মোস্তফা ফয়সাল পারভেজ
১৬ এপ্রিল তুরস্কের অনুষ্ঠিত গনভোটে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান সমর্থকদের হ্যা ৫১.৪% ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছে। এ বিজয়ের মাধ্যমে এরদোয়ান সমর্থকদের মাঝে যেমন খুশির বন্যা দেখা যাচ্ছে বিরোধী শিবিরে তদ্রুপ শোক পরিলক্ষিত হচ্ছে। এরদোয়ান বিজয়ের পরদিন তার রাজনৈতিক গুরু সাবেক প্রধানমন্ত্রী প্রফেসর ড: নাজমুদ্দিন আরবাকান, সাহাবী আইয়ুব আনসারী (রা:) এবং ইস্তানবুল বিজয়ের মহানায়ক ফাতিহ সুলতান মাহমুদের কবর জিয়ারতের মাধ্যমে তার দিনের কাজ শুরু করেন।
২০১৯ সালের ৩ নভেম্বর তুরষ্কের নির্ধারিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পরেই এই সিস্টেম পুরাপুরি কার্যকর করা হবে। এ বিজয়ের মাধ্যমে তুরষ্ক দীর্ঘ ৬১ বছর পর আবারো প্রেসিডেন্সিয়াল সিস্টেমে প্রবেশ করলো। ১৯২৩ সালে তুরষ্ক প্রজাতন্ত্রের যাত্রা শুরু থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত একদলীয় শাসন ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিলো, যেখানে আতাতুর্কের সিএইচপি ব্যতিত অন্য কোনো রাজনৈতিক দল অংশ নিতে পারতোনা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিমাদের পরামর্শে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইসমত ইনুনু একদলীয় ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে বহুদলীয় রাজনীতিতে প্রবেশের মাধ্যমে সেখানে সংসদীয় ব্যবস্থার যাত্রা শুরু হয় এবং ১৯৫০ সালে প্রথমবারের আদনান মেন্দেজের নেতৃত্বে ডেমোক্রেট পার্টি বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়ে ক্ষমতায় আসেন।
কিন্তু ১৯৬০ সালের ২৭ মে আতার্তুক এবং ইসমত ইনুনুর আনুসারী সেনা প্রধান জেমাল গুর্সেলের নেতৃত্বে মিলিটারি ক্যু ঘটিয়ে তুরষ্কের প্রথম নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী আদনান মেন্দেস এবং তার অর্থ ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তুরষ্কের রাজনীতিতে পুনরায় কালো অধ্যায়ের যাত্রা শুরু হয়। তাদের মাধ্যমে ১৯৬১ সালে গঠিত হয় Anayasa mahkemesi (সাংবিধানিক কোর্ট) এবং Mıllı Güvenlik kurumu (জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল) যারাই মুলত ক্ষমতার কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন।
এরপর দীর্ঘ ৪০-৫০ বছরে ইজরাঈল এবং পশ্চিমাদের মদদপুষ্ট এই সেনাবাহিনী এবং এসব প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানেই পরিচালিত হয় তুরষ্কের সরকার ব্যবস্থা। বিচারপতি নিয়োগসহ রাষ্ট্রের অনেক গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলো তারা ছিলেন অনেক শক্তিশালী। যার ফলেই ১৯৭১, ১৯৮০ এবং ১৯৯৭ সালে তিনটি ক্যু এবং পোষ্ট মডার্ন ক্যু এর মাধ্যমে বার বার নির্বাচিত সরকারের পতন ঘটানো হয়। এসমস্ত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তুরষ্কের জনগন হারিয়ে ফেলে তাদের নুন্যতম ধর্মীয় স্বাধীনতাটুকু।
এরদোগান এবং আব্দুল্লাহ গুলের নেতৃত্বে ১৪ আগষ্ট ২০০১ সালে গঠিত হয় ” একে পার্টি” বা জাস্টিস এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি। ২০০২ সালের নির্বাচনে ৩৪% জনসমর্থন এবং ৬৬% সংসদ সদস্য নিয়ে সরকার গঠন করে। এরপর ২০০৭ সালে ৪৬.৫৮% ভোট, ২০১১ সালে ৪৯.৮৩% এবং ২০১৫ সালের ১ লা নভেম্বর ৪৯.৫০% ভোট নিয়ে এখন পর্যন্ত ক্ষমতায় আছেন। দীর্ঘ সময়ে তুরষ্কের বিপুল পরিমান আর্থ সামাজিক উন্নয়নের মাধ্যমে এরদোয়ান অধিকাংশ জনগনের মনে জায়গা করে নিয়েছেন, সেই সাথে তুরষ্কের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগনের ধর্মীয় স্বাধীনতা পালনের নিষেধাজ্ঞা সমুহ তুলে ফেলেন।
