বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ঠিক কতটা বিপন্ন, বিশ্বের সবচেয়ে সুপরিচিত মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তা নিয়ে আজ একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করতে চলেছে। কিন্তু বেশ আশ্চর্যজনকভাবে এই রিপোর্টটি ঢাকাতে বা অ্যামনেস্টির সদর দফতর লন্ডনে না করে প্রকাশ করা হচ্ছে ভারতের রাজধানী দিল্লিতে।
বাংলা ট্রিবিউন জানতে পেরেছে, অ্যামনেস্টির কর্মকর্তাদের বাংলাদেশ সরকার ভিসা দিতে রাজি হয়নি বলেই এক রকম বাধ্য হয়ে রিপোর্ট লঞ্চের জন্য তারা দিল্লিকে বেছে নিয়েছে। রিপোর্টের প্রতিপাদ্য বিষয়গুলো সরকারের জন্য খুব একটা স্বস্তিদায়ক হবে না, এটা আঁচ করেই বাংলাদেশ সরকার তাদের সঙ্গে এক ধরনের অসহযোগিতার মনোভাব দেখাচ্ছে বলেও অ্যামনেস্টি ধারণা করছে।
কেন এই রিপোর্টটি বাংলাদেশে না-করে ভারতে প্রকাশ করা হচ্ছে, এই প্রশ্নের জবাবে ভারতে অ্যামনেস্টির অন্যতম প্রধান মুখপাত্র স্মৃতি সিং এই প্রতিবেদককে বলেছেন,‘ভিসার জটিলতা একটা প্রধান কারণ। তা ছাড়া এই ধরনের রিপোর্ট প্রকাশ করতে গেলে যে ধরনের পরিবেশ দরকার, সেটাও আমরা ঢাকাতে পাচ্ছি না। বাংলাদেশে আমাদের কর্মকান্ড, জনবলও তুলনায় সীমিত—ফলে এই মুহুর্তে অনুষ্ঠানটা দিল্লিতে করা ছাড়া আমাদের সামনে কোনও উপায় ছিল না।’
এই রিপোর্টটি মূলত প্রকাশ করা হচ্ছে ‘ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ডে’ বা ‘বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস’ উপলক্ষে, যা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উদযাপিত হবে বুধবার ৩রা মে। অ্যামনেস্টির পরিকল্পনা ছিল ওই দিনে ঢাকাতেই তারা রিপোর্টটি প্রকাশ করবে। কিন্তু অ্যামনেস্টির একাধিক কর্মকর্তা যথেষ্ট আগে থেকে ভিসার আবেদন করা সত্ত্বেও তা দীর্ঘদিন ধরে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। ৩ মে’র আগে ভিসা পাওয়ার কোনও সম্ভাবনা না থাকায় আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনটি শেষে সিদ্ধান্ত নেয় ভারতের রাজধানী দিল্লিতেই তারা রিপোর্টটি প্রকাশ করবে।
এই রিপোর্ট প্রকাশ উপলক্ষে দিল্লিতে এসেছেন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক গবেষক ওলফ ব্লমকউইস্ট। বাংলাদেশে কীভাবে স্বাধীন মতপ্রকাশের কন্ঠরোধ করা হচ্ছে, লন্ডনে নানা অনুষ্ঠানে বা প্ল্যাটফর্মে তিনি বহুদিন ধরেই সে তথ্য প্রকাশ করে আসছেন।
এমনকি ব্রিটিশ পার্লামেন্টে সে দেশের বিভিন্ন এমপি’র সহায়তায় যুক্তরাজ্য বিএনপি (বা তাদের সহযোগীরা) বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে যে সব আলোচনাচক্র বা সেমিনার আয়োজন করে থাকে তার অনেকগুলোতেই ব্লমকউইস্টকে অংশ নিতে দেখা গেছে। রীতিমতো কঠোর ভাষায় সেখানে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির সমালোচনাও করেছেন তিনি। ফলে খুব স্বাভাবিকভাবেই তিনি বাংলাদেশে বর্তমান সরকারের খুব একটা সুনজরে নেই।
তাছাড়া সাধারণভাবে মৃত্যুদন্ডের বিরুদ্ধে অ্যামনেস্টির যে অবস্থান, সেটাও বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে এই সংগঠনটির সম্পর্কে এক ধরনের অস্বস্তি সৃষ্টি করেছে। যখনই বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে কোনও রাজনীতিবিদের ফাঁসির আদেশ হয়েছে বা ফাঁসি হয়েছে – অ্যামনেস্টি এসব রায় এবং ত্রুটিপূর্ণ বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে এবং শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত সেই ফাঁসি রোখার জন্য আন্তর্জাতিক স্তরেও চেষ্টা চালিয়ে গেছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ও আদালতের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে অ্যামনেস্টির এই ধরনের অবস্থানও বাংলাদেশ সরকার খুব একটা ভালোভাবে নেয়নি।
এই সব নানা কারণেই শেষ পর্যন্ত অ্যামনেস্টির পক্ষে তাদের বাংলাদেশ-বিষয়ক এই প্রতিবেদনটি ঢাকাতে প্রকাশ করা সম্ভব হল না। তার বদলে আজ মঙ্গলবার বিকেলে দিল্লিতে ভারতের জাতীয় প্রেস ক্লাব প্রাঙ্গণে রিপোর্টটি প্রকাশ করা হবে। তারপর সেই বিষয়ে একটি আলোচনাসভাও হবে।
রিপোর্টটির পুরো শিরোনাম হল, ‘কট বিটউইন ফিয়ার অ্যান্ড রিপ্রেশন : অ্যাটাকস অন ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশন ইন বাংলাদেশ’। অর্থাৎ আতঙ্ক আর দমন-পীড়নের জাঁতাকলে পড়ে বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কীভাবে আক্রান্ত হচ্ছে, রিপোর্টটি সেটাই তুলে ধরবে।
অ্যামনেস্টি আরও বলছে, বাংলাদেশে স্বাধীন মতপ্রকাশের পরিসর ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়ে আসছে এবং গত কয়েক বছরে আওয়ামী লীগ সরকার প্রতিবাদী কন্ঠস্বরের বিরুদ্ধে এক ‘ভয়াবহ ক্র্যাকডাউন’ শুরু করেছে। বহু ধর্মনিরপেক্ষ ব্লগার ও অ্যাক্টিভিস্ট সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর হাতে খুন হয়েছেন, কিন্তু তার জবাবে সরকারের যে প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে সেটাও তাদের মতে অত্যন্ত নিরাশাজনক।
ফলে অ্যামনেস্টির এই রিপোর্টটি ঢাকাতেই বের হোক বা দিল্লিতে, বাংলাদেশ সরকারের জন্য তা যে শ্রুতিমধুর শোনাবে না তা বলাই বাহুল্য!
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন
Discussion about this post