পুলিশের মতোই আটক-তল্লাশি-জব্দের ক্ষমতা পাচ্ছে আনসার সদস্যরা। এ বিধান রেখে ‘আনসার ব্যাটালিয়ন বিল-২০২৩’ জাতীয় সংসদে তোলা হয়েছে। এ বিলের মাধ্যমে আটক, দেহ তল্লাশি ও মালামাল জব্দের ক্ষমতা পাচ্ছেন আনসার সদস্যরা। নতুন এই বিলে আনসারে বিদ্রোহের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড রাখা হয়েছে। এই বিল নিয়ে নানা মহলে বইছে সমালোচনার ঝড়।
এটি এমন এক সময়ে করা হলো এবং ব্যাটালিয়ন আনসার বাহিনীর সদস্যদের হাতে এমন সব ক্ষমতা দেওয়া হলো, যা সাধারণ বিবেচনায় উদ্বেগের বিষয় তো বটেই; এটি আসন্ন নির্বাচন নিয়ে ক্ষমতাসীনদের একধরনের পরিকল্পনার ইঙ্গিতও বহন করে। এই ইঙ্গিত সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের বিপরীতে দেশে একধরনের ভীতি এবং শঙ্কা ছড়িয়ে দেওয়ারই অংশ বলে বিবেচিত হতে পারে।
প্রস্তাবিত এই বিলের ৮ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যাটালিয়ন সদস্যের সামনে সংঘটিত অপরাধের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার অনুমোদনক্রমে অপরাধীকে আটক করে অবিলম্বে পুলিশের কাছে সোপর্দ করবে এবং ক্ষেত্রমতো জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট অথবা দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নির্দেশক্রমে আটক ব্যক্তির দেহ তল্লাশি, কোনো স্থানে প্রবেশ ও তল্লাশি এবং মালামাল জব্দ করতে পারবে।
আনসার এবং ভিডিপির মোট সদস্যসংখ্যা ৬১ লাখ। তবে এর মধ্যে কমপক্ষে ২০ হাজার ব্যাটালিয়ন আনসারের সদস্য। প্রস্তাবিত বিল অনুসারে এই ক্ষমতার অধিকারী হচ্ছেন ব্যাটালিয়ন আনসারের সদস্যরা। আইন অনুযায়ী, বাংলাদেশের আনসার বাহিনী হচ্ছে একটি সাহায্যকারী বাহিনী এবং সব মিলে একে পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ অক্সিলারি ফোর্স বলা হয়ে থাকে।
এই বিল পাস হলে ব্যাটালিয়ন আনসার বাহিনীর সদস্যরা পুলিশের মতো ক্ষমতার অধিকারী হবেন। এই আইনের খসড়া ২০১৭ সালে প্রস্তাব করা হয়েছিল এবং তাতে পুলিশের মতো তদন্তের ক্ষমতা দেওয়ার জন্য বলা হয়েছিল। কিন্তু তখন তা অগ্রাহ্য করা হয়েছিল এই যুক্তিতে যে তাতে করে কার্যত আনসার বাহিনী পুলিশের সমান্তরাল বাহিনীতে পরিণত হবে। কিন্তু এই আপত্তি এখন আর বিবেচিত হচ্ছে না। ইতিমধ্যে পুলিশের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা তাঁদের ক্ষমতা ও স্বার্থের বিবেচনায় সরকারের কাছে আপত্তি জানিয়েছেন। এই ব্যবস্থার অর্থ হচ্ছে যে সরকার একটি সাহায্যকারী বাহিনীকে (অক্সিলারি ফোর্স) এমন ক্ষমতা প্রদান করল, যা পুলিশের চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়।
অক্সিলারি ফোর্সকে এই ধরনের ক্ষমতা প্রদানের ঘটনা পাকিস্তানি আমলে একবার এবং স্বাধীন বাংলাদেশে ঘটেছিল একবার। ১৯৭১ সালের ২ আগস্ট বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়, ‘পূর্ব পাকিস্তান রাজাকার অর্ডিন্যান্স’ বলে যে আইন প্রণয়ন করা হয়, তাতে আনসার বাহিনী বিলোপ করে রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়েছিল। রাজাকার বাহিনী ১৯৭১ সালের ২ আগস্ট আধা সামরিক বাহিনী হিসেবে কার্যক্রম শুরু করলেও ১৯৭১ সালে ৭ সেপ্টেম্বর এই বাহিনীর সদস্যদের পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর আওতায় নিয়ে আসা হয়।
স্বাধীনতার পরে আধা সামরিক বাহিনী গঠিত হয়েছিল ১৯৭২ সালে। ১৯৭২ সালের ১ মার্চে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ জারি করে রক্ষীবাহিনী তৈরি করা হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের সেনাশাসন জারির পর ৯ অক্টোবর জারি করা অধ্যাদেশে রক্ষীবাহিনী বিলুপ্ত করে এর সদস্যদের সেনাবাহিনীতে আত্তীকরণ করা হয়।
আমরা জানি, এই দুই বাহিনী বাংলাদেশে কী পরিমাণ লুটপাট, নির্যাতন ও অনৈতিকতার সাথে জড়িত হয়েছিল। মূলত স্বৈরাচারীরা এই বাহিনীগুলোকে ক্ষমতা দিয়ে তাদের অবৈধ ক্ষমতা ও তাদের অন্যায়কে টিকিয়ে রাখার জন্য ব্যবহার করে।
শেখ হাসিনাও চাইতেছে, আনসারকে ক্ষমতা দিতে একই সাথে হিউজ পরিমান সাধারণ শিক্ষিত ও অর্ধ-শিক্ষিত মানুষকে সেই ক্ষমতার অংশীদার করে তার অবৈধ ক্ষমতাকে প্রলম্বিত করতে। আনসার নিয়োগের মাধ্যমে ছাত্রলীগের স্থানীয় সন্ত্রাসীদের সন্ত্রাস করার লাইসেন্স দেওয়ার পরিকল্পনা করছে সরকার। তাদের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে মূলত শেখ হাসিনা একটি ভয়ের ও আতঙ্কের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে।
তবে ইতিহাস বলে এই ধরণের আতঙ্ক তৈরি করে যখন স্বৈরাচারীদের আর কোনো অপশন থাকে না। তাদের পায়ের নিচে মাটি থাকে না। এই রেজাকার বাহিনী যেমন ইয়াহিয়া খানকে বাঁচাতে পারে নি তেমনি রক্ষিবাহিনীও শেখ মুজিবকে বাঁচাতে পারেনি। এই আনসাররাও শেখ হাসিনাকে উদ্ধার করতে পারবে না। বরং আনসারদের ক্ষমতা বাড়িয়ে সন্ত্রাসের রাজত্ব করার চেষ্টা করা শেখ হাসিনার পতনকে ত্বরান্বিত করবে।
- রাজনীতি বিশ্লেষক
Discussion about this post