অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র ও সমাজ চিন্তা সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি কী এ নিয়ে পাশ্চাত্য প্রভাবিত সমাজে নানা ধরনের বিভ্রান্তি রয়েছে। এই বিভ্রান্তি ইউরোপ-আমেরিকার অমুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে পাশ্চাত্য প্রভাবিত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতেও। এ বিভ্রান্তির কেন্দ্রবিন্দুতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে যার শীর্ষে রয়েছে- প্রথমত, ইসলামী রাষ্ট্র ও সমাজে বহু ধর্ম, বহু সংস্কৃতি, বহু মত ও দৃষ্টিভঙ্গি চর্চার অবকাশ কতটা রয়েছে সে বিষয়। দ্বিতীয়ত, আধুনিক গণতন্ত্রে সর্বজনীন ভোটাধিকারভিত্তিক যে গণপ্রতিনিধিত্বের চর্চা রয়েছে সেটি ইসলামী রাষ্ট্রচিন্তায় কতটা বিন্যাস বা প্রয়োগযোগ্য। তৃতীয়ত, হিজাব বা পর্দার মতো যেসব ধর্মীয় বিধান ইসলামের জীবন প্রণালীতে রয়েছে তা অমুসলিম তথা পাশ্চাত্য সমাজে কতটা চর্চার অবকাশ রয়েছে। চতুর্থত, হুদুদ বা ব্যভিচারের মৃত্যুদণ্ডের মতো যে শাস্তি রয়েছে তা এখনকার সময়ে কতটা প্রয়োগযোগ্য। পঞ্চমত, অমুসলিমদের ওপর জিজিয়া করের মতো যে বিধান রয়েছে তা এখনকার মুসলিম দেশগুলোয় প্রয়োগযোগ্য কি না। এর বাইরেও ইসলামের যে খেলাফত ব্যবস্থা একসময় বিদ্যমান ছিল তার বাস্তবায়ন এখনকার সমাজে কিভাবে হবে অথবা রাজতন্ত্র বা অন্য কোনো শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হবে, মুসলিম সমাজ রাষ্ট্র বা দলে নারী নেতৃত্ব গ্রহণযোগ্য কিনা, ইসলামী দলগুলো সাধারণ দলগুলোর সাথে রাজনৈতিক জোট করতে পারবে কি না- এসব বিষয়ে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে বিতর্ক রয়েছে। এসব ইস্যু নিয়ে ধর্মতাত্ত্বিক আলোচনার পাশাপাশি সাধারণ চিন্তাবিদ ও গবেষকরাও নানাভাবে অবদান রাখছেন।
উপরে যেসব ইস্যুর কথা বলা হয়েছে আধুনিক সমাজে এসব বিতর্কের বিষয় একেবারে নতুন নয়। তবে এসব বিষয় নতুন করে আলোচনায় আসছে কমিউনিজমের আদর্শগত পতন বা বিপর্যয়ের পর ইসলামের আদর্শবাদী ধারা যেটাকে পাশ্চাত্য ‘পলিটিক্যাল ইসলাম’ হিসেবে চিহ্নিত করে থাকে তার উত্থানের কারণে। ইসলামের আবির্ভাবের পর গত ১৫ শ’ বছরের ইতিহাসে মুসলিম জনগোষ্ঠী বিভিন্ন পর্ব পার করেছে। এর মধ্যে ‘বিশুদ্ধ ইসলামের চর্চাকাল’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় হজরত মুহাম্মদ সা: এবং তাঁর পরবর্তী চার খলিফা হজরত আবু বকর রা:, হজরত উমর রা:, হজরত ওসমান রা: ও হজরত আলী রা:-এর শাসনকালকে। ইসলামী সাম্রাজ্যের মূল বিস্তৃতি ও আদর্শিক সম্প্রসারণ হয়েছিল এ সময়। এরপর উমাইয়া, আব্বাসীয় ও উসমানীয় খেলাফত মুসলিম বিশ্বকে শাসন করেছে। এর বাইরেও মুসলিম বিশ্বের কোনো কোনো অঞ্চলে খেলাফত প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
খেলাফতের রাজতান্ত্রিক ধারা শুরু হওয়ার পর্বগুলোতেও ইসলামের আদর্শগত সম্প্রসারণ এবং রাষ্ট্রের সীমানা বিস্তৃত হয়েছে। ইসলামের প্রচার প্রসার সাহাবা, তাবেইন, তাবে-তাবেইনের সময় এবং এর পরও অব্যাহত থাকে। ইসলামের বিধিবিধান ও ধ্যান-ধারণা নিয়ে গবেষণা চলমান থাকায় বিদ্যমান তত্ত্বের উন্নয়ন এবং বিকাশও ঘটেছে। একই সাথে চিন্তাগত ধ্যান-ধারণায় নানা স্কুল বা ধারারও সৃষ্টি হয়। চিন্তা ও বিশ্লেষণের বহুমুখী ধারার বিকাশের মধ্য দিয়েই ইসলামের ভাবনা চিন্তার উন্নয়ন বর্তমান পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে।
