‘বীরশ্রেষ্ঠ’ আবু সাঈদই ‘বাংলাদেশ’
শনিবার ১০ আগস্ট, ২০২৪ প্রথম বেলায়ই পুরো বাংলাদেশ ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ আবু সাঈদের সাথে ‘সাক্ষাৎ’ করেছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস সেই বাংলাদেশের প্রতীক। ‘অন্তর্বর্তীকালীন নির্বাহী বিভাগের’ (সবাই ‘সরকার’ বলছি বটে) প্রধান (প্রধান উপদেষ্টা) ড. ইউনূস বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। তিনি শহীদ আবু সাঈদের (কবর) জিয়ারত (‘জিয়ারত’ আরবী শব্দ, বাংলায় ‘সাক্ষাৎ’ বলি) করেছেন। তাঁর সাথে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলনের নেতা ‘নাহিদেরা’ ছিলো। ড. ইউনূস সাঈদের মা-বাবা-ভাই-বোনদের জড়িয়েছেন পরম স্নেহে, তাদের কথা শুনে তিনি আবেগে ভেঙে পড়েছেন, অসহায়-অক্ষম সান্ত্বনার শব্দাদি উচ্চারণ করেছেন। তিনি তাদেরকে বাংলাদেশের পতাকায় বরণ করেছেন। এই সকালটি বাংলাদেশের ইতিহাসে থাকবে। ’বীরশ্রেষ্ঠ আবু সাঈদ অতপর বাংলাদেশ’। ইতিহাস বলে, ‘মরে গিয়েই মানুষ বেঁচে থাকে’।
সক্রেটিস ‘বেঁচে আছেন’। সক্রেটিসের খুনিরা সবাই ‘মরে গেছে’।
‘ছাত্র আন্দোলনের’ ‘গণঅভ্যুত্থান হয়ে যাওয়া’
৫ আগস্ট (অরফে ৩৬ জুলাই) ২০২৪ বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থান হয়েছে। গণঅভ্যুত্থান ‘সফল’ হয়েছে, বিজয়ী হয়েছে। এই অভ্যুত্থানের নেতা ‘নাহিদেরা’ এর নাম দিয়েছেন ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান। এক সঠিক, শুদ্ধ উচ্চারণ বটে। ছাত্ররা ‘আন্দোলনটি’ শুরু করেছিলো। এবং নানান নির্যাতন সয়ে এগিয়ে নিয়েছিলো। কিন্তু শাসকদের সীমাহীন অহঙ্কার-ঔদ্ধ্যত্ব আর মি. ওবায়দুল কাদেরের ‘ছাত্রলীগ থ্যারাপি’ আন্দোলনটিকে ‘শহীদী কাফেলায়’ পরিণত করে। ‘বুক চিতানো আবু সাঈদের শাহাদাত’ ও ‘মুগ্ধদের নিরস্ত্র প্রাণদানের’ প্রেক্ষাপটে ‘নাহিদেরা’ জনতার অংশগ্রহণ ও সাহায্যের আবেদন করে। জনতা ক্রমশ: আন্দোলনে যোগ দেয়। এর মাঝে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের কথিত ‘ফার্মের মুরগীছানারা’ বীরের শৌর্য নিয়ে রাজপথ দখল ও ছাত্র-যুবলীগসহ খুনি বাহিনীগুলোকে প্রাণের বিনিময়ে রুখে দাঁড়ায়। আন্দোলনটি গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। কারফিউ আর দেখামাত্র গুলির নির্দেশও ছাত্র-জনতা উপেক্ষা করে। গণঅভ্যুত্থানে জন্ম নেয়া এক যুবা বিপ্লবী স্মিত হেসে স্পষ্ট উচ্চারণে শুনিয়ে দেয় ‘পেছনে পুলিশ, সামনে স্বাধীনতা’। আহ্ কী সেই বলার ভঙ্গী! বিপ্লবী সব অস্তিত্ব! তাই গণঅভ্যুত্থান আর ‘পেছনে হটেনি’। ঘোষিত তারিখ একদিন এগিয়ে এনে ‘৩৬ জুলাই’ নির্ধারণ করা হয় ‘মার্চ টু গণভবন’, দুপুর দুটোয়। ‘গণভবন মার্চ’ শুরুর আগেই ‘চিহ্নিত স্বৈরাচার’ ‘গণভবন ত্যাগ করার’ দলিলে স্বাক্ষর করে। ৪৫ মিনিট সময় দেয়া হয় তাকে হেলিকপ্টারে ওঠার জন্য। হেলিকপ্টারে ওঠেন এবং দেশ ছাড়েন। গণঅভ্যুত্থানের বিজয় ঘোষিত হয়। কিছু ছাত্র-জনতা জানিয়ে দেয়, এটি কেবল গণঅভ্যুত্থানের বিজয় নয়, এটি দ্বিতীয় স্বাধীনতা, স্বাধীনতা ২০২৪।
বিপ্লব আর গণঅভ্যুত্থান প্রশ্ন
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান সফল হবার পর জানা গেলো, এতে ‘সেনাদেরও’ কিছু অবদান আছে। তা স্বীকার করা উচিৎ। স্বৈরাচারের হুকুম মেনে সেনারা ছাত্র-জনতাকে গুলি করতে পারতো। তেমন ক্রুদ্ধ আদেশ ছিলো। সেনারা সবিনয়ে-সকৌশলে তা এড়িয়ে যায়। না হলে, আরো জীবন যেতো, হাজার হাজার। হয়তো তবুও ছাত্র-জনতা সফল হতো। কারণ জনসমুদ্রে তখন বাধাহীন উর্মি। সেনারা নিজদেশের সন্তানদের খুন করা থেকে বিরত থেকেছে, থাকতে পেরেছে। তাদেরও স্বীকৃতি পাওনা। তাই এই গণঅভ্যুত্থানের নাম ছাত্র-জনতা-সেনা গণঅভ্যুত্থান। উপযুক্ত নাম বটে। বিজয়ী গণঅভ্যুত্থানকে এখন ‘স্বৈরাচারী সরকারের’ ‘শুন্যস্থান’ পূরণ করতে হবে। ‘আধুনিক সরকার’ মানে তিনটি ‘বাহু’ (উইং) বা অঙ্গের (অর্গান) মিলিত রূপ: আইন, নির্বাহী ও বিচার বিভাগ। গণঅভ্যুত্থান বিজয়ী হবার অনতিবিলম্বে আইন বিভাগ-জাতীয় সংসদ ভেঙে দেয়া হয়েছে। নির্বাহী বিভাগের প্রধান শেখ হাসিনাসহ সব সদস্য (মন্ত্রী ইত্যাদি) পালিয়েছেন বা লুকিয়েছেন। এটি শুন্য এখন। বিচার বিভাগ ‘দাঁড়িয়ে আছে’ অংশত। দাবি উঠেছে, স্বৈরাচারের সমর্থক উচ্চ আদালতের (হাইকোর্টের) বিচারকদের সরে দাঁড়াতে হবে, স্বেচ্ছায় অন্যথায় ‘সরিয়ে দেয়া’ হবে। ‘সরিয়ে দেয়া’ বিচারকদের জন্য বেশি অবমাননাকর হবার কথা।
প্রধান মনোযোগ এখন নির্বাহী বিভাগের দিকে। পতিত স্বৈরাচারের রেখে যাওয়া ‘নির্বাহী কাঠামোর অংশ বিশেষ’ এখনো বহাল আছে। প্রশ্ন তা নিয়ে আছে। তবে প্রশ্ন এগিয়েছে আরো: ‘যা ঘটলো’ তা ‘গণঅভ্যুত্থান’ না ‘বিপ্লব’? কেউ কেউ একে ‘বিপ্লব’ নাম দিয়েছেন। তারা উল্লেখযোগ্য অস্তিত্ব বটেন। তাই তাদের দাবি আমলে নেয়ার দরকার আছে। যারা একে বিপ্লব বলছেন না, তাদের যুক্তি কী, তা-ও ‘শোনা’ দরকার। ‘বিপ্লব’ যদি মানি, তবে ইতোমধ্যেই বিপ্লব ‘আংশিক বেহাত’ হয়ে গেছে। আরো বেহাত-বিফল হবার ধারায় আছে। বিপ্লব মানে, আগে যা ছিলো, সবই ‘নাই হয়ে’ যাওয়া আর সেখানে নতুনের প্রতিস্থাপন। ‘সবতো নাই’ হয় নি। ‘সংবিধান’ নাই হয় নি, ‘প্রেসিডেন্ট’ নাই হয় নি, বিচার বিভাগ ‘অংশত’ দাঁড়িয়ে আছে। তা হলে বিপ্লব ‘হলো’? হয় নি বলে উচ্চারণ আছে, ‘উল্লেখযোগ্য কণ্ঠ’ থেকে।
রাজনীতি বিজ্ঞানের একজন ছাত্র হিসেবে আমার কিঞ্চিত ভিন্নমত আছে। যা ঘটলো, যা ‘বিজয়ী’ হলো, সেটিকে আমি ‘বিপ্লব’ মনে করি না। বলি, এটি একটি গণঅভ্যুত্থান, মহান-সফল গণঅভ্যুত্থান। কারণ কী? কারণ, গণঅভ্যুত্থানের যে সংজ্ঞা রাজনীতি বিজ্ঞান দেয়, এখানে ঠিক তা-ই ঘটেছে। ছাত্ররা জেগে উঠেছে, জনতা জেগে উঠেছে, সেনারা শেষ মুহূর্তে তাতে ‘যোগ দিয়েছে’। এই ‘জেগেওঠা ও যোগদান’ এক মহান অভিজ্ঞতা, এক মহা উত্থান-‘ওঠার’ ঘটনা। ছাত্র-জনতা-সেনা ‘উঠেছে’ আর তার ভয়ে স্বৈরাচার পালিয়েছে। স্বৈরাচারের অভিজ্ঞতায় চসেস্কু ছিলো, গাদ্দাফী ছিলো। ছিলো প্রাণের মায়া। তাই পালিয়েছে। উত্থান-অভ্যুত্থান সফল হয়েছে, বিজয়ী হয়েছে। আরো দুটো ‘নোক্তা’ বিবেচনায় রাখা দরকার। বৈষম্যবিবোধী ছাত্র আন্দোলন মানে এর সংগঠক ‘নাহিদেরা’ কি একটি বিপ্লব করতে চেয়েছিলো? ওরা কোথাও ‘বিপ্লব’ উচ্চারণ করেছে? দুই প্রশ্নের জবাবই ‘না’ । সমন্বয়কেরা-বাইরেরা-নাহিদেরা যেখানে এটিকে ‘বিপ্লব’ বলে নি, ওরা যেখানে ‘বিপ্লব’ চায় নি, সেখানে ওদের ‘অর্জনকে’ আমি ‘বিপ্লব’ বললে তা কি সঠিক হবে, আরো অর্থপূর্ণ হবে, বেশি মহান হবে? সম্ভবত না।
দ্বিতীয় নোক্তা: সমন্বয়কেরা-বীরেরা-নাহিদেরা নিজেরা কি বিপ্লবী? ওদের ‘বিপ্লবী’ হবার কোনো প্রেক্ষাপট আছে? উত্তর ‘না’। ওরা ‘আন্দোলনটি’ শুরু করেছিলো একটি ‘বৈষম্যমুক্ত কোটা ব্যবস্থার’ দাবিতে, হাইকোর্ট বিভাগের ‘দুই অবিবেচক, অন্ধ বিচারকের এক অশুদ্ধ, অগ্রহণযোগ্য রায়’-এর সূত্রে। ওদের দাবি ‘পলাতক স্বৈরাচার’ তখনই মেনে নিলে আন্দোলনটি আর এগুতো? জবাব ‘না’ হবার ‘গ্রহণযোগ্য সম্ভাবনা’ বিদ্যমান। মি. ওবায়দুল কাদেরের ‘ছাত্রলীগ থ্যারাপি’-র পর তার পদত্যাগ ও ‘কথিত বিকৃত রাজাকারের নাতিপুতি’উচ্চারণের পর ‘ক্ষমা চাওয়ার দাবি’ পূরণ হলে আন্দোলনটি আর এগুতো? ‘এগুলে’ সেটি এমন জনসমর্থন’ পেতো? জবাব ‘না হবার গ্রহণযোগ্য সম্ভাবনা’ ছিলো। তার মানে আন্দোলনটি একটি ‘গণঅভ্যুত্থানে পরিণত’ হবার ক্ষেত্রে পলাতক স্বৈরাচার ও দোসরদের ‘অবদান’ বেশি। তাই এই অর্জনকে ‘ছাত্র-জনতা-সেনার গণঅভ্যুত্থান’ মানাই বেশি সঙ্গত।
