অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
বিচার নিষ্পত্তিতে আদালত প্রাঙ্গণে চলছে ব্যাপক হুড়োহুড়ি। স্বাভাবিক দৃষ্টিতে এটা ভালো মনে হলেও আচরণে ভালো মনে হচ্ছে না। বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রিতা কাটাতে আমরা সবাই চাই। কিন্তু তা যদি হয় শুধু বিরোধী দলীয় নেতাদের বিচার নিষ্পত্তির নামে অভিযুক্ত করা তবে তা খুবই উদ্বেগজনক।
আদালত পাড়ায় হঠাৎ এমন কি ঘটল! সকালে সাক্ষী। দুপুরে সাক্ষী। সাক্ষী গ্রহণ করা হচ্ছে সন্ধ্যা ও রাতে। সাক্ষী তলবে সমন জারি করাটাই আদালতের রীতি। কিন্তু এখন সাক্ষী তলব করা হচ্ছে টেলিফোনে। আগের দিন বিকেল কিংবা সন্ধ্যায় সাক্ষীকে জানিয়ে দেয়া হচ্ছে পরদিন সকালে হাজির থাকতে হবে সাক্ষী দিতে। ঘন ঘন পড়ছে তারিখ। আসামিপক্ষ হাজিরা দিতে দিতে পরিশ্রান্ত।
একই দিন, একই সময় একাধিক মামলার হাজিরা। একটিতে হাজির হওয়া গেলেও অন্যটিতে গর হাজির। এক তারিখে হাজির হতে না পারলেই পুলিশ হাজির হচ্ছে ওয়ারেন্ট নিয়ে! এক ভিন্নরকম কর্মব্যস্ততা এখন আদালত পাড়ায়। ১৫ বছরেও যে নথির ডাক পড়েনি-আধঘণ্টার মধ্যে সেটি পেশ করার নির্দেশ আসছে। নাজির, রেকর্ডকিপার, পেশকার, জারিকারক,স্ট্যানো, টাইপিস্ট, ডেসপ্যাচ রাইডার কারোরই যেন কথা কইবার জো নেই। আইনজীবীরাও হতভম্ব। হঠাৎ কি হলো? উত্তর একটাই। মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির নির্দেশনা রয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে বিচার বিভাগের ওপর আসা এ নির্দেশনা অলিখিত। এ কারণেই দু’মাস ধরে আকস্মিকভাবে তৎপর হয়ে উঠেছে আদালতপাড়া। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে এগুলো শুধুই বিরোধী দলের ওপর রাজনৈতিক নিপীড়নমূলক মামলা।
আদালত সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানাচ্ছে, বিভিন্ন পর্যায়ে বিচারাধীন মামলা প্রায় ৪০ লাখ। এর মধ্যে তিন ভাগের দুই ভাগ মামলার বিচার চলছে নিম্ন আদালতে। দীর্ঘদিন ধরে পুঞ্জিভূত মামলার জট থেকে অদৃশ্য ইশারায় সক্রিয় হয়ে উঠেছে বিশেষ কিছু মামলা। এসব মামলার দ্রুত বিচার যবণিকার দিকে এগিয়ে চলছে। আইনজীবীরা মনে করেন, মামলা নিষ্পত্তিতে গতি আসাটা ইতিবাচক। কিন্তু এই গতিটা প্রয়োজন সব সময়কার জন্য। সেটি না হয়ে হঠাৎ গতিশীল হয়ে ওঠাটা দুরভিসন্ধিমূলক।
তাছাড়া বিচার কার্যক্রম পরিচালনায় তোয়াক্কা করা হচ্ছে না দীর্ঘ চর্চিত রীতিনীতি। বিচার কার্যক্রমে কোনো নিয়মনীতি, রীতিনীতি বা কাস্টমকে অনুসরণ করা হচ্ছে না। অতি উৎসাহী পুলিশ কর্মকর্তারা থাকছেন বিশেষ রকম তৎপর। সাক্ষ্য গ্রহণের পুরো সময় পুলিশের ডিসি, এডিসি (প্রসিকিউশন) কিংবা অধঃস্তন পুলিশ সদস্যরা অবস্থান করছেন এজলাসের ভেতর। সাক্ষীর কথাবার্তা পর্যবেক্ষণ করছেন। গতিবিধি অনুসরণ করছেন আসামিপক্ষের স্বজনদের। ট্রায়াল পর্বের আগে বিশেষ কিছু মামলায় পুলিশ তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করছে যেন তেন প্রকারে। বিশেষত রাজনৈতিক মামলাগুলোতে একসঙ্গে অনেক সাক্ষীর সাক্ষ্য নেয়া হচ্ছে। তদন্তকারী কর্মকর্তার জবানবন্দী নেয়া হচ্ছে সাক্ষ্য গ্রহণের আগেই। সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ‘কোর্ট আওয়ার’ গণ্য করা হয়। কিন্তু এখন কোর্ট চলছে সন্ধ্যার পরও।