ইসলামের বিকাশ ও উন্নয়নের বর্তমান পর্যায়ে পাশ্চাত্য ও অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মধ্যে ইসলামের বিধিবিধান ও চিন্তাধারা নিয়ে যে বিতর্ক ও সংশয় দৃশ্যমান, তার কিছু মৌলিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন বিশিষ্ট গবেষক শাহ আবদুল হালিম তার ‘ডিসকোর্স অন কনটেমপরারি পলিটিক্যাল থট’ নামের বইয়ে। এই বইটিতে সমসাময়িক ইসলামী রাজনৈতিক চিন্তার বিভিন্ন দিক সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে, যা পাঠকদের অনেক অব্যক্ত বিষয় বুঝতে সহায়তা করবে। বইটিতে আলোচিত ইস্যুগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে রয়েছে, ইসলাম গণতন্ত্রের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না, মানুষের সার্বভৌমত্ব ও আল্লাহর সার্বভৌমত্ব, দার আল হারব এবং দার আল ইসলাম, অমুসলিমদের ওপর জিজিয়া কর, হুদুুদের মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি, ধর্মত্যাগের শাস্তি, রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ এবং এ-সংক্রান্ত অন্য বেশ কিছু বিষয়। ৩৪টি নিবন্ধের এই বইটির বিষয়বস্তু ১৯৯২ থেকে ২০১৯ এর পটভূমিতে বাছাই করা হয়েছে। আর গত তিন দশকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক দৃশ্যের খুব বেশি মৌলিক অর্থবহ পরিবর্তন হয়নি। এতে আলোচিত প্রতিটি ইস্যু এখনো প্রাসঙ্গিক।
ইসলামের সুবর্ণ যুগের ইসলামী পণ্ডিতরা ভাবতেন যে, মুসলমানরা বিশ্বজুড়ে ইসলামের শিক্ষার বিস্তার ঘটাতে এবং ইসলামকে একটি বিজয়ী দ্বীন তথা জীবনের পথ হিসেবে গড়ে তুলতে জন্মগ্রহণ করেছে। ধ্রুপদী ফিকাহবিদগণের অনেকে ধারণা করেছিলেন, মুসলিম সমাজ চিরকাল শক্তিশালী এবং সুপ্রতিষ্ঠিত থাকবে। তারা আজকের যে পরিস্থিতিতে মুসলমানরা বাস করছে সে সম্পর্কে হয়তোবা পুরোপুরি ভাবতে পারেননি। ফলে মুসলিমরা বিজয়ী শাসক থাকাকালে তারা অনেক বিষয়ে খুব কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন যদিও ইসলামের মূল নির্দেশনাকে পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ রাখতে চিরন্তন এবং বেশ নমনীয় দেখা যায়।
এখন খেলাফত আমলের (উসমানীয় খেলাফতের সময় পর্যন্ত) ইমাম, ফকিহ এবং পূর্ববর্তী প্রজন্মের পণ্ডিতদের অপেক্ষাকৃত কঠোর ব্যাখ্যা ব্যবহার করে মুসলিমদের অসহিষ্ণু প্রমাণ করার চেষ্টা করতে দেখা যায়। প্রচার করা হয় যে, মুসলমানরা বহুমতে বিশ্বাস করে না এবং তাদের সাথে শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থানের কোনো আশাও নেই।
অথচ ইসলামের একটি বড় সৌন্দর্য হলো, এর অনুসারী মুসলিমরা কুরআন-সুন্নাহর মৌলিক বিষয়ের সাথে সামঞ্জস্যশীল ইজতিহাদ বা অনুসন্ধানের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হলে, নতুন কিছু গ্রহণ করতে পারে। সতর্ক ইজতিহাদের মাধ্যমে যদি কোনো ইস্যুতে আরো বেশি সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানো হয় তাহলে মুসলিমরা সর্বদা নতুন অবস্থানকে বিন্যাস করে নিতে পারে। এ কারণেই ইসলামকে একটি ‘গতিশীল ধর্ম’ যা চির-পরিবর্তিত পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে সক্ষম, হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
