অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আন্দোলনে নেমেছে। যদিও এ আন্দোলনে তারা জনগণের এমনকি ছাত্রদের সাপোর্ট পাচ্ছে না। বরং রা উপহাসের শিকার হচ্ছেন। এর বড় কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কখনোই আন্দোলন এমনকি ছাত্রদের যৌক্তিক আন্দোলনেও সমর্থন দেয়নি। বরং আওয়ামী সরকারের সব অযৌক্তিক, বৈষম্যমূলক ও প্রহসনমূলক সিদ্ধান্তকে সাপোর্ট দিয়ে পত্রিকায় লিখেছেন। এমনকি যে সর্বজনীন পেনশনের বিরুদ্ধে তারা আন্দোলন করছেন সেই স্কিমের পক্ষেও তারা সাফাই গেয়েছেন। অবশ্য এদেশের মানুষ তাদের সেসব লেখায় কর্ণপাত করেননি।
শিক্ষকরা যে স্কিমের পক্ষে লিখেছেন সেই স্কিম যখন শিক্ষকদের ওপর প্রয়োগ করা হলো, তখন তারা এর বিরুদ্ধে হাস্যকরভাবে আন্দোলন শুরু করলেন। যাই হোক শিক্ষকদের ওপর বাধ্যতামূলকভাবে প্রয়োগ হওয়া এ স্কিমের বিরুদ্ধে কেন তারা অবস্থান করছেন তা একটু ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছি।
শিক্ষকমহল মনে করছেন, এটি বৈষম্যমূলক ও অবমাননাকর। কারণ যারা স্কিমের পরিকল্পনাকারী অর্থাৎ আমলারা এই স্কিমের আওতায় আসে নি। এ বিষয়ে অবশ্য শিক্ষকেরা প্রথমেই এ চূড়ান্ত আন্দোলনে যাননি। তাঁরা নিয়মতান্ত্রিকভাবে উদ্বেগগুলো তুলে ধরার পরও কর্তৃপক্ষ কর্ণপাত করেননি। শেষমেশ কোনো উপায়ান্তর না দেখে তাঁরা এ চূড়ান্ত আন্দোলনে নেমেছেন। এই আন্দোলনের যৌক্তিকতা খুঁজতে গেলে শুধু প্রত্যয় স্কিম দিয়ে বিচার করলে ভুল হবে। একটু আগে ফিরে যেতে হবে। আমরা শিক্ষকদের আন্দোলনের কারণগুলো আলোচনা করবো।
১. দীর্ঘদিন থেকে শিক্ষকমহল একটি স্বতন্ত্র বেতন স্কেলের জোরালো দাবি করে আসছিলেন। এ ব্যাপারে সরকারের ওপরমহল থেকে মোটামুটি আশ্বাস পাওয়া গেলেও ২০১৫ সালের অষ্টম জাতীয় পে স্কেলে তার সম্পূর্ণ বিপরীত ঘটনা ঘটলে শিক্ষকমহলে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার হয়।
ওই পে স্কেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের (অধ্যাপক) গ্রেড এক ধাপ পিছিয়ে দেওয়া হয়। ফলে শিক্ষায় ও মেধায় এগিয়ে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা এটা মেনে নেননি। তীব্র শিক্ষক আন্দোলনের মুখে সরকার অধ্যাপকদের জন্য তিনটি গ্রেড করেন, যেখানে প্রথম গ্রেডে অধ্যাপকদের মাত্র ২৫ শতাংশ যেতে পারবেন। পাশাপাশি নতুন একটি ‘সুপার গ্রেড’ চালু করেন, যে গ্রেডে শিক্ষকেরা যেতে পারবেন না। শিক্ষকসমাজ সেটি নিয়ে মনঃক্ষুণ্ন হলেও মেনে নিয়েছেন।
২. শিক্ষকেরা অবসরের সময় সেশন বেনিফিট বলে একটি সুবিধা পেতেন, জন্মসূত্রে চাকরির মেয়াদ যেদিনই পূর্ণ হোক না কেন, সেশনের শেষ দিন ৩০ জুন পর্যন্ত চাকরি করতে পারতেন। হঠাৎ সেটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। এখন যেদিনই ৬৫ বছর পূর্ণ হবে, পরদিন থেকেই অবসর।
