ডেভিড বার্গম্যান
বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব নিয়ে সচরাচর যে আলোচনা হয় তাতে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য যোগ করেছে সম্প্রতি প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন। এ বছরের শুরুর দিকে “হু ওউনস দা মিডিয়া ইন বাংলাদেশ” (বাংলাদেশে গণমাধ্যমের মালিক কারা) শিরোনামের প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে বাংলাদেশের অলাভজনক স্বায়ত্তশাসিত থিংক ট্যাঙ্ক সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজ। গবেষণাটি কেন্দ্র করে একটি উন্নত ওয়েবসাইটও রয়েছে। দেশের টিভি স্টেশন ও খবরের কাগজগুলোর মালিকানা নিয়ে করা এই মানসম্পন্ন গবেষণা খুব একটা গুরুত্বের সাথে প্রচারিত হয়নি দেশের গণমাধ্যমগুলোতে।
গণমাধ্যমে পক্ষপাতিত্বের আলোচনা বেশিরভাগ সময় ছাপা মাধ্যমকে ঘিরে হয়ে থাকলেও বেশিরভাগ মানুষ খবরের কাগজের তুলনায় টিভি চ্যানেল অনেক বেশি দেখে থাকে। একটি সাম্প্রতিক সমীক্ষা অনুযায়ী বাংলাদেশিদের মাঝে ৬৮% খবর জেনে থাকেন টিভি থেকে। কেবল ২% পত্রিকা থেকে, ৪% ইন্টারনেট থেকে এবং ৪% সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে খবর জানেন!
সরকারি মালিকানাধীন বিটিভি বাদে দেশে এই মুহূর্তে ৩০ টি চলমান টিভি চ্যানেল রয়েছে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ক্ষমতায় থাকাকালীন — ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল — এই ৩০ টির মাঝে ৫ টি চ্যানেল “অনাপত্তি সনদ” পায় (যমুনা, বৈশাখী, বাংলা ভিশন, আরটিভি, এবং দেশ টিভি)। এর ফলে তারা টিভি চ্যানেল পরিচালনার অনুমোদন পায়। বাকি ২৫ টি চ্যানেল অনাপত্তি সনদ পায় ২০০৯ থেকে ২০১৩ সালে, আওয়ামী লীগের আমলে। এরপর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ আরো ১৫ টি টিভি চ্যানেলের জন্য অনাপত্তি সনদ প্রদান করে। কিন্তু এই ১৫ টি চ্যানেলের ফ্রিকোয়েন্সি হয় এখনো অনুমোদিত হয়নি বা তারা ফ্রিকোয়েন্সি পেলেও সম্প্রচার শুরু করেনি।
অনাপত্তি সনদ এবং সম্প্রচারের লাইসেন্স বাংলাদেশে দেয়া হয় রাজনৈতিক বিবেচনার ভিত্তিতে — যে দলই ক্ষমতায় থাকুক, ক্ষমতাসীন দলের নিজস্ব বা কাছের লোকেরাই এই অনুমোদন পেয়ে থাকে। উল্লেখ্য যে, প্রাথমিকভাবে যারা অনাপত্তি সনদ/লাইসেন্স যোগাড় করেছিলেন তাদের অনেকেই একে লোভনীয় সম্পত্তি হিসেবে বিবেচনা করেছেন, যেহেতু বিশাল অংকের বিনিময়ে এই লাইসেন্স বিক্রি করার সুযোগ থাকে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে ৩০ টি চ্যানেলের মধ্যে ৩ টির ক্ষেত্রে কেবল সম্পূর্ণ মালিকানা এখনো মূল লাইসেন্স গ্রহণকারীদের হাতে রয়েছে — চ্যানেল ২৪ (হা-মীম গ্রুপ), মাছরাঙ্গা টিভি (স্কয়ার গ্রুপ), এবং গাজী টিভি (গাজী গ্রুপ)।
সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজের প্রতিবেদনে এই ৩০ টি টিভি চ্যানেলের মধ্যে বেশির ভাগের মালিকানার বিস্তারিত তথ্য এসেছে। এর থেকে দুটি বিষয় খুব স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে।
প্রথমত, প্রায় সব টিভি চ্যানেলের মালিকানাধারি কোম্পানিগুলো মিডিয়ার বাইরেও বিশাল বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডে জড়িত। এদের মালিকানা বিভিন্ন বৃহৎ কর্পোরেশনের হাতে, যাদের বিভিন্ন বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে বিস্তৃত আধিপত্য রয়েছে। অনেক সংবাদের বিষয় বস্তুই বিভিন্ন বাণিজ্যিক খাতের সাথে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে যুক্ত। এসব বাণিজ্যিক খাতে টিভির মালিকানাধীন কর্পোরেশন গুলোর অর্থনৈতিক স্বার্থ স্পষ্টভাবে জড়িত। এক্ষেত্রে চ্যানেলগুলো কিভাবে স্বাধীনভাবে সেসব সংবাদ উপস্থাপন করতে পারে এই প্রশ্ন স্বাভাবিক কারণেই চলে আসে। এ বিষয়ে বিস্তারিত ভিন্ন আরেকটি লেখা আমি পরবর্তীতে প্রকাশ করবো।
দ্বিতীয়ত — এবং এ কলামে মূলত যে বিষয়ে আলোকপাত করা উদ্দেশ্য — উল্লেখযোগ্য সংখ্যক টিভি চ্যানেল, প্রায় এক তৃতীয়াংশের সম্পূর্ণ বা আংশিক মালিকানা হলো আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের।
এগুলো হলো:
জিটিভি
গাজী স্যাটেলাইট টেলিভিশন লিমিটেড দ্বারা পরিচালিত এই চ্যানেলটির মালিকানা গাজী গ্রুপ অফ কোম্পানির, যার মালিক বস্ত্র ও পাট মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী এবং তার পরিবার। আওয়ামী লীগ সাংসদ সাবের হোসেন চৌধুরীও গাজী স্যাটেলাইট টেলিভিশন লিমিটেডের একজন পরিচালক। এছাড়াও এই গ্রুপ দৈনিক সারাবাংলা পত্রিকারও মালিক।
আরটিভি
আওয়ামী লীগের সাংসদ মোরশেদ আলম ও তার পরিবারের মালিকানাধীন বেঙ্গল গ্রুপ এর অন্তর্ভুক্ত বেঙ্গল মিডিয়া কর্পোরেশন। বেঙ্গল মিডিয়া কর্পোরেশনের মালিকানায় পরিচালিত হয় আরটিভি। (একই কোম্পানি ‘চ্যানেল ৫২’ এরও স্বত্বাধিকারী, কিন্তু তারা লাইসেন্স পেলেও ফ্রিকুয়েন্সি এখনো পায়নি, প্রতিবেদনে বলা হয়েছে)।
মোহনা টিভি
মোহনা টেলিভিশন লিমিটেড দ্বারা পরিচালিত মোহনা টিভির মালিক আওয়ামী লীগের সাংসদ কামাল আহমেদ মজুমদার। আওয়ামী লীগ সাংসদ হামিদা বানুও টিভির সত্ত্বাধিকারী কোম্পানির একজন পরিচালক।
দুরন্ত টিভি
দুরন্ত টিভির স্বত্বাধিকারী কোম্পানি বারিন্দ মিডিয়া লিমিটেড রেনেসাঁ গ্রুপের কোম্পানি গুলোর একটি। এই গ্রুপের বেশিরভাগের মালিকানা আওয়ামী লীগের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম এবং তার পরিবারের।
দেশ টিভি
দেশ টিভির মালিক মিডিয়াসিন লিমিটেড। এই কোম্পানি কর্ণফুলী গ্রুপের অধীন, যার মালিক আওয়ামী লীগ সাংসদ সাবের হোসেন চৌধুরী ও তার পরিবার। আওয়ামী লীগের সাংসদ ও মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীও মিডিয়াসিন লিমিটেডের একজন পরিচালক। (নথি পত্রে দেখ যায় যে আওয়ামী লীগের সৈয়দ আবুল হোসেন এবং আসাদুজ্জামান নূরও ২০১৫ সালে এই কোম্পানির পরিচালক হিসেবে ছিলেন।)