পাশ্চাত্য অবশ্য ইচ্ছাকৃতভাবে পূর্ববর্তী প্রজন্মের কয়েকজন বিশিষ্ট আলেম ও বুদ্ধিজীবীর পুরানো ইজতিহাদি সিদ্ধান্তের কথা উল্লেখ করে এসবকে মুসলিমদের ‘চিরায়ত সিদ্ধান্ত’ হিসেবে উপস্থাপন করতে চায়। উদাহরণস্বরূপ একটি বিষয়ের উল্লেখ করা যেতে পারে। বিশ্বকে দারুল ইসলাম বা শান্তির বাসস্থান এবং দার আল হার্ব বা যুদ্ধের আবাসে বিভক্ত করার ইজতিহাদ ছিল হাজার বছরের পুরনো। এখনকার মুসলিম আলেম ও ফকিহরা সে ক্ষেত্রে বিশ্বকে বিভক্ত করেছেন দু’টি অংশে- দার আল ইজাবাহ বা গ্রহণযোগ্যতার দেশ, যে দেশটি ইসলামকে গ্রহণ করেছে এবং যেখানে ইসলামী মূল্যবোধ চর্চা করা হয়। আর দ্বিতীয়টি হলো দার আদ দাওয়াহ বা দাওয়াতের দেশ, যে ভূমিতে দাওয়াত উপস্থাপিত হয়েছে এবং এর জনগণকে ইসলামী মূল্যবোধ ও রীতি অনুসরণ করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। মুসলিম স্কলারদের এই দুই ইজতিহাদের মধ্যে হাজার বছরের পুরনোটি এখনকার সময়ে আর গ্রহণযোগ্য নয়। প্রথমটি হাজার বছর আগের প্রেক্ষাপটে গ্রহণযোগ্য মনে করা হয়েছিল। এখন সেই বিভাজন গ্রহণযোগ্য নয়।
এ প্রসঙ্গে উত্তর আমেরিকার ফিকাহ কাউন্সিলের সভাপতি এবং জেদ্দাভিত্তিক আন্তর্জাতিক একাডেমি ফিকাহের সদস্য, ড. তাহা জাবির আল আলওয়ানি উল্লেখ করেছেন যে, দার আল কুফর এবং দার আল হার্বের বিভ্রান্তিকর বিষয়টি গ্রহণ করার অর্থ- যুক্তরাষ্ট্রের মতো অমুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রগুলোর আইন ও বিধিবিধান লঙ্ঘনের অধিকার মুসলিমদের রয়েছে। এ ধারণা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। ড. আলওয়ানি উল্লেখ করেন, আমরা বহু আমেরিকান বহু সংস্কৃতি ও বহু জাতিগত সমাজে অমুসলিমদের মধ্যে ছোট সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী হয়ে উত্তর আমেরিকাতে বাস করছি।
ইসলামী শরিয়াহ ও ফিকাহ অনুসারে মুসলিমদের এখানে জীবনযাপন করার সুযোগ রয়েছে। উত্তর আমেরিকার পরিবেশটি অধ্যয়ন না করে ফতোয়া এলে সেটি উত্তর আমেরিকান মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি বিরাট যুক্তিহীন কাজ হবে। প্রকৃতপক্ষে, এ ধরনের রায় বা ভুল ব্যাখ্যা মহাদেশটিতে ইসলামের ভবিষ্যতের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। এই ইস্যুটি এখনকার সময়ের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যখন উগ্রবাদী চিন্তা ও কর্মকাণ্ডের কারণে পাশ্চাত্য সমাজে মুসলিমরা তীব্র চাপের মুখে রয়েছেন। শাহ আবদুল হালিম এ বিষয়টিকে তার বইয়ে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেছেন।
মুসলিম রাষ্ট্রে অমুসলিমদের বাধ্যতামূলকভাবে জিজিয়া কর প্রদানের ইস্যু একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কোনো কোনো ফকিহ মনে করেন, ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমদের নিরাপত্তা প্রদানের জন্য তাদের জিজিয়া কর দেয়া বাধ্যতামূলক। অমুসলিম সমাজে এটি মুসলিমদের বিরুদ্ধে সমালোচনার অন্যতম বিষয়। কিন্তু সমসাময়িক ইসলামী পণ্ডিতরা বাধ্যতামূলক জিজিয়া করের ধারণাকে গ্রহণ করেননি। প্রখ্যাত ইসলামী ফকিহ প্রফেসর ড. ইউসুফ আল কারদাভি তার ফিকহ-উজ-জাকাহ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, খলিফা উমর বিন খাত্তাব রহ: তাদের অনুরোধে বনু তাগলিব গোত্রের খ্রিষ্টানদের ওপর জিজিয়া কর রহিত করে দিয়েছিলেন এবং একটি নতুন কর আরোপ করেছিলেন। ড. কারদাভি মতামত দিয়েছেন যে, অমুসলিমদের জিজিয়াহ প্রদানের বাধ্যবাধকতা নেই। যদি অমুসলিমরা জাকাতের সমপরিমাণ অন্য কোনো কর দেয় তবে তা যথেষ্ট। এতে কর প্রদানে মুসলিম ও অমুসলিমের মাঝে সাম্য আসে। বিশিষ্ট আরব অর্থনীতিবিদ ড. মনজার কাহফ মত দিয়েছেন যে, জিজিয়াকে কেবল যুদ্ধের মাধ্যমে দখলকৃত ভূমির বিষয়ে আরোপ করা যেতে পারে। মাওলানা মওদূদীও একই মত পোষণ করেছেন এবং পাকিস্তানে অমুসলিমদের জিজিয়া কর আদায়ের বিপরীত মত দিয়েছেন। এ নিয়ে বিস্তারিত আলোকপাত করেছেন শাহ আবদুল হালিম।