২০২৩ সালের মধ্যে তুরষ্কে অর্থনৈতিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জনসেবা, সামরিক সহ সকল দিয়ে একটি লক্ষ্যমাত্রায় পৌছার নিমিত্তেই সংবিধান পরিবর্তন করে প্রেসিডেন্সিয়াল সিস্টেমে প্রবেশের জন্য ১৬ এপ্রিল তুরষ্কে গনভোটের আয়োজন করা হয়। এই সিস্টেম কার্যকরী হবার পর তুরষ্কের প্রেসিডেন্ট আইন বিভাগ,শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগের প্রধান হবেন। সংসদ সদস্যদের সংখ্যা ৫৫০ থেকে ৬০০ হবে, এমপিদের সর্বনিম্ন বয়স ২৫ এর পরিবর্তে ১৮ হবে, সরকারের মেয়াদ ৪ বছরের পরিবর্তে ৫ বছর হবে। জনগনের সাথে সংশ্লিষ্টতা বাড়ানোর লক্ষে প্রেসিডেন্টের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা থাকবে। প্রেসিডেন্ট এর আধ্যাদেশ জারির ক্ষমতা, যুদ্ধাবস্থা ছাড়া মিলিটারি কোর্ট প্রতিষ্ঠা করা যাবেনা। সংসদের অনুমতি ব্যতিত রাষ্ট্রপতি জরুরি অবস্থা ঘোষনা করতে পারবেনা। ৬৬% সংসদ সদস্যদের সমর্থন থাকলে যেকোনো প্রেসিডেন্ট জবাবদিহি করতে বাধ্য।
উল্লেখ্য বর্তমান সিস্টেমে প্রেসিডেন্ট সকল জবাবদিহির উর্ধে, বিচারক ও প্রসিকিউটর নিয়োগে জনগনের মতামতের প্রতিফলন ঘটাতে ৭ জন বিচারক সংসদ সদস্যরা নির্ধারণ করবে এবং ৪ জন প্রেসিডেন্ট নির্ধারন করবে, বাজেট পাশের ক্ষমতা প্রেসিডেন্ট এর হাতে থাকবে। স্বশস্ত্র বাহিনীর প্রধান “জাতীয় নিরাপত্তা বোর্ড” বা ” Milli Güvenlik Kurulu” কর্তৃক নির্ধারিত হবে। প্রধানমন্ত্রী পদ বিলুপ্ত হবে। প্রেসিডেন্ট এর সাথে এক বা একাধিক ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকবেন। সাধারনত পরবর্তী নির্বাচন ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত হবার কথা থাকলেও, সংসদ চাইলে আগামী ৬ মাসের মধ্য ইলেকশন দিতে পারে।
এ নির্বাচনে সকল জরিপে এরদোয়ান পন্থীদের ৫৫% ভোট পাবার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তারা ৫১.৪০% পেয়েছে। তবে ধারনা করা হচ্ছে জাতিয়তাবাদীদের ১০% ভোট পাওয়ার কথা থাকলে তা ৩-৪% এর বেশি পায়নি। একই সাথে আংকারা ইস্তানবুলের মত বড় দুই শহরে এরদোয়ানপন্থীরা সামান্য ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হয়েছে। তাদের প্রাপ্ত ভোট ইস্তানবুল ৪৮.৬% এবং আংকারায় ৪৮.৮%, অথচ ২০১৫ সালের ১ লা নভেম্বর শেষ নির্বাচনে ইস্তানবুলে একে পার্টি ৪৮.৮% এবং আংকারায় ৪৮.৭% ভোট পেয়েছিলো। তবে কুর্দিশ এলাকাগুলোতে এরদোয়ানের ভোট ১০-৩০% পর্যন্ত বেড়েছে।
এই রেফারেন্ডমে বিজয়ের মাধ্যমে এরদোয়ানের দ্বায়িত্ব আরো বৃদ্ধি পেলো। সেই সাথে না সমর্থনকারী ৪৮% জনগন এবং পশ্চিমা দেশগুলোর উৎকন্ঠাও বেড়ে গেলো, যারা ধারনা করছে এরদোয়ান বিজয়ের মাধ্যমে স্বৈরাচার হয়ে যেতে পারে। যদিও সংবিধান অনুযায়ী এরদোয়ান আর দুইবারের বেশি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেনা। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে সংগ্রাম করে উঠে আসা বিজেতা রিসেপ তায়েপ এরদোয়ান একটি শক্তিশালী উন্নত তুরষ্ক গঠনের পাশাপাশি, মুসলিম উম্মাহ এবং মানবতার জন্য অতীতের ন্যয় কাজ করে যাবেন এটাই সকলে প্রত্যাশা করেন।
লেখক: পিএইচডি গবেষক, তুরস্ক
Discussion about this post