উমার
বাংলাদেশের মানুষ সাধারণত ধর্মপরায়ণ। এজন্য তারা ধর্মীয় শিক্ষা তথা মাদরাসা শিক্ষার প্রতি অনুরক্ত। নিজেরা মাদরাসায় পড়তে না পারলেও যারা মাদরাসায় পড়তে চায় তাদেরকে নানাভাবে সাহায্য করে। এ প্রসংগে স্মরণ রাখতে হবে এ দেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ বটে কিন্তু কর্মবিমুখ ও অলস নয়। তারা যুগ জিজ্ঞাসা ও জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রতি উদাসীন নয়। এক কথায় বলা যায় তারা প্রগতিশীল ধর্মপ্রাণ মানুষ। এজন্য তারা চায় যুগোপযোগী কর্মমুখী শিক্ষা সম্বলিত মাদরাসা শিক্ষা ব্যব্স্থা। এরূপ শিক্ষা ব্যবস্থা কাঙ্ক্ষিত স্তরে পৌঁছুতে পারেনি বলেই অনেক অভিভাবক নিজ সন্তানকে মাদরাসায় না পাঠিয়ে সাধারণত শিক্ষা ধারার স্কুলে ভর্তি করে। মাদরাসাগুলো আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার কেন্দ্র হয়ে উঠলে এ শিক্ষা ব্যবস্থাই হয়ে উঠতো দেশের জনসংখ্যার বৃহৎ অংশের শিক্ষাব্যবস্থা।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় ২০০২ সালের ১২ জানুয়ারি এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে মাদরাসা শিক্ষাকে যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে একটি কমিটি গঠন করে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড: মুহাম্মদ মুস্তাফিজুর রহমানসহ ইসলামী শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট অনেকেই এ কমিটিতে ছিলেন। কমিটি মাদরাসা শিক্ষাকে যুগোপযোগী করে সাধারণ শিক্ষার সাথে সমমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে দাখিল ও আলিম স্তরের পাঠক্রম ও পাঠ্যসূচী সংশোধন ও পরিমার্জন করে, সাধারণ শিক্ষার সাথে মাদরাসা শিক্ষার বিরাজমান বৈষম্য নিরসন করার পথ নির্দেশ করে, এবতেদায়ী মাদরাসার সমস্যাবলী চিহ্নিত করে তা দূরীকরণের জন্য সুপারিশসহ ফাযিল ও কামিল পর্যায়ে ডিগ্রিও মাস্টার ডিগ্রি প্রদানের জন্য একটি এফিলিয়েটিং ক্ষমতাসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করে। আশা করা হচ্ছে, কমিটির এই রিপোর্টে যে সুপারিশসমূহ প্রদান করা হয়েছে বর্তমান সরকার তা বাস্তবায়িত করে ৬৩ বছর আগে মরহুম শেরেবাংলার কণ্ঠে মাদরাসা শিক্ষার উন্নয়ন ও মাদরাসা ছাত্রদের জন্য এফিলিয়েটিং ক্ষমতাসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত যে ঘোষণা উচ্চারিত হয়েছিলো তাকে বাস্তব রূপ দেবে।
অধিকাংশ মাদরাসা ব্যক্তি উদ্যোগে এবং জনগণের দানে প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় এগুলোতে অর্থনৈতিক জবাবদিহিতা থাকে না বললেই চলে। সরকারি বিধিনিষেধ পালন করতে গিয়ে অনেক মাদরাসায় দুই ধরনের কাগজপত্র রাখা হয়। প্রথম দফা কাগজপত্রে থাকে প্রকৃত অবস্থা। আর দ্বিতীয় দফা কাগজপত্র তৈরি করা হয় সরকারী হিসেবের জন্য। ফলে দুর্নীতির আশ্রয় নেয়া সংশ্লিষ্টদের জন্য সহজ হয়ে পড়ে। অধিকাংশ মাদরাসা আর্থিক দৈন্যের মধ্যে থাকলেও মাদরাসা পরিচালনার সঙ্গে জড়িতদের অনেকের আর্থিক অবস্থা বেশ সচ্ছল। জনগণের দান খয়রাতের সঠিক হিসাব কর্তৃপক্ষের কাছে অধিকাংশ মাদরাসা প্রধানই দেন না বলে অভিযোগ শোনা যায়। মাদরাসা বোর্ডের দুর্নীতি নিয়েও অনেক অভিযোগ রয়েছে। টাকা না দিলে সেখানে কোনো কাজ হয় না একথা ভুক্তোভোগীদের বলতে শোনা যায়। তবে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের পরিদর্শক আবদুল ওয়াদুদ বলেন, ‘বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর মাদরাসা শিক্ষার প্রতি বিশেষ নজর দিচ্ছে। মাদরাসা বোর্ড এখন অনেকাংশেই দুর্নীতিমুক্ত হয়েছে।’
কমিটির কতিপয় সুপারিশ: মাদরাসা শিক্ষার মান উন্নয়ন ও যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে গঠিত কমিটি কপিতয় সুপারিশ করেছে।
সুপারিশসমূহ হলো:
১. স্কুলের ৮ম শ্রেণীর সরকারি বৃত্তির ন্যায় মাদরাসার ৮ম শ্রেণীতে সমহারে বৃত্তি প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ।
২. স্কুলের ন্যায় মাদরাসার দাখিল ৯ম ১০ম শ্রেণীতে ৫০% অবজেক্টিভ পদ্ধতির প্রশ্নোত্তরের ব্যবস্থা গ্রহণ।
৩. এসএসসি’র ন্যায় দাখিল পরীক্ষার গ্রেডিং পদ্ধতিতে ৬টি গ্রুপের পরিবর্তে ৮টি গ্রুপের মাধ্যমে ফলাফল নির্ধারণ ও অবিলম্বে তা বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ।
৪. দাখিল ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত যেসব মাদরাসায় প্রতি শ্রেণীতে ৬০ জনের ঊর্ধ্বে শিক্ষার্থী আছে সে সব মাদরাসায় স্কুলের ন্যায় শ্রেণী শিক্ষকের পদসহ শ্রেণী শাখা খোলার ব্যবস্থা গ্রহণ।
৫. আলিম শ্রেণী পর্যন্ত সাধারণ শিক্ষার ন্যায় মেয়েদের উপবৃত্তির ব্যবস্থাসহ বিনা বেতনে লেখাপড়ার সুযোগ সৃষ্টি করা।
৬. উচ্চ মাধ্যমিক কলেজের ন্যায় আলিম বিজ্ঞান শাখার জন্য ল্যাবরেটরি প্রদর্শক পদ সৃষ্টিকরণ ও অবিলম্বে নিয়োগের আদেশ দান।
৭. মাদ্রাসা শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের ‘ইন-সার্ভিস প্রশিক্ষণ’কে সার্টিফিকেট কোর্স হিসেবে মূল্যায়ণ এবং এই প্রশিক্ষণের ওপর ভিত্তি করে ৫ বছর শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থাকলে বি.এড-এর সমমানের আর্থিক সুযোগসহ চাকরি মূল্যায়নের ব্যবস্থা গ্রহণ।
৮. মাদ্রাসা শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট প্রজেক্ট এর পি.পি. অনুসারে প্রত্যেক সেশনে ২ ব্যাচে ২শত শিক্ষকের প্রশিক্ষণ নিশ্চিতকরণ।
৯. মাদ্রাসা শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট প্রজেক্ট এর আওতায় চাকরিরত মাদরাসা শিক্ষকদের জন্য ‘ইন-সার্ভিস’ ও চাকরি পূর্ব ‘ডিপ্লোমা’ কোর্সের প্রশিক্ষণের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও ‘আরবি’ বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর মুহাম্মদ মুস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে সাব-কমিটির মাধ্যমে যে কোর্স কারিকুলাম ১৯৯৫ সালে প্রস্তুত করা হয়েছিলো তা অবিলম্বে বাস্তবায়নের ব্যবস্থা গ্রহন।
১০. সাধারণ শিক্ষার নিন্ম মাধ্যমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক কর্মচারী নিয়োগের বিষয়ভিত্তিক পদসহ দাখিল ও আলিম মাদরাসার বেতন বৈষম্য দূরীকরণ।
১১. সকল স্তরের মাদরাসায় স্কুল-কলেজের ন্যায় সমপরিমাণ আর্থিক ব্যয়ে ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ এবং কম্পিউটারসহ শিক্ষা সামগ্রী ও শিক্ষা উপকরণ সরবরাহের ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ।
১২. আলিম পাস ছাত্র-ছাত্রীদের উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সকল বিষয়ে ভর্তির নিশ্চয়তা বিধান করা।
১৩. মাদ্রাসা শিক্ষার ফাজিল এবং কামিল শ্রেণীকে ¯œাতক এবং ¯œাতকোত্তর ডিগ্রি প্রদানের বিষয়টি অবিলম্বে নিশ্চিকরণ।
১৪. মাদ্রাসাসমূহের আর্থিক ব্যবস্থাপনা পরিচালনার জন্য বর্তমানের একটি বিশেষ ব্যবস্থার পরিবর্তে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের ন্যায় একটি পূর্ণাঙ্গ ডাইরেক্টরেট প্রতিষ্ঠা করে অবিলম্বে মাদরাসাসমূহের নিয়ন্ত্রণ অর্পণ।
১৫. মাদ্রাসার শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন ইত্যাদি ক্ষেত্রে উন্নয়নের জন্য মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডেও কারিকুলামও সিনিয়র কারিকুলাম স্পেশালিস্টের দু’টি পদ সৃষ্টি করার জন্য সুপারিশ করা হলো।
মাদরাসা শিক্ষা বর্তমানে দেশের জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার একটি অবিচ্ছেদ্য অংগ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু এরূপ অবস্থা পূর্বে ছিলো না। পূর্বে মাদরাসা শিক্ষা ছিলো খুবই অবহেলিত ও অনাদৃত। স্বাধীনতার পরে মাদরাসার ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবক এবং সরকারের যৌথ প্রয়াসে ধীরে ধীরে মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নতির পথে অগ্রসর হয়। কিন্তু মাদরাসা শিক্ষা কাক্সিক্ষত স্তরে কখনও পৌঁছেনি। সাধারণ শিক্ষা ধারার ন্যায় মাদরাসা শিক্ষা ধারাও ১৬ বছরের ৫টি স্তরে যথা- প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক,ডিগ্রি ও মাস্টার ডিগ্রি স্তরে বিভক্ত। উচ্চ শিক্ষায় ডিগ্রি ও মাস্টার ডিগ্রি স্তরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীনে সহস্রাধিক ডিগ্রি ও মাস্টার ডিগ্রি কলেজ আছে।
মাদরাসা শিক্ষা ধারায়ও প্রায় অনুরূপসংখ্যক ফাযিল ও কামিল মাদরাসা আছে। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ৯৬ সালের এক রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ফাযিল মাদরাসার সংখ্যা ৮৫১ এবং কামিল মাদরাসার সংখ্যা ