বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, র্যাবকে যেন অন্ধকারের মৃত্যু পরোয়ানা নিয়ে ঘুরে বেড়ানো একটি সংগঠনে পরিণত করেছে এই সরকার। সুইডিশ রেডিওতে র্যাবের গুপ্তহত্যার লোমহর্ষক বর্ণনা ফাঁস হওয়াতে এদের কর্মকান্ডের বিভৎসরুপ এখন শুধু বাংলাদেশ নয়, সারাবিশ্বের মানুষের বিবেককে প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছে।
আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে নয়া পল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, বাংলাদেশের নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ঠেলে দেয়া কোনো প্রতিরক্ষা চুক্তি এদেশের মানুষ মেনে নেবে না জানিয়ে বিএনপি বলেছে, বাংলাদেশের জনগণ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে দুর্বল হতে দেবে না। দেশের দুই একজন লোক ভারতে চাকুরি করতে পারে, কিন্তু জনগণ একাত্তরের মতোই তাদের বীরত্ত্ব দিয়ে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা করবে।
রিজভী বলেন, বিরোধী দলের গণতান্ত্রিক কর্মসূচিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে নিষ্ঠুর নিপীড়ণের চিত্র আমরা বারবার বলেছি এবং আপনারা গণমাধ্যম তা নিজচক্ষে প্রত্যক্ষ করে তা প্রচার করেছেন। গুম-খুনের নানা বিভৎস দৃশ্য সরকারের বিধি-নিষেধের পরেও গণমাধ্যম সেগুলি প্রচার ও প্রকাশ করেছে। তিনি বলেন, র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটেলিয়ান-র্যাব এর বিরোধী দলদমনে অমানবিক নৃশংসতার ঘটনা আজ মানুষের মুখে মুখে। এ বিষয়ে আমরা অনেক কথা বলেছি। সন্তানহারা অনেক মায়ের আহাজারি, স্বামীহারা স্ত্রীর বুকফাটা কান্না এবং পিতাহারা শিশুর পিতার জন্য অপেক্ষার করুণ আর্তি এই র্যাবের জন্যই সৃষ্টি হয়েছে।
বিএনপির এই নেতা বলেন, সুইডেনের সরকারী অর্থায়নে পরিচালিত ‘সভারিজেস রেডিও’ গোপনে ধারণকৃত একটি অডিও প্রকাশ করেছে, ওই রেডিওতে একজন উচ্চ পদস্থ র্যাব কর্মকর্তা কিভাবে মানুষ হত্যা করে সাজানো নাটক বানায় সেটির বর্ণনা উঠে এসেছে। সেই ধারণকৃত অডিওতে শরীরে কাঁটা দেয়া মর্মস্পর্শী ঘটনার অসংখ্য বর্ণনার মধ্যে একটি জায়গায় বলা হয়েছে- ‘যদি তুমি তাকে (টার্গেটকৃত ব্যক্তি) খুঁজে পাও তাহলে সেই যেই হোক না কেনো তাকে গুলি করো ও হত্যা করো, তার পাশে একটি অস্ত্র রেখে দাও’। সেই অডিওতে ক্রসফায়ারে কিভাবে হত্যাটিকে নাটকীয় কায়দায় মিডিয়া ও সাধারণ মানুষের নিকট তুলে ধরা হবে সেটিরও বর্ণনা আছে। সেখানে বলা হয়-র্যাব সদস্যদের দিকে গুলি করার কারণেই র্যাবকে পাল্টা গুলি চালাতে হয় এবং তাতেই তাদের টার্গেটকৃত ব্যক্তির মৃত্যু ঘটে।
রিজভী বলেন, র্যাবের ওই কর্মকর্তা কিভাবে কোন ব্যক্তিকে গুম করা হয় সেটির তিনটি কৌশলের কথাও উল্লেখ করেছেন। কৌশলগুলি হলো-টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে ধরা, তাকে হত্যা করা, লাশ লুকিয়ে ফেলা। নিহতদের মরদেহ নদীতে ফেলে দেয়ার আগে লাশের সঙ্গে কিভাবে কংক্রিটের ব্লক বেঁধে দেয়া হয় অডিও কথোপকথনে সেটিরও বর্ণনা দেয়া হয়েছে। কার সন্তান কখন নিরুদ্দেশ হয়ে যায়, বন্দুকযুদ্ধের নামে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয় এ নিয়ে এখন সারাদেশে আতঙ্ক বিরাজ করছে। তার ওপর সারাদেশ এখন সুইডিশ রেডিওতে অডিওটি’র ঘটনা প্রকাশিত হওয়ার পর সারাদেশ এখন শোক ও বেদনায় স্তব্ধ। র্যাবের মতো একটি খুনে বাহিনী ব্যবহার করেই প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলকে দমন করান এবং জনগণকে চোখ রাঙিয়ে কথা বলেন।