অনেক এজলাসে আলো জ্বলে সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত। ওপেন কোর্টে সাক্ষীর জবানবন্দী রেকর্ড না করে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় তা টাইপ করে আদালতে উপস্থাপন করা হচ্ছে। সাক্ষী হাজির করার জন্য পৃথক সমন জারি হচ্ছে না। সাক্ষীদের ডেকে আনা হচ্ছে টেলিফোনে। পছন্দসই সাক্ষ্য না দিলে সেই সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হচ্ছে না। কারাবন্দি আসামিদের কারা কর্তৃপক্ষ হাজির না করলে আসামিদের কারাগার আনা হচ্ছে বিশেষ ব্যবস্থায়। ততক্ষণ পর্যন্ত সাক্ষীদের বসিয়ে রাখা হচ্ছে। আইনজীবীরকে জেরা করার সময় দেয়া হচ্ছে না। কোনো কোনো আসামির আইনজীবীকে সময়সীমা বেধে দেয়া হচ্ছে।
অনিয়ম জবানবন্দি রেকর্ড : মামলার সাক্ষীদের বিশেষ ব্যবস্থায় স্টেনোগ্রাফারদের মাধ্যমে জবানবন্দি টাইপ করা হয়। নিয়ম হচ্ছে উন্মুক্ত আদালতে সাক্ষী জবানবন্দি দেবেন। সেটিই রেকর্ড হবে। এই আলোকে করা হবে জেরা। কিন্তু এসবের ব্যত্যয় ঘটিয়ে চলছে ঢাকার আদালগুলোতে বিচার কার্যক্রম।
রাতেও চলছে এজলাস : উত্তরা পূর্ব থানার মামলা ২৬(১১)১৩। গত ২৬ জুলাই এ মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয় রাত ৯টা পর্যন্ত। ওই দিন ৫ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করে আদালত। এ মামলার পরবর্তী তারিখ রাখা হয় ২৩ আগস্ট। কম সময় তারিখ নির্ধারণ করা হচ্ছে। আগে ২/৩ মাস পরপর তারিখ দেয়া হতো। এখন তারিখ পড়ছে ১৫ দিন পর পর। এ মামলার ৭৭ জন আসামিকেই হাজির হতে হচ্ছে প্রত্যেক তারিখে।
দক্ষিণ খান থানায় দায়েরকৃত মামলা নং-২৯(১১)১৩। গত ১৪ আগস্ট এ মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয় রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত। সাক্ষ্য নেয়া হয় মাত্র দু’জনের। এ সময় হাজির থাকতে হয় ৮২ আসামিকেই। ধার্য তারিখে কারাগার থেকে আসামি হাজির না করায়, সাক্ষীদের বসিয়ে রেখে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় কারাগার থেকে আসামিকে হাজির করা হচ্ছে।
বিশেষ ট্রাইব্যুনালের মামলা নং-৬৭৯/২০১৫ (পল্টন থানা: ৪২(১০)১৩) মামলায় গত ২৪ জুলাই বিশেষ ট্রাইব্যুনাল আদালত-১৩ তে অফিস টাইমের পর সন্ধ্যা পর্যন্ত সাক্ষ্য নেয়া হয়।
খিলগাও থানার ৩০(১১)১৩ নং মামলায় মামলার তদন্ত কর্মকর্তা (আইও)র সাক্ষ্য চলাকালে বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করা হয়। দায়রা কোর্টে মামলা নং-১৩৩২৮/১৭। মতিঝিল থানার ৩৮(১)২২ নং মামলা ও রমনা থানার ২৩(১১)১৩ নং মামলায় অন্যান্য সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণের আগেও তদন্ত কর্মকর্তার জবানবন্দি গ্রহণ করা হয়। কোর্ট প্রাক্টিস অনুযায়ী, তদন্ত কর্মকর্তার জবানবন্দি গ্রহণ করা হয় সবার শেষে।
