাবে জানেন যে, সুষমা স্বরাজ-খালেদা জিয়ার বৈঠক বড়জোর একটা ফর্মালিটি এবং এটাকে ততো গুরুত্ব না দিলেও চলবে।
বাংলাদেশে বিএনপির নেতারা তাদের নেত্রীর সঙ্গে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকের যা-ই তাৎপর্য খুঁজুন না কেন, ভারত ওই সাক্ষাৎপর্বকে যে ঠিক কোন চোখে দেখছে, তা বোধহয় ওপরের ওই বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট।
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন
Discussion about this post