কর্ণফুলী গ্রুপের মালিকানায় ভোরের কাগজ সংবাদপত্রটিও রয়েছে।
আইটিভি
আইটিভি পরিচালনা করে বেক্সিমকো মিডিয়া লিমিটেড, যা বেক্সিমকো গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান। বেক্সিমকো গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ করেন আওয়ামী লীগের সাংসদ ও প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এবং তার পরিবারের অন্যান্য ব্যক্তিবর্গ। দি ইন্ডিপেন্ডেন্ট পত্রিকাও বেক্সিমকো গ্রুপের মালিকানাধীন।
ডিবিসি নিউজ
এই টিভি চ্যানেল পরিচালনা করে ঢাকা বাংলা মিডিয়া এন্ড কমিউনিকেশন লিমিটেড, যার চেয়ারম্যান প্রধানমন্ত্রীর সাবেক উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী। স্বতন্ত্র সাংসদ ইউসুফ আব্দুল্লাহ হারুন এই কোম্পানির একজন পরিচালক। ইকবাল সোবহান চৌধুরী দি ডেইলি অবজারভারেরও সম্পাদক।
এই চ্যানেল গুলো ছাড়াও নিম্নোক্ত চ্যানেলগুলোর নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে আওয়ামী লীগের সাথে:
একাত্তর টিভি
একাত্তরের যৌথ মালিকানা মেঘনা গ্রুপ এবং মোজাম্মেল বাবু ও তার পরিবারের। বাবু আওয়ামী লীগের কোন আনুষ্ঠানিক পদে না থাকলেও আওয়ামী লীগের অবস্থানের পক্ষে কথা বলেন।
সময় টিভি
সময় টিভি চালায় সময় মিডিয়া লিমিটেড, যার মালিকানায় আছে যৌথ ভাবে সিটি গ্রুপ নামের বৃহৎ কনগ্লমোরেট এবং মোরশেদুল ইসলাম, যিনি সাবেক আওয়ামী লীগ খাদ্য মন্ত্রী এডভোকেট কামরুল ইসলামের ভাই।
নাগরিক টিভি
মোহাম্মাদি গ্রুপের অঙ্গ কোম্পানি জাদু মিডিয়া লিমিটেড নাগরিক টিভির মালিক। মোহাম্মাদি গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আওয়ামী লীগের সাবেক ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন মেয়র আনিসুল হক। ২০১৭ তে আনিসুল হকের মৃত্যুর পর মোহাম্মাদি গ্রুপের মূল মালিকানা চলে আসে তার স্ত্রী রুবানা হক এবং পরিবারের হাতে।
এছাড়া একটি টিভি চ্যানেল রয়েছে যা মালিকানা সূত্রে সরাসরি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের সাথে সম্পৃক্ত।
এনটিভি
এনটিভি চালান সাবেক বিএনপি সাংসদ মোহাম্মদ মোসাদ্দেক আলি ফালু।
উল্লেখিত চ্যানেলগুলো বাদে আর যেসব টিভি চ্যানেল রয়েছে, তাদের সাথে আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকার জোরালো সম্ভাবনা থাকলেও তা উল্লেখিত চ্যানেলগুলোর মতো প্রকাশ্য না। কিন্তু সম্ভাব্য অপ্রকাশিত সম্পর্ক বিবেচনায় না নিলেও, মোট টিভি চ্যানেলের এক তৃতীয়াংশই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত থাকাটা বাংলাদেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য উদ্বেগের কারণ।
লেখক: ব্রিটেন-ভিত্তিক সাংবাদিক — নেত্র নিউজের ইংরেজি বিভাগের সম্পাদক।
Discussion about this post