৩. পিএইচডি শেষে যোগদান করলে আগে বিশেষ বর্ধিত বেতন সুবিধা দেওয়া হতো, সেটিও আর নেই। শিক্ষকদের এমনিতেই তুলনামূলক সুযোগ-সুবিধা কম। তারপরে এই ছোট ছোট সুযোগ-সুবিধা দিনে দিনে কর্তন করা শুরু হয়। শিক্ষকেরা সেটি নিয়েও আপত্তি জানাননি।
৪. শেষে, প্রত্যয় স্কিমের ঘোষণা এলে শিক্ষকেরা সেটি নিয়ে সরব হন এবং তীব্র বিরোধিতা করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, সর্বজনীন পেনশন স্কিম শুধু যাঁরা কোনো পেনশন-ব্যবস্থার মধ্যে নেই, তাঁদের জন্য। যাঁরা পেনশন-ব্যবস্থার মধ্যে আছেন, তাঁরা এর অন্তর্ভুক্ত হবেন না। সেখানে বছর না পেরোতেই হঠাৎ স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রত্যয় স্কিমের ঘোষণা এলে শিক্ষকমহলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। কারণ, যেসব সরকারি কর্মচারী এই স্কিম তৈরি করলেন, তাঁরা নিজেরাই সেই স্কিমের বাইরে থাকলেন।
৫. বিদ্যমান পেনশন স্কিমের অধীন যাঁরা একই সুবিধাদি পেতেন, নতুন স্কিমে তাঁদের একই স্কিমের অন্তর্ভুক্ত করা হলে সেটি নিয়ে বৈষম্যের কথা হয়তো উঠত না। যেখানে বেতন স্কেল সবার জন্য একসঙ্গে কার্যকর হয়, সেখানে সরকারি কর্মচারীদের বাইরে রেখে নতুন স্কিম প্রচলন করাকে শিক্ষকেরা অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক বলে মনে করেন।
৬. চলতি বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী অবশ্য বলেছেন, আগামী জুলাই থেকে সরকারি কর্মচারীও এই পেনশন স্কিমের মধ্যে আসবেন। সরকার ঘোষণা দিয়েছে বটে, কিন্তু এখনো কোনো প্রজ্ঞাপন আসেনি। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেনশন স্কিমের কাঠামো কেমন হবে, প্রত্যয় থেকে কতটা আলাদা বা কাছাকাছি হবে, সে বিষয়ে কিছু পরিষ্কার নয়।
৭. বিদ্যমান স্কিমের চেয়ে প্রত্যয় স্কিমে কী কী সুবিধা থাকছে না, সেটিও গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে অবসরের বয়স বলা হয়েছে ৬০, যা বিদ্যমান স্কিমে ৬৫, প্রতি মাসে বেতন থেকে টাকা কাটা হবে, অবসরে এককালীন আনুতোষিক নেই, অর্জিত ছুটির বিপরীতে আর্থিক সুবিধা নেই, পেনশনের বার্ষিক বৃদ্ধি নেই, এবং বোনাস-ভাতা ইত্যাদির কথা বলা নেই। যদিও পেনশন কর্তৃপক্ষ স্পষ্টীকরণ নোটিশে বলেছে, শিক্ষকদের জন্য ৬৫ বছর বহাল থাকবে।
৮. শিক্ষকরা সরকারের কথায় আস্থা রাখছে না। কারণ স্বয়ং শেখ হাসিনা বলেছেন সর্বজনীন পেনশন স্কিম শুধু বেসরকারি লোকদের জন্য কার্যকর থাকবে। বছর না ঘুরতেই এটা স্বায়ত্বশাসিত চাকুরেদের ওপর আরোপ করা হয়েছে। মূলত শিক্ষকরা ভাবছে সরকার সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য চলমান পেনশন প্রথা বাতিল করতে চাচ্ছে!