গণতন্ত্র ও ইসলাম প্রসঙ্গে লেখক দু’টি বিষয় তুলে ধরেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন, গণতন্ত্র বলতে কী বোঝায় সেই মূল বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। ইসলাম গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অথবা রাষ্ট্রপতিশাসিত, মন্ত্রিপরিষদ শাসিত বা রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সমর্থন করে কি না তা নিয়ে বিতর্ক ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবুও কিছু লোক আজ বলছেন, ইসলাম গণতন্ত্রের বিরোধী; ইসলাম ও গণতন্ত্র এক সাথে চলে না।
শাহ হালিমের যুক্তি হলো, যেকোনো ধরনের সরকারই ইসলামী হতে পারে যদি তা ইসলামের মূলনীতি পূরণ করে। পূর্ববর্তী ইসলামী পণ্ডিতরা উমাইয়া বাদশাহ আবদুল আজিজকে রাজতন্ত্রের মাধ্যমে বাদশাহ হলেও ‘পঞ্চম খলিফা’ বলে অভিহিত করেছিলেন। পরামর্শমূলক ব্যবস্থা এবং মানবকল্যাণ তার শাসনের উদ্দেশ্য হওয়ায় তিনি আজও ‘খলিফা’ হিসেবে বিবেচিত। রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারপ্রধানের পরামর্শ গ্রহণ ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক, এটি কোনোভাবেই ঐচ্ছিক নয়। সুতরাং ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্থার মূল নীতিকে কোনোভাবেই অগণতান্ত্রিক হিসেবে বর্ণনা করা যায় না। ইসলামের শুরু থেকে দেখা গেছে বেশির ভাগ জনগণ গ্রহণ করায় মদিনায় প্রথম ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, মক্কায় হয়নি। পরে মক্কার জনগণ ইসলামকে গ্রহণ করে নেয়ার পরই সেখানে ইসলামী রাষ্ট্র বিস্তৃত হয়েছে।
জনাব হালিমের পর্যবেক্ষণ অনুসারে, ইসলামের রাজনৈতিক ব্যবস্থা একক ক্ষমতাধিকারীর শাসনের অনুমতি দেয় যদি সেটি জনগণের সম্মতিতে এবং মূলত একটি পরামর্শমূলক ব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করে হয়। যেহেতু ইসলামী রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য জনকল্যাণমূলক এবং সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানের পরামর্শ গ্রহণ বাধ্যতামূলক, তাই ইসলামী রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে মূলত গণতান্ত্রিক হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।
বাংলাদেশ সম্পর্কে শাহ আবদুল হালিমের পর্যবেক্ষণ বেশ খানিকটা ব্যতিক্রমধর্মী। তার মতে, সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশ মূলত একটি ইসলামী রাষ্ট্র। এ ক্ষেত্রে কেবল প্রয়োজনটি হলো আমাদের আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে ন্যায়নিষ্ঠ, পুণ্যবান, রাজনৈতিক ও সামাজিক অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন জনগণের আস্থাভাজন ইসলামী ধর্মতত্ত্ববিদ, উলামা ও ফকিহ সমন্বিত একটি কমিটি গঠন এবং তাদের পরামর্শ অনুসারে কিছু বিধিবিধানের পুনর্বিন্যাস করা। এই কমিটির সদস্যরা জাতীয় সংসদ কর্তৃক পাস করা সব খসড়া আইন পর্যালোচনা করবেন এবং সরকারকে এই জাতীয় আইন (নীতি) সম্পর্কে তাদের মতামত দেবেন, যাতে সংসদীয় আইনগুলো ইসলামের আইন ও সংবিধানের পরিপন্থী না হয়। কমিটির সদস্যরা নিশ্চিত করবেন, যাতে কুরআন ও সুন্নাহর বিপরীত কোনো আইন বিবেচনার জন্য মন্ত্রিসভা বা সংসদের সামনে না আসে।