অভিন্ন আসামি এক সময়ে দুই আদালতে হাজিরা : মতিঝিল থানার ১২(১১)১২ নং মামলায় জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ারের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করা হয়। মামলাটি ৫ নভেম্বর ২০১২ সালের দায়ের করা। একই সময় অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ারের বিরুদ্ধে খুলনার সোনাডাঙ্গা মডেল থানায় মামলায় দায়ের করা হয়। যার নং-৩(১১)১২। একজন ব্যক্তি একই সময় ঢাকা ও খুলনায় অবস্থান করেন কী করে? আদালতে খুলনার মামলার সার্টিফাইড কপি জমা দেয়া হয়। কিন্তু আদালত তা গ্রহণ করেননি।
কারাগারে থেকেও নতুন রাজনৈতিক মামলায় আসামি : জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান দুই বছর ধরে কারাবন্দি। ২০২১ সালের ৭ সেপ্টেম্বর গ্রেফতার হন তিনি। সেই থেকে তিনি কারাগারে। ২০২৩ সালের ১৪ জানুয়ারি ঘটনার তারিখ উল্লেখ করে কলাবাগান থানায় একটি মামলা [নং-৭(১)২৩] হয়। গত ২৩ মার্চ এ মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়। মহানগর হাকিম আদালতে পুলিশ তাকে গ্রেফতার দেখানোর আবেদন দেয়।
বিশেষ তৎরপতায় পুলিশ :
ডিসি প্রসিকিউশন ও এডিসি প্রসিকিউশন সাক্ষ্য চলাকালে কোর্টে অবস্থান করে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন। বিশেষ বিশেষ মামলায় থাকলে তাদের ‘আমলনামা’ ভারী হয়-মর্মে আদালত অঙ্গনে আলোচনা রয়েছে। পুলিশ আদালতে বিশেষ এই নজরদারি বাড়িয়েছে সরকারি নির্দেশনার পরপরই।
সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে রাজনৈতিক সহিংসতার অভিযোগে হওয়া শতাধিক মামলার তদন্ত দ্রুত নিষ্পত্তি করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তদন্ত শেষে যেসব মামলার চার্জশিট হয়েছে সেগুলো পর্যবেক্ষণে রয়েছে। মামলাগুলোর বিচার প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করারও দায়িত্ব দেয়া হয়েছে মনিটরিং কমিটিকে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন ঠেকানোর জন্য সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় করা মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি এবং স্থগিত মামলা সচলেরও নির্দেশনা দেয়া হয় সংশ্লিষ্টদের।
সরকারি নির্দেশনার পরপরই রাজনৈতিক মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি মামলার রায় দেয়া হয়েছে। ২০০৭ সালের অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলায় ২ আগস্ট তারেক রহমান ও তার স্ত্রী ডা. জোবায়দা রহমানকে যথাক্রমে ৬ বছর ও ৩ বছর কারাদ- দিয়েছেন ঢাকার জজ আদালত। চার্জ গঠনের মাত্র ৩৪ দিনের মধ্যেই রায় হয় এ মামলার। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে করা দু’টি দুর্নীতির মামলায় বিএনপির সাবেক প্রতিমন্ত্রী ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু এবং আমান উল্লাহ আমানকে বিচারিক আদালতের দেয়া কারাদ- গত ৩০ মে বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট। এ মামলায় গত ১০ সেপ্টেম্বর কারাগারে পাঠানো হয় আমান উল্লাহ আমান ও তার স্ত্রী সাবেরা আমানকে।
এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়কে অপহরণ করে হত্যার ষড়যন্ত্রের মামলায় গত ১৭ আগস্ট প্রবাসী সাংবাদিক শফিক রেহমান, মাহমুদুর রহমানসহ ৫ জনকে পৃথক দু’টি ধারায় ৭ বছর করে কারাদ- দেয়া হয়েছে। এদিকে নোবেল বিজয়ী একমাত্র বাংলাদেশি ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে শ্রম আইনের দেয়া মামলাটি দ্রুত এগিয়ে চলছে যবণিকার দিকে।
আদালতেই কাটছে সময় নেতা-কর্মীদের : গায়েবি মামলা। জামিন। নিয়মিত হাজিরা। একেকজনের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ চারশ’ পর্যন্ত মামলা। কারও বিরুদ্ধে ৫০, কারও বিরুদ্ধে ১০০ মামলা। ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাদের বিরুদ্ধে ও অর্ধশতাধিক মামলা। রাজপথের বিরোধীদল বিএনপির দাবি, গত দেড় দশকে বিএনপির ৪০ লাখ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়েছে। এসব মামলায় অনেক নেতাকর্মীকে মাসের কর্মদিবসের প্রায় সবদিনই থাকতে হচ্ছে আদালতের বারান্দায়। কারাগার এবং কোর্ট-কাচারি যেন তাদের বাড়িঘর। কোনো না কোনো মামলায় প্রায় প্রতিদিনই হাজির থাকতে হচ্ছে আদালতে। হাজিরা দিয়ে গভীর রাতে বাসায় ফিরছেন। কেউ কেউ আদালত থেকে কারাগারে যাচ্ছেন। পুরোনো মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হচ্ছে। পরের দিন সকালেই অন্য মামলায় হাজিরার জন্য তাকে তোলা হচ্ছে আদালতে। প্রতিদিন ঢাকাসহ সারা দেশের বিভিন্ন আদালতে এখন বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের ভিড়। এদের মধ্যে কেউ কেউ দিনে একটি-দু’টি নয়, ৮ থেকে ১০ মামলার হাজিরা দিচ্ছেন।
৩০ বছরেও এমনটি দেখিনি : ঢাকা বারের সিনিয়র অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান বলেন, নেতাদের মাসে প্রায় সব কর্মদিবসেই হাজির থাকতে হচ্ছে। দৈনিক ৮ থেকে ১০টি মামলার শুনানি থাকায় সকাল-সন্ধ্যা আদালতেই কাটাতে হচ্ছে।
ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট এস এম কামালউদ্দিন বলেন, ৩০ বছরের আইন পেশার জীবনে এ পরিস্থিতি আদালত পাড়ায় দেখিনি। সাধারণত দ্রুত বিচার ও বিশেষ আদালতের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হয়। সন্ত্রাস বিরোধী ট্রাইব্যুনালেও মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হতে পারে। কিন্তু সাধারণ আদালত, সিএমএম কোর্টেও এখন তারিখ পড়ছে দুই সপ্তাহ পর পর। তিনি বলেন, বিধান হচ্ছে, সাক্ষীকে আদালতে আনতে হবে সমন জারির (প্রসেস) মাধ্যমে। সেই সাক্ষী সমন হাতে নিয়ে আসবেন সাক্ষী দিতে। এখন সেটি হচ্ছে না। পুলিশ সরাসরি টেলিফোন করছেন সাক্ষীকে। আগের দিন জানাচ্ছেন পরের দিন সাক্ষ্য প্রদানের খবর। এতে সাক্ষী প্রস্তুতি গ্রহণের সময় পান না। সাক্ষী হাজির হলেও কোনো মামলায় তিনি সাক্ষী দিতে হাজির হয়েছেন সেই সমন দেখাতে পারেন না। মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির নামে যা চলছে তা আইনের শাসন ও ন্যায় বিচারের পরিপন্থি। এটি কি তাহলে ‘ক্যাঙ্গারু কোর্ট’? এমনটিতো চলতে পারে না।
- দৈনিক ইনকিলাব থেকে সংগৃহীত
Discussion about this post