৯. সর্বজনীন পেনশন স্কিম একটি ডিপিএস সিস্টেম! তবে, এই ডিপিএস তথা সর্বজনীন পেনশন স্কিম প্রচলিত ডিপিএস থেকেও সরকারি চাকরিজীবীকে কম টাকা দিবে! ঘোষিত সর্বজনীন পেনশন সুবিধায় একজন সরকারি চাকরিজীবী যদি প্রতি মাসে ৫০০০ টাকা জমা দেন তাহলে উনি প্রতি মাসে ৬২,৩৩০ টাকা পেনশন পাবেন! ১৫ বছর পেনশন পেলে উনি সর্বমোট পেনশন পাবেন ১,১২,১৯,৪০০/- মাত্র! ১৫ বছর ধরে পাওয়া এই টাকার ৩০ বছর পরের তৎকালীন প্রেজেন্ট ভ্যালু (১০% ডিসকাউন্টে) হবে ৫৬,৮৯,০৪৩/- টাকা মাত্র!!
একজন সরকারি চাকরিজীবী যদি প্রতি মাসে ৫০০০ টাকা ব্যাংকে ডিপিএস রাখেন তাহলে তিনি ১০% মুনাফা বিবেচনায় ৩০ বছর পর এককালীন পাবেন ১,১৩,০২,৪০০/-! টাকার হিসেবে একজন সরকারি চাকরিজীবী ডিপিএস এর তুলনায় সর্বজনীন পেনশন স্কিমে ৩০ বছর পর অন্তত: ৫৬,১৩,৩৫৭/- টাকা কম পাবেন!!
উল্লেখ্য, যাঁরা এই আন্দোলন করছেন, তাঁদের নিজেদের জন্য এটি করছেন না। কারণ, নতুন স্কিম কার্যকর হবে ১ জুলাই ২০২৪ সালের পর যাঁরা নতুন চাকরিতে যোগদান করবেন, তাঁদের ক্ষেত্রে। তাহলে শিক্ষকদের এই আন্দোলন কেন?
মূলকথা হলো শিক্ষকরা সরকারকে বিশ্বাস করেন না। তারা ভেবে নিয়েছেন আজ না হলেও কিছুদিন পর সবাইকেই এই স্কিমের আওতায় নিয়ে আসা হবে। তবে শিক্ষকরা বলছেন, এই স্কিম উচ্চশিক্ষার জন্য হুমকি। এটি কার্যকর হলে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষকতা পেশায় মেধাবী শিক্ষার্থীরা আগ্রহ হারাবেন।
এই আশঙ্কা একেবারে অমূলক নয়। বর্তমান তরুণ প্রজন্মের শিক্ষকেরা উচ্চশিক্ষায় বিদেশ গমন করে ফিরে আসার আগ্রহ হারাচ্ছেন। এ ছাড়া মেধাবী শিক্ষার্থীদের এখন উচ্চশিক্ষায় বিদেশ গমনের প্রবণতা অনেক বেশি। এমনকি বিসিএস পরীক্ষায় শিক্ষা ক্যাডারে পছন্দ দেওয়ার হার সবচেয়ে কম। অন্য ক্যাডারের চেয়ে এখানে সুযোগ-সুবিধা যেমন কম, তেমনি এটি অবহেলিত। সার্বিকভাবে শিক্ষকতা পেশায় মেধাবীদের আগ্রহ এবং পছন্দ কমে যাওয়ার আশঙ্কা আরও বেড়ে যাবে। ভবিষ্যতে মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশায় বিমুখ হয়ে গেলে জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
শিক্ষা ক্ষেত্রে এই আশঙ্কা শিক্ষকসমাজ যত প্রত্যক্ষভাবে উপলব্ধি করছে, হয়তো অন্যরা সেভাবে উপলব্ধি করছে না। কিন্তু ভবিষ্যতের শিক্ষাকে বাঁচানোর দায় শুধু শিক্ষকদের নয়, বর্তমান শিক্ষার্থীদের, রাষ্ট্রের বিবেকবান, বিদ্যানুরাগী দেশপ্রেমী সব নাগরিকেরও এ ব্যাপারে ভূমিকা রাখার দায় আছে।
Discussion about this post