তিনি আরো বলেন, এই সমস্ত বাহিনী দিয়েই ক্ষমতাসীনরা আমাদের জনসমাজ থেকে গণতন্ত্র, সহনশীলতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা, ন্যায়-বিচার, ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ সবকিছুকেই স্তব্ধ করে দেয়া হয়েছে। আর এ কারণেই জঙ্গিবাদ নামক একটি নতুন উপদ্রবের উপসর্গ সারাজাতিকে উদ্বিগ্ন ও আতঙ্কিত করে তুলেছে। এর সাথে জড়িতদের মধ্যে শাসকদলের সংশ্লিষ্টতা জাতিকে হতবাক করেছে। গত কয়েকদিন আগে ময়মনসিংহে যে জঙ্গিদের ধরা হয়েছে তাদের মধ্যে একজন ধোবাউড়া উপজেলা বাঘবেড় ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি আল আমিন, আরো দু’জন আওয়ামী পরিবারের সদস্য এবং যেই ভবন থেকে তাদেরকে ধরা হয়েছে সেই ভবনটি আওয়ামী লীগের একজন সাবেক এমপির বাড়ি। যেমনভাবে শায়খ আব্দুর রহমান থেকে শুরু করে হলি আর্টিজানের জঙ্গি হামলার সাথে জড়িত কেউ কেউ আওয়ামী পরিবারের সদস্য।
প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর প্রসঙ্গে রিজভী বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সফরে ভারতের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি প্রায় অর্ধশত চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করবে বলে গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে। বিএনপির পক্ষ থেকে প্রতিরক্ষা চুক্তির বিষয়সহ এ ঘটনার উদ্বেগ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের পুর্বেই সম্ভাব্য চুক্তির বিষয়ে জাতির সামনে তুলে ধরার দাবি জানানো হয়েছে। এর পরই পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর এই সফরে প্রতিরক্ষাসহ ৩৩টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হতে পারে। তবে তিনি বাংলাদেশের মানুষের বহু প্রতিক্ষিত তিস্তা চুক্তিকে অবজ্ঞা করে বলেছেন তিস্তা চুক্তি হলে বা না হলে কি আসে যায়। তার এই বক্তব্যে গোটা বাংলাদেশের মানুষের মাঝে ক্ষোভের ঝড় বইছে।
রিজভী বলেন, ভারতীয় গণমাধ্যমের সূত্র ধরে বাংলাদেশের গণমাধ্যম ও সুধী সমাজের মধ্যে সঞ্চার হয়েছে উদ্বেগ। কথা উঠেছে, এই সফরকালে ভারতের সাথে প্র্রতিরক্ষা চুক্তি ও সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। অথচ বাংলাদেশ সরকার এসব স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে জাতিকে স্পষ্ট করে কিছুই বলছে না। ফলে উৎকণ্ঠা বেড়ে চলছে।
তিনি বলেন, স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান অনুমতির তোয়াক্কা না করে প্রতিরক্ষা বাহিনীকে শক্তিশালী করেছিলেন এবং ক্যান্টনমেন্ট এর সংখ্যা বৃদ্ধি করেছিলেন। আজকের মতোই জনমতকে তাচ্ছিল্য করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার দেশের অঙ্গচ্ছেদ করে বেরুবাড়ী দিল্লির দরবারে উপহার হিসেবে দিয়েছিল। কিন্তু দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে ঝুলিয়ে রাখা ভূমি সীমান্ত সমস্যার এক ধরণের লোক দেখানো সমাধানের কথা বলা হলেও এখনও কঠিন জটিল আবর্তের মধ্যে পড়ে আছে ছিটমহলবাসীরা। উপরন্তু চুক্তি ছাড়াই ভারতের পরীক্ষামূলকভাবে কয়েকদিনের জন্য ফারাক্কা বাঁধ চালুর প্রস্তাব তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার মেনে নিয়ে অনুমতি দিয়েছিল। কিন্তু ভারত সেই সুযোগ নিয়ে স্থায়ীভাবে ফারাক্কা বাঁধ চালু রেখেছে, ফলে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলকে শুস্ক, রুক্ষ ও মরুময় অঞ্চলে পরিণত করা হয়েছে। অতি নতজানু হওয়ার কারনেই দিল্লীর মতলব টের পায়নি তৎকালীন আওয়ামী সরকার।
সূত্র: নয়াদিগন্ত
Discussion about this post