বিপ্লব দাবি করার সমস্যা
‘বিপ্লব’ দাবি করায় সমস্যা আছে, জটিলতাও আছে। অভিজ্ঞতাও তা-ই বলে। ১৯৭১-এ বাংলাদেশি জনগণ যা অর্জন করেছিলো, উল্লেখযোগ্য গবেষক-পণ্ডিতদের কেউ কেউ তার নাম ‘বিপ্লব’ দিয়েছিলেন। ‘বাংলাদেশ রেভুলিউশন এণ্ড ইটস আফটারম্যাথ’ নামে আমার ডক্টরাল সুপারভাইজার প্রফেসর তালুকদার মনিরুজ্জামানের গবেষণাকর্ম আছে। রাজনীতি বিজ্ঞানের পণ্ডিত হিসেবে তাঁর জুড়ি কম আছে বিশ্বব্যাপী। মরহুম ড. তালুকদার স্যারের মাগফিরাত কামনা করি, এই সুযোগে। শ্রদ্ধাও কৃতজ্ঞতা জানাই তার তাৎপর্যময় সব গবেষণার জন্য। আমাদের আরেক মোহময়ী বক্তা-পণ্ডিত ড. সলিমুল্লাহ খান লিখেছেন ‘বেহাত বিপ্লব’। শব্দবন্ধ হিসেবে ‘বেহাত বিপ্লব’ শ্রুতিমধুর ও আকর্ষণীয়।
আমি বলি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে কোনো ‘বিপ্লব’ ঘটে নি। তা ছিলো একটি ‘রাজনৈতিক মুক্তিযুদ্ধ’, যার সাথে ‘ঘোষিত স্বাধীনতা’কে সফল করার প্রশ্ন জড়িয়ে ছিলো। সেই রাজনৈতিক মুক্তিযুদ্ধ সফল হওয়ায় ঘোষিত স্বাধীনতাও সফল হতে পেরেছিলো। তাই বাংলাদেশ নামের দেশ ৫৩ বছর পথ চলতে পেরেছে, চিরকাল চলবে এ প্রতিজ্ঞায়। কিন্তু যারা সেটিকে ‘বিপ্লব’ বলেছিলেন, ‘বিপ্লব’ ভেবে সব ‘বিপ্লবী’ ও ‘সমাজতন্ত্রী’ কর্ম পরিকল্পনা নিয়েছিলেন, তার ‘সবই ব্যর্থ’ হয়েছে, মুখ থুবড়ে পড়েছে। অর্থনীতিবিদ প্রফেসর রেহমান সোবহান সেই সব ব্যর্থতা ব্যাখ্যা করার জন্য এখনো বেঁচে আছেন। তিনি জীবিত থাকায় আমরা শান্তি-আনন্দ অনুভব করি। ‘প্রফেসর রেহমান সোবহানদের’ যাবতীয় বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছিলো। কেনো হয়েছিলো? কারণ সেটি কোনো ‘বিপ্লব’ ছিলো না, ছিলো কথিত ‘বুর্জোয়া ক্ষমতার পালাবদল’। ক্ষমতার পালাবদল ঘটেছিলো,স্পষ্টতই এবং সঠিকভাবেই। বিপ্লব ঘটেনি, কোথাও। কারণ সেটি বিপ্লব ছিলো না, সেটির নেতা-কর্মীরা বিপ্লবী ছিলেন না, বিপ্লবের জন্য প্রস্তুতও ছিলেন না।
আজ তবে কী?
আজ বাংলাদেশে একটি ছাত্র-জনতা-সেনার গণঅভ্যুত্থান হয়েছে। এটিকে সংহত করতে হবে। এর অর্জন ও সুফল সবার কাছে পৌঁছাতে হবে। কী করতে হবে, তা আমার আগের লেখায় বলেছি, সংক্ষেপে যদিও। পাঠক বিস্তারিত পড়তে চান না। নতুন ভাব-ভাবনাও কম চান। ধীরস্থির ও নতুন ভাবনা শোনা-গ্রহণ-ধারণের পাঠক-জনতা গড়া এক দীর্ঘ মেয়াদী দায় বটে।
-ড. তারেক ফজল রাজনীতি বিজ্ঞানের শিক্ষক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
Discussion about this post