শাহ হালিম মনে করেন, বাংলাদেশের আইন এই অর্থে ইসলামের বিরোধী নয় যে, এই আইনগুলোতে কুরআনের পাঠ্যবিরোধী প্রায় কিছুই নেই এবং এ আইনের উদ্দেশ্য হচ্ছে মানবকল্যাণ। এ আইনগুলোও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমর বিল মারুফ ও নাহি আনিল মুনকারের অন্তর্ভুক্ত। এই আইনগুলোর উদ্দেশ্য হলো সুকীর্তি বলবৎ করা এবং মন্দগুলো অপসারণ করা। এ আইনগুলোর কয়েকটির কিছু অংশ সংশোধন করলে হবে।
তিনি উল্লেখ করেন, বাংলাদেশের সংবিধানে বলা হয়েছে যে, রাষ্ট্রীয় ধর্ম হবে ইসলাম। দু’টি বড় রাজনৈতিক দল, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ইসলামবিরোধী আইন না করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বাংলাদেশের প্রত্যেকে তার ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান করতে পারেন। মহিলারা হিজাব পালন করতে পারেন এবং মসজিদ ও মাদরাসা প্রতিষ্ঠায় কোনো বাধা নেই। তত্ত্বগতভাবে আমাদের দেশে ইসলামী আইন রয়েছে যদিও আমরা কিছু ক্ষেত্রে ভুল খুঁজে পাই। উমাইয়া ও আব্বাসীয় খলিফাদের সময়েও এ-জাতীয় ভুল পাওয়া গেছে।
রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সংবিধানের প্রথম ইতিবাচক ও অর্থবহ পরিবর্তন করেছেন। তিনি সংবিধানের শীর্ষে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ যুক্ত করেছিলেন। রাষ্ট্রীয় মৌলিক নীতিতে আরো যুক্ত করা হয়েছে : ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি নিখুঁত আস্থা ও বিশ্বাস সব ক্রিয়াকলাপের ভিত্তি হবে।’
রাষ্ট্রপতি জিয়া বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার পরিপূর্ণতা দান এবং রাজনীতিকে বাংলাদেশের মানুষের বাস্তব জীবনের প্রত্যাশার নিকটবর্তী করার জন্য, সংবিধানে এই পরিবর্তনগুলো প্রবর্তন করেছিলেন। পরে রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদ সংবিধানে আরো একটি অর্থবহ ও সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন করে যুক্ত করেছেন : ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রীয় ধর্ম ইসলাম।’
শাহ আবদুল হালিমের বইয়ের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হলো সার্বভৌমত্ব। এ ইস্যুটি এখন বিতর্কের অন্যতম বিষয়। বইটিতে উল্লেখ করা হয়, বিবিসি সংলাপে বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদপত্রের সম্পাদক মন্তব্য করেন যে, গণতন্ত্র মানে জনগণের সার্বভৌমত্ব আর যতক্ষণ আল্লাহর সার্বভৌমত্বের প্রতি বিশ্বাসী মানুষ রাজনীতিতে যুক্ত থাকেন ততক্ষণ গণতন্ত্রের কোনো সম্ভাবনা বা ভবিষ্যৎ নেই দেশে। বিবিসির সেই সংলাপে এই সম্পাদকের মন্তব্যের জবাব দেয়ার মতো কেউ ছিলেন না। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সার্বিকভাবে সার্বভৌমত্বের বিষয়টি নিয়ে বিতর্কের সমাধান করা দরকার; আর এ ক্ষেত্রে এর গভীরতর দিকে তাকানো প্রয়োজন।
বলা হয় যে, ব্রিটিশ সংসদ কোনো পুরুষকে নারী এবং কোনো মহিলাকে পুরুষ বানানো ছাড়া সব কিছু করতে পারে। এটি মূলত মানুষের কর্তৃত্বের সীমাবদ্ধতাকেই ব্যাখ্যা করে। মুসলমানরা বিশ্বাস করে যে, মানবিক কর্তৃত্বকে ব্যবহার করে প্রাকৃতিক আইন আমরা পরিবর্তন করতে পারি না। অর্থাৎ আমরা সূর্যকে পশ্চিমে উত্থিত করে পূর্ব দিকে স্থাপন করতে পারি না। অর্থাৎ সার্বভৌমত্বের দু’টি দিকের একটি হলো সৃষ্টি জগতের, অপরটি হলো রাজনৈতিক। সৃষ্টি জগতের সার্বভৌমত্ব অস্বীকার করে উল্টো কিছু করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব কিভাবে প্রয়োগ করা হবে সেই এখতিয়ার আল্লাহর মানুষকে দিয়েছেন।
ইসলামের মর্মার্থ হলো, আল্লাহর আদেশের প্রতি অনুগত ও বিশ্বস্ত থাকা। কিন্তু অনুগত থাকা না থাকার এখতিয়ার বা স্বাধীনতা মানুষকে দেয়া হয়েছে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আল্লাহর নির্দেশিত পথকে নীতি হিসেবে অনুসৃতিকে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। আল্লাহ পবিত্র কুরআন ও অন্যান্য আসমানি কিতাবে সৎ কাজের আদেশ বা প্রতিষ্ঠা করতে এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত থাকতে বলেছেন। এটিকে রাষ্ট্র যদি নীতি হিসাবে গ্রহণ করে তা হলে গণতন্ত্রের কী ক্ষতি হবে তা বোধগম্য নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটিতে স্পষ্টভাবে বলা হয়নি যে, জনগণ সার্বভৌম, বরং কিছু চিরন্তন অধিকারের কথা বলা আছে, যা জনগণ ভোট দিয়েও পরিবর্তন করতে পারে না। ‘আল্লাহর সার্বভৌমত্ব’ মানে হলো তার নির্দেশিত বিষয়গুলো মানুষ পরিবর্তন করতে পারবে না।
সাধারণভাবে ‘জনগণের সার্বভৌমত্ব; বলতে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মতের সার্বভৌমত্বের কথা বোঝানো হয়। এখন সংখ্যাগুরু মানুষ যদি সংখ্যালঘুদের জাতিগত নিশ্চিহ্নকরণের পক্ষে মত দেয় তা কি বাস্তবায়নযোগ্য বা গ্রহণযোগ্য হবে? সার্বভৌমত্বের প্রয়োগ অবশ্যই শর্তাধীন। রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বের ক্ষেত্রে আল্লাহর নির্দেশনাকে গ্রহণ করার মধ্যে গণতন্ত্রের পরিপন্থী কিছু নেই। এ কারণে বাংলাদেশে প্রধান দুই দল কুরআন-সুন্নাহবিরোধী কোনো আইন প্রণয়ন না করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন। এর মাধ্যমে আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে প্রকারান্তরে স্বীকার করা হয়েছে।
ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলোর বৃহত্তর রাজনৈতিক ঐক্য নিয়ে অনেক সময় বিতর্কের অবতারণা করা হয়। কিছু মুসলিম দেশ ইসলামবিরোধী সামরিক একনায়কতন্ত্রে শাসিত হয়। তিউনিসিয়ার বিশিষ্ট ইসলামী পণ্ডিত শেখ রশিদ ঘানুশির অভিমত, এ জাতীয় পরিস্থিতিতে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে স্বৈরশাসনের পতনে গণতান্ত্রিক ও সেকুলার শক্তির সাথে ইসলামী দলগুলোকে সহযোগিতা করা উচিত এবং এর জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা ইসলামী আন্দোলনের কাজ। ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠা করা বিশ্বের সব ইসলামী আন্দোলনের চূড়ান্ত দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য। একটি সাধারণ উদ্দেশ্যে কোনো গ্রুপের সাথে জোট গঠনে কোনো বাধা নেই যার উদ্দেশ্য হচ্ছে মানবকল্যাণ, আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। ইসলামী নেতৃত্বকে সর্বদা গণতান্ত্রিক শক্তির প্রতি তাদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে, বিশেষত যখন এই দলগুলো ইসলামের বিপরীত কোনো আইন না করার প্রতিশ্রুতি দেয়।
মধ্যপন্থী ইসলামের রাজনীতি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছেন শাহ আবদুল হালিম। আফগানিস্তানে মার্কিন আগ্রাসনের সময় বাংলাদেশের সরকার মার্কিন আক্রমণকে সমর্থন এবং বাংলাদেশের ভূমি ও আকাশসীমা ব্যবহারের আমেরিকান দাবিতে সাড়া দিয়েছিল। এ কারণেই পশ্চিমারা বাংলাদেশের জনগণকে ‘মধ্যপন্থী মুসলমান’ হিসেবে অভিহিত করে। একই কারণে, মিসর ও সৌদি আরবকে মধ্যপন্থী মুসলিম দেশ বলা হয় যদিও সৌদি আরব শরিয়াহ আইন প্রয়োগ করে আর এটি মার্কিন কর্তৃপক্ষকে প্রশ্নবিদ্ধ করে না। তবে আমেরিকার কাছে ইরান একটি ‘মধ্যপন্থী মুসলিম দেশ’ নয় যদিও তারা গণতন্ত্রের অনুশীলন করে আসছে। ইরানকে একটি ‘দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়; কারণ এটি যুক্তরাষ্ট্রের অবৈধ কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন তোলে। এতে কার্যত এটি দাঁড়ায় যে, মুসলিম দেশগুলো যদি তাদের অনুসরণ করে তবে সেসব দেশকে মধ্যপন্থী মুসলিম দেশ হিসেবে অভিহিত করা হবে। শাহ হালিম মধ্যপন্থী বা প্রগতিশীল শব্দের মতলববাজিপূর্ণ ব্যবহারের বিরোধী। যদি এ ধরনের শ্রেণিবিন্যাস ব্যবহারিক কারণে এবং পরিষ্কার বোঝার জন্য ব্যবহার করা হয় তবে এতে কোনো ক্ষতি নেই; যেভাবে মুসলিমরা শিয়া ও সুন্নি বা হানাফি বা মালেকী বা অন্যান্য জাতীয় শ্রেণিবদ্ধ করার বিষয়টি এড়াতে পারে না।
ইসলামের কিছু বিধিবিধান নিয়ে সৃষ্টি করা বিতর্ককে জনাব হালিম তার বইয়ের আলোচনায় নিয়ে এসেছেন। পাশ্চাত্যের কেউ কেউ মেয়েদের ইসলামী পোশাক নিয়ে আপত্তি করেন। প্রকৃতপক্ষে, পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশগুলোর বেশির ভাগের মধ্যে পুরুষ ও মহিলাদের জন্য পোশাকের বিভিন্ন মানদণ্ড রয়েছে। এর মধ্যে যদি বৈষম্য না হয়, তবে কেন ইসলামিক পোশাককে ‘লিঙ্গ পক্ষপাত’ বলে আখ্যায়িত করা হবে? প্রকৃতপক্ষে ইসলামী পোশাক মহিলাদের ‘ভোগ্য সামগ্রী’ হিসেবে পাবলিক প্লেসে নিজেদের তুলে ধরতে নিরুৎসাহিত করে থাকে। ব্রিটেন ও অন্যান্য দেশে খ্রিষ্টান নানরা হেড স্কার্ফ ব্যবহার করেন। একটি মুসলিম দেশে মেয়েরা হেড স্কার্ফ ব্যবহার করলে তা কেন বৈষম্যমূলক বা অগণতান্ত্রিক হয়ে উঠবে?
কুরআনের নির্দেশ অনুসারে পুরুষ ও মহিলা উভয়কেই একে অপরের সাথে দেখা করার সময় চোখকে নত রাখতে বলা হয়েছে, যাতে পুরুষরা মেয়েদের দিকে বা পুরুষদের দিকে মেয়েরা না তাকায়। যে প্রশ্নটি এখানে স্বাভাবিকভাবে দেখা দেয় তা হলো, যদি কোনো মহিলার মুখ পুরোপুরি ঢাকা থাকে তবে কেন একজন পুরুষ তার দৃষ্টি নত করবেন? এ-সংক্রান্ত নির্দেশনায় এটি স্পষ্ট যে, মহিলার মুখ ঢাকা বাধ্যতামূলক নয়।
হুদুদ বা ব্যভিচারের শাস্তির বিষয়টি গণতন্ত্রের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয় বলে সমালোচনা করা হয়। বলা হয়, এ জন্য মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি একটি দেশকে অগণতান্ত্রিক করে তোলে। ইসলামের খেলাফত যুগে এই আইন কার্যকর করার বাস্তব ঘটনা খুব বেশি ছিল না। জনাব হালিম এ প্রসঙ্গে খলিফা উমরের ইজতিহাদকে সামনে এনেছেন। এর ব্যাখ্যা করে তার বইটিতে বলা হয় যে, যতক্ষণ না আমরা পতিতালয়, বার, অশ্লীল সিনেমা, অশ্লীল বই ও পর্নোগ্রাফির মতো অশ্লীলতার দরজা উন্মুক্ত রাখি বা সরকার উপযুক্ত বয়সে বিয়ে নিশ্চিত করতে না পারে অথবা সৈন্যদের স্ত্রীদের সাথে ব্যারাকে থাকার মতো আবাসনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না করতে পারে এবং ট্রাক ও বাসচালকরা তাদের স্ত্রীর কাছ থেকে কয়েক মাস বিচ্ছিন্ন থাকার প্রয়োজন হয় ততক্ষণ ব্যভিচারের জন্য ইসলামিক দণ্ড আইন কার্যকর করা যাবে কি না তা নিয়ে ভাবনার অবকাশ রয়েছে।
শরিয়াহ প্রয়োগের জন্য যে প্রয়োজনীয় শর্তাদি, সে অনুযায়ী ইসলামী আইন বিদ্যমান থাকলে তা প্রয়োগ করতে হবে। নির্দিষ্ট সময় বা কোনো বিশেষ ক্ষেত্রে রায়টি প্রয়োগ না করা অবশ্যই নির্দিষ্ট রায়টির বৈধতা হ্রাস করে না। ইসলামী আন্দোলন এখনো শীর্ষ নেতৃত্বের ক্ষেত্রে নারীদের গ্রহণ করতে প্রস্তুত নয়। ইসলামের আগের দিনগুলোতে, খোলাফায়ে রাশেদীন মুসলিম বিশ্বজুড়ে বিস্তৃত, কর্তৃত্বের সমন্বয় করতেন। যেমন রাষ্ট্রের প্রধান জামাত, সেনাবাহিনীর কমান্ডিং, পরম ইজতিহাদ অনুশীলনসহ ফিকাহ এবং সর্বোচ্চ বিচারক হিসেবে ভূমিকা রাখতেন। যোগ্যতার দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো মহিলাকে রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান হিসেবে এই ক্ষমতাগুলোর কিছু অর্পণ করা যেতে পারে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রানী বিলকিসের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকার বিষয়টির পবিত্র কুরআনে উল্লেখ রয়েছে।
জনাব হালিম উল্লেখ করেছেন, ইতিহাসের বৈপরীত্যটি হলো- পশ্চিমারা মুসলমানদের প্রতি অসহিষ্ণু আচরণের অভিযোগ আনছে অথচ পাশ্চাত্যের অনেক নেতা এমনভাবে আচরণ করেন, যা ইসলামী সভ্যতার প্রতি তাদের পক্ষপাতদুষ্ট ও অসহিষ্ণু মনোভাব এবং ঘৃণার প্রতিচ্ছবি প্রতিফলিত করে। টুইন টাওয়ার হামলার পরপরই মার্কিন রাষ্ট্রপতি বুশ জুনিয়র অতি দ্রুত ‘ক্রুসেড’ ঘোষণা করেছিলেন, যা নিঃসন্দেহে তার অবচেতন মন এবং ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটায়। বুশ জুনিয়রের পদক্ষেপ অনুসরণ করে ইতালির তখনকার প্রধানমন্ত্রী সিলভিও বার্লুসকোনি ঘোষণা করেছিলেন, ‘পশ্চিমা সভ্যতা ইসলামী সংস্কৃতির চেয়ে উচ্চতর। অবশ্যই আমাদের সভ্যতার শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে সচেতন হতে হবে।’
শাহ হালিম মনে করেন, পাশ্চাত্য যদি আজ চায় যে, মুসলিমরা পশ্চিমা ঐতিহ্য এবং প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরো ভালোভাবে উপলব্ধি করুক, তবে পশ্চিমকে অবশ্যই তার কিছু কুসংস্কার থেকে সরে আসতে হবে। ইসলামের নবী সা:-এর ব্যাপারে পাশ্চাত্যের অনেকের মূল্যায়ন হলো, তিনি এরূপ একজন ব্যক্তিত্ব, যিনি এমন একটি ধর্ম ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যা পাশ্চাত্যের প্রচলিত কল্পকাহিনীর তরবারির ভিত্তিতে নয়, শান্তি ও মিলনের বার্তা নিয়েই আবির্ভূত হয়েছিল।
বাস্তবতা হলো ইসলাম ও পাশ্চাত্য উভয়পক্ষেরই দৃঢ় একেশ্বরবাদ, ওহির প্রতি বিশ্বাস, নবী-রাসূল ও ধর্মগ্রন্থ একটি সাধারণ ঐতিহ্য। মুসলমানরা খ্রিষ্টানদের সাথে অনেক শিক্ষা শেয়ার করে, তারা বাইবেলের সব নবীকে গ্রহণ করে, নৈতিক দায়িত্বের ওপর জোর দেয় এবং শেষ দিনকে বিশ্বাস করে। নবী মুহাম্মদ সা:-এর সময় থেকেই মুসলমানরা এটিকে স্বীকৃতি দিয়েছে, তবে পশ্চিমারা সাধারণভাবে ইসলামের চিরন্তনতাকে মেনে নিতে পারে না।
শাহ আবদুল হালিম তার বইয়ে সমসাময়িককালের বিভিন্ন বিতর্কিত ও আলোচিত ইস্যুর একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা ও মূল্যায়নের চেষ্টা করেছেন। তবে তিনি চূড়ান্ত নিষ্পত্তির বিষয়টি ইসলামিক স্কলার, উলামা, শিক্ষাবিদ ও গবেষকদের অধিক গবেষণা ও অনুসন্ধানের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। তার ৩৬৮ পৃষ্ঠার ইংরেজিতে রচিত বইটি সমসাময়িক চিন্তার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। এর বাংলায় অনুবাদ আরো বেশি সংখ্যক পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করবে। বুক মাস্টার বইটি প্রকাশ করেছে। ‘রকমারি’তে বইটি পাওয়া যাচ্ছে।
লেখক: মাসুমুর রহমান খলিলী