অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
সৌরভ গাঙ্গুলি ও নরেন্দ্র মোদীর আমন্ত্রণে কলকাতায় গেলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা জানানো হয়নি৷ এটি কি কূটনৈতিক প্রথা ও সৌজন্য বিরোধী? দিল্লি কি শেখ হাসিনাকে এড়িয়ে চলছে?
কলকাতার ইডেন গার্ডেনে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যকার প্রথম দিবারাত্রি টেস্টের উদ্বোধনী আয়োজনে যোগ দিতে সম্প্রতি ভারতে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা৷ ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান সৌরভ গাঙ্গুলী আমন্ত্রণ জানালে তা গ্রহণ করেন তিনি৷ পরবর্তীতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও তাঁকে আমন্ত্রণ জানান৷
শুক্রবার প্রধানমন্ত্রী কলকাতায় যান৷ প্রধানমন্ত্রীকে বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা জানান ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান সৌরভ গাঙ্গুলি৷ সেখানে মোদীর কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো মন্ত্রী বা প্রতিনিধি ছিলেন না, ছিলেন না পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিও৷ এ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের প্রভাবশালী বাংলা দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা ২৪ নভেম্বর একটি মন্তব্য প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যার শিরোনাম ছিল ‘মিত্র হাসিনার শীতল অভ্যর্থনা, কাঠগড়ায় দিল্লি’৷ পত্রিকাটি লিখেছে, ‘‘প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে কলকাতায় এলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা৷ কিন্তু তাঁকে স্বাগত জানাতে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে কোনও মন্ত্রী, এমনকি শীর্ষ আমলাকেও পাঠানো হয়নি৷ যা কি না বাঁধাধরা কূটনৈতিক প্রথা এবং সৌজন্যের বিরোধী৷’’
এর আগে গত অক্টোবরে ভারত সফরের সময়ে দিল্লি বিমানবন্দরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভ্যর্থনা জানান ভারতের সাংসদ তথা নারী ও শিশু কল্যাণ প্রতিমন্ত্রী দেবশ্রী চৌধুরী৷ সে সময় ‘হাসিনাকে অভ্যর্থনা জানাতে একজন মন্ত্রীও পাঠাননি মোদি’ শিরোনামে একটি খবর প্রকাশ করে অ্যানালাইসিস বিডি। যদিও ২০১৭ সালের সাত এপ্রিল ভারত সফরের সময় দিল্লি বিমানবন্দরে শেখ হাসিনাকে প্রটোকল ভেঙে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজেই অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন৷
আনন্দবাজার পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এনআরসি (নগরিকপঞ্জী) নিয়ে যাতে কোনো আলেচনা না ওঠে সেজন্য কেন্দ্রীয় সরকার শেখ হাসিনাকে এড়িয়ে গেছে৷ সংবাদমাধ্যমটি বাংলাদেশকে ভারতের ‘পরম মিত্র‘ হিসেবে উল্লেখ করে দেশটির কেন্দ্রীয় সরকারে এবারের উদাসীনতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে৷
বিশ্লেষকরা বলছেন, সম্প্রতি ভারত সরকার আসাম রাজ্যে জাতীয় নাগরিক নিবন্ধনের (এনআরসি) তালিকা প্রকাশ করেছে। সেখানে নাম না থাকায় নির্যাতনের ভয়ে বাংলাদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন ভারতীয়রা। ২০১৭ সালে ভারত যেমন মানবিকতার অজুহাত দেখিয়ে রোহিঙ্গাদের প্রবেশধিকার দিতে ইন্ধন জুগিয়ে ছিল। এবং পর্বর্তিতে দেশে সংকট সৃষ্টি করে কোনসহযোগিতায় এগিয়ে আসেনি। এবারও নিজ দেশ থেকে মুসলমানদের তাড়িয়ে দিয়ে বাংলাদেশে আরও একটি নতুন সংকট সৃষ্টি করতে চাইছে ভারতীয় এই সরকার। এজন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এড়িয়ে চলছে তারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক ড. এম শহীদুজ্জামান বলেন, ‘‘এবারের আচরণে আমার খুব খারাপ লেগেছে৷ আমি অবাক হয়েছি৷ বিমানবন্দরে অন্তত পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীতো আসতে পারতেন৷’’
তিনি বলেন, ‘‘আমার মনে হয় শুধু এনআরসি নয়, তিস্তা ইস্যুর কারণেও প্রধানমন্ত্রীকে এড়িয়ে গেছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার৷ আর তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বিষয় আছে৷ চীনকেও কিছু দেখাতে চায়৷ এনআরসি নিয়ে নতুন কোনো প্রচারণা হোক তারা হয়তো সেটা চায়নি৷”
তিনি বলেন, ‘‘তারা উষ্ণতা কম দেখাতে পারেন৷ কিন্তু আমাদের দিক থেকে কিন্তু প্রধানমন্ত্রী আন্তরিকতা দেখিয়েছেন৷ আমরা যে তাদের সাথে ভালো সম্পর্ক চাই তা বারবারই প্রমাণ করছি৷’’
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন এই প্রটোকলের বিষয়টি দেখেন সম্পর্ক ও যোগাযোগের ধরনের দিক থেকে৷ তিনি বলেন, ‘‘ইউরোপে যেটা হয়, এক দেশের সরকার প্রধান আরেক দেশে চট করে আধাঘন্টার নোটিশে চলে যান৷ সেখানে প্রটোকলের কোনো বিষয় থাকে না৷ কিন্তু আমাদের এলাকাতে একটু প্রটোকল সচেতন আমরা৷ আমি নিশ্চিত যে মোদী সাহেব যদি কেনো কারণে যাশোরে এসেও হাজির হন তাহলেও আমাদের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে অভ্যর্থনা দেয়া হবে৷’’
তিনি বলেন, ‘‘এবার অন্ততপক্ষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী রিসিভ করতে পারতেন৷ কিন্তু তাদের হয়তো আরো গুরুত্বপূর্ণ কোনো কাজ ছিলো৷ প্রটোকলটা আরেকটু বেটার হতে পারত৷’’
তিনি আরো বলেন, ‘‘কী কারণে এটা হয়েছে আমি জানি না৷ তাই মন্তব্য করতে পারব না৷ তবে ভারত ও চীনের সাথে আমাদের সম্পর্ক অনেকটা পরিপূরক৷ চীন থেকে এখন আমাদের এখানে যেসব বিনিয়োগ প্রস্তাব আসছে সেটা ভারতের পক্ষে সম্ভব নয়৷ কারণ ভারতইতো এখন গুড ইনভেস্টেমেন্টের জন্য পরনির্ভর৷’’
এদিকে ভারত সরকার নির্যাতনের ভয়ে ঝিনাইদহের মহেশপুর সীমান্ত দিয়ে নিয়মিতই অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে ভারতীয়রা। গত দুই সপ্তাহে মহেশপুর সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঢোকার সময় বিজিবির হাতে আটক হয়েছেন ২88 জন। রবিবারও বেনাপোল সীমান্তে ৩২ জনকে আটক করেছে বিজিবি। এ নিয়ে মোট আটকের সংখ্যা দাঁড়ালো ২৭৬ জনে।
এছাড়া যশোরের বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে গত ২০ নভেম্বর অবৈধভাবে অনুপ্রবেশের সময় বিজিবির হাতে আটক হয়েছে ৫৪ জন।
কিন্তু, সরকারের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম এসবকে গুজব বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। শনিবার রাজশাহীতে তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, ভারত থেকে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করার জন্য সীমান্তে কেউ আসেনি। অনুপ্রবেশ নিয়ে যেসব সংবাদ প্রচার হচ্ছে সবই গুজব।
কূটনৈতিকরা বলছেন, ক্ষমতাসীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী ভারতের ব্যাপারে উদার হলেও ভারত সরকার শেখ হাসিনাকে পাত্তায় দেন না। দেশে আরও একটি রোহিঙ্গা পরিস্থিতি তৈরী করতে চাচ্ছেন তারা। বিজিবি চাইলে অনুপ্রবেশকারীদের পুশব্যাক করে ফেরত দিতে পারে। কিন্তু তা না করে তাদের গ্রেফতার করে পুলিশের কাছে পাঠাচ্ছে। পুলিশ তাদেরকে বিভিন্ন কারাগারে পাঠিয়ে দিচ্ছে যাতে তারা আইনের ফাঁক ব্যবহার করে জামিনে মুক্তি পেলে এসব ভারতীয়রা দেশেই থেকে যেতেপারে।
তারা বলছেন, মোদি সরকারের এমন আচরণ নতুন নয়। সম্প্রতি সময় পেঁয়াজ সংকটও তৈরী করেছে মোদি সরকার। এছাড়া তিস্তা বাঁধসহ বিভিন্ন ইস্যুতে মিত্র মোদীর উল্টো চরিত্র ফুটে ওঠে।