ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগের আমলে কোনোভাবেই নারীর প্রতি সহিংসতা কমছে না। বরং দিন দিন তা বেড়েই চলেছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেই দলটির ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা বেপরোয়া হয়ে উঠে। তাদের হাত থেকে তখন স্কুলছাত্রী থেকে শুরু করে গৃহবধু কেউ আর নিরাপদ থাকে না। সর্বশেষ সিলেটের এমসি কলেজে স্বামীকে বেঁধে রেখে স্ত্রীকে ধর্ষণ করেছে ছাত্রলীগের একদল নরপশু। সারাদেশ তোলপাড় হয়ে গেছে এই ন্যাক্কারজনক ঘটনায়। অথচ পরিচিত নারীবাদী মুখ গুলোকে কোথায়ও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সর্বদাই দেখা গেছে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ বা আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠনের কেউ নারী নির্যাতনে জড়িত থাকলে রহস্যজনক কারণে একদমই চুপ হয়ে যান তথাকথিত এসব নারীবাদী নেত্রীরা।
বাংলাদেশের নারীবাদীদের এরকম দ্বিমুখি আচরণের নেপথ্যে আসলে কি? তা নিয়ে প্রতিবেদন তুলে ধরেছেন আমারদেশ পত্রিকা। পাঠকদের সুবিধার্থে আমার দেশের প্রতিবেদনটি তুলো ধরা হলো:
পশ্চিমাদের কাছ থেকে বিপুল অর্থ এনে এই নারীবাদী নেত্রীরা এনজিওগুলোকে এক ধরনের নিজেদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান বানিয়ে ফেলেছেন। অথচ আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্যদল ক্ষমতায় থাকলে সেই সময় নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটলে অথবা ভিন্নমতের কারো বিরুদ্ধে নারীর প্রতি কোন অসৎ ব্যবহারের অভিযোগ উঠলে এরা সরব হয়ে উঠেন।
পশ্চিমা টাকায় নিজেদের এনজিওকে আওয়ামীকরণ করে মূলত তাদের সুবিধামতো ঘটনায় আন্দোলনে ফেটে পড়েন। যেমনটা ঘটেছিলো ১৯৯৫ সালে ইয়াসমিন হত্যাকাণ্ডে বা ২০১৮ সালে এক নারী সাংবাদিক সম্পর্কে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের বিতর্কিত মন্তব্যের ঘটনায়।
- নারীবাদীদের ‘ইয়াসমিন দিবস’ পালন, অথচ সীমা চৌধুরীকে ভুলেছে ওরা
১৯৯৫ সালের ২৪ আগস্টের ঘটনা। ঢাকা থেকে দিনাজপুরে বাড়িতে ফেরার পথে কতিপয় পুলিশ সদস্য কর্তৃক ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হন কিশোরী ইয়াসমিন। ক্ষুব্ধ জনতা প্রতিবাদ করলে গুলি চালায় পুলিশ। এতে নিহত হন পাঁচজন।পরে জড়িত তিন পুলিশ সদস্যের ফাঁসির রায় হয় ১৯৯৭ সালের ৩১ আগস্ট। ২০০৪ সালে সেপ্টেম্বর মাসে রায় কার্যকর হয়। ইয়ামিনের ঘটনায় পশ্চিমা অর্থপুষ্ট নারী সংগঠন গুলো অপরাধীদের ফাঁসি কার্যকর পর্যন্ত সক্রিয় থেকেছেন।
এ ঘটনাকে পুঁজি করে আওয়ামী লীগের আশ্রয়ে বেড়ে ওঠা এনজিওগুলো এ দিনটিকে ‘ইয়াসমিন ট্র্যাজেডি দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছে। কারণ এই ট্র্যাজেডিকে ব্যবহার করে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে পেরেছে।
অথচ ইয়াসমিনের ঘটনার এক বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ শাসনামলে চট্টগ্রামে ঘটে একই ধরণের আরেক বর্বর ঘটনা। বন্ধুর সঙ্গে চট্টগ্রামের রাউজানে সন্ধ্যায় পথে হাঁটছিল সীমা চৌধুরী নামের এক কিশোরী। রাউজান থানার পুলিশ তাকে ধরে থানায় নিয়ে যায়। এরপর তিনজন পুলিশ সদস্য মিলে তাঁকে ধর্ষণ করে। যেহেতু সীমা চৌধুরী ওই সময় অপ্রাপ্তবয়স্ক, রাষ্ট্র তাকে ‘নিরাপত্তা হেফাজতে’ নিয়েছিল। ১৯৯৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম জেলা কারাগারের ‘নিরাপদ হেফাজতে’ সীমার মৃত্যু হয়।
সীমা চৌধুরী নামের সেই কিশোরীর কথা কি নারীবাদী সংগঠনগুলো আর তাদের নেত্রীদের মনে আছে?
না, তারা সেই দিনটিকে মনে করতে চান না। কারণ ঘটনাটি ঘটেছিলো আওয়ামী লীগের আমলে। এ ঘটনায় বালুতে মুখ গুঁজে নিজেদের মুখ লুকিয়ে রেখেছেন তথাকথিত নারীবাদীরা। দীর্ঘ ২৪ বছর পরেও সেই মামলার সুরাহা হয়নি।
যখন কোনো অওয়ামী পুলিশ সদস্য বা ছাত্রলীগের কেউ অপকর্ম করেন,তখন প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা মুখস্ত বুলি আওড়াতে থাকেন -“ব্যক্তির দায় ব্যক্তি নেবে”, সংগঠন বা সংস্থা নেবে না।
অথচ ইয়াসমিনের ঘটনায় অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের সাজা কার্যকর হওয়ার পরও, এসব নারী সংগঠন ও পক্ষপাতদুষ্ট নারী নেত্রীরা ঘটা করে দিবসটি পালন করেন। দিবসটি পালন করতে খরচ করেন বিদেশ থেকে আনা কাড়ি কাড়ি টাকা।
- মানিকে চুপ, মঈনুলে হট্টগোল
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতা মানিকের কথা মনে আছে? ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ধর্ষণে সেঞ্চুরি পালন করে আলোচিত হয়েছিল মানিক। ধর্ষণে সেঞ্চুরির পর শাস্তির বদলে তখনকার আওয়ামী লীগ সরকার তাকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরী দিয়ে পুরস্কৃত করেছিলো।
সেই সিরিয়াল ধর্ষকের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীরা ফুঁসে উঠলেও, আওয়ামী লীগকে নাখোশ করতে খুব বেশি সাহস দেখান নি নারী নেত্রীরা। তখন রাজপথে তাদের সরব উপস্থিতি তেমন দেখা যায় নি। অথচ বছর দুয়েক আগে, প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেনের ক্ষেত্রে ঘটেছে ঠিক উল্টো ঘটনা।
২০১৮ সালের শেষ প্রান্তে একটি টকশো’তে ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন এক নারীর প্রশ্নের জবাবে শুধু বলেছিলেন আপনি অসভ্য। এতেই নারীদের ইজ্জত গেল বলে শুরু হয়েছিল হৈ চৈ। তাঁর বিরুদ্ধে সারাদেশে ঠুকে দেয়া হয়েছিল অনেক মামলা। জেলেও যেতে হয়েছে তাঁকে। এমনকি আদালতের মধ্যে তাঁকে জুতা মারার চেষ্টাও করা হয়েছে তখন। ব্যারিস্টার মঈনুল হোসেন এর বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলনও করেছিলেন নারী নেত্রীরা। যাতে উপস্থিত ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর, চিকিৎসক নুজহাত চৌধুরী এবং সাংবাদিক মুন্নী সাহাসহ অন্যরা। অথচ, এখন ছাত্রলীগ গণধর্ষণ করেছে এক তরুণীকে। তাও আবার ওই তরুণীর স্বামীকে বেঁধে রেখে। তারপরও কথিত চেতনাধারী নারীবাদীদের দেখা মিলছে না।
- ছাত্রলীগ ধর্ষণ করলেই গর্তে লুকিয়ে পড়ে নারীবাদীরা!
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মানিকের পথ ধরেই ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা ধর্ষণকে নিজেদের জন্য জায়েজ কর্ম মনে করেই চালিয়ে যাচ্ছেন। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত সারা দেশে ৮৮৯টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে এবং ১৯২ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। এই আট মাসে ধর্ষণের শিকার হয়ে মারা গেছেন ৪১ জন নারী আর ৯ জন নারী ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর আত্মহত্যা করেছেন।
সাতক্ষীরা থেকে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা এক রোগীকে রক্ত জোগাড় করে দেওয়ার কথা বলে তার স্ত্রীকে ধর্ষণ, মেসের রুমের টাইলস পরিষ্কার করার কথা বলে কেরানীগঞ্জে নারীকে ধর্ষণ, খাগড়াছড়িতে ডাকাতি করতে ঘরে ঢুকে এক প্রতিবন্ধী তরুণীকে দলবেঁধে ধর্ষণ, খাগড়াছড়িতে চাকমা সম্প্রদায়ের এক নারীকে ধর্ষণের মতো বেশ কয়েকটি আলোচিত ঘটনা ঘটেছে চলতি মাসে। এরপরই ঘটেছে সিলেটের এমসি কলেজে নারী নির্যাতন। এসকল নির্যাতনে বেশিরভাগই সংঘটিত হয়েছে সরকারদলীয় কর্মীদের দ্বারা। অথচ বিভিন্ন সময় আওয়ামী লীগের প্রয়োজনে জেগে ওঠা নারী নেত্রীরা সিলেটের এমসি কলেজের বর্বর ঘটনা সহ সারা বছর বিভিন্ন ধর্ষণের ঘটনায় ঘাপটি মেরে আছেন।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়েশা খানম, অ্যাকশন এইড-বাংলাদেশ এর কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবীর, আইন বিচার ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক প্রধান নির্বাহী সুলতানা কামাল চক্রবর্তী, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা মালেকা বেগম, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন এর শাহীন আনাম, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবং গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুী, সাংবাদিক মুন্নিসাহা, আইনজীবী তানিয়া আমীরসহ এসব তথাকথিত চেতনাধারী নারী নেত্রীরা ‘সিলেকটিভ নারীবাদে’ বিশ্বাসী। সেইজন্যই আওয়ামী লীগের ধর্ষকদের নারী নির্যাতনে এরা আড়ালে থাকেন।
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনে ধানের শীষে ভোট দেয়ায় নোয়াখালী সুবর্ণচরে এক নারীকে গণধর্ষণ করা হয়েছিল। স্থানীয় আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ মিলে ওই নারীর স্বামী- সন্তানের সামনেই তাঁকে ধর্ষণ করার ঘটনা বেশ আলোচিত হয় তখন।
বিবিসিসহ আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় উঠে আসে এ ধর্ষণের ঘটনা। ২০১৯ সালের ৩ জানুয়ারি বিবিসি বাংলার অনলাইনে-‘ধানের শীষে ভোট দেয়ায় গণধর্ষণ’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রচারিত হয়। এ সংবাদে উল্লেখ করা হয়, ৩০ ডিসেম্বর রাত সাড়ে ১২টায় ৯জন মিলে স্বামী ও সন্তানকে মুখ বেঁধে ঘরে আটকে রেখে ওই নারীকে বাইরে নিয়ে গণধর্ষণ করেছে। ধানের শীষে ভোট দেয়ার অপরাধে ২০১৯ সালে আওয়ামী লীগ গণধর্ষণের মাধ্যমে নতুন বছরের নতুন সরকারের যাত্রা শুরু করেছিল। অথচ নির্মম এই ঘটনায়ও মুখে কুলুপ এঁটে বসেছিলেন তথাকথিত চেতনাধারী এসব নারী নেত্রী।
- সিলেক্টিব মানবাধিকার
জাতিসংঘে এশিয়ান লিগ্যাল রিসোর্স সেন্টারের মেইন রিপ্রেজেন্টেটিভ মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান বলেন, যেকোনো মানবাধিকার কর্মী ও সংগঠনের দায়িত্ব এই ধরণের ঘটনার প্রতিবাদ ও ন্যায়বিচারের দাবিতে সোচ্চার ভূমিকা পালন করা। তিনি বলেন, লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো নারীর অধিকার রক্ষায় নিয়োজিত সংগঠনগুলোর দুয়েকটি বাদে বাকীদের ভূমিকা ইয়াসমিনের ঘটনায় যতোটা সোচ্চার ছিলো,সীমা চৌধুরীর ক্ষেত্রে ততোটা ছিলো না।
দেশের মানুষ হয়তো লক্ষ্য করে থাকবেন যে, ২০০৯ সালের পর থেকে একাদিক্রমে ১২ বছর আওয়ামী লীগ সরকারে থাকা অবস্থায় নারী গুম হওয়ার মতো ঘটনা ঘটলেও বাংলাদেশের নারী অধিকার সংগঠনের পক্ষ থেকে দৃশ্যমান কোনো প্রতিবাদ অনুষ্ঠিত হয়নি।
এমন অনেক উদাহরণ দেয়া যাবে যার মাধ্যমে এই গোষ্ঠী প্রমাণ করেছেন যে, তারা আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য বিব্রতকর হতে পারে এমন কর্মকাণ্ড তা- যতো গুরুতর মানবাধিকার লংঘনের ঘটনাই হোক না কেন সেটা থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করতে আগ্রহী। পাশাপাশি, আওয়ামী লীগ সরকারে থাকা অবস্থায় সরকারের প্রতিপক্ষ হিসেবে চিহ্নিত কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কোনো ত্রুটি তাদের দৃষ্টি গোচর হলে তখন কিন্তু তারা প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠেন।
সত্যটা হচ্ছে, মানবাধিকার সার্বজনীন। এখানে সিলেক্টিভ প্রতিক্রিয়া দেখানোর কোন সুযোগ নাই। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আওয়ামী লীগের প্রতি দুর্বল কথিত মানবাধিকার কর্মীরা তাদের পছন্দের রাজনৈতিক দলের ক্ষমতার আস্বাদনকে মসৃণ করার উদ্দেশ্যে ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাতেও নীরব থেকে মানুষের অধিকার রক্ষার লড়াই দূর্বল করে দিচ্ছেন। তারা আইনের শাসন ও জবাবদিহিতামূলক গণতন্ত্রায়নের পথ ইতোমধ্যেই রুদ্ধ করে দিয়েছেন।
বাংলাদেশের মানবাধিকার, নারীর অধিকার, শিশুর অধিকার, বা ধর্মীয় ও নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ে কর্মরত সংগঠনগুলোর প্রায় সবাই বেসরকারী স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বা এনজিও কাঠামো ভিত্তিক। দেশী ও বিদেশী অনুদান নির্ভর অর্থায়ন থেকে তাদের যাবতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। দেশের ভুক্তভোগী নাগরিকদের উচিৎ জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য যে সব উৎস থেকে অর্থায়ন হয়, সেই সব উৎসে অনুদানের অর্থের সদ্ব্যবহার সংক্রান্ত প্রশ্ন করা। বিদেশ থেকে অর্থ এনে দলবাজ নারী নেত্রীদের এই আওয়ামী তোষণ নীতির প্রতিবাদে জনগণকে সোচ্চার হতে হবে।
আরো পড়ুন: ক্ষমতার তুফান : নারীবাদীদের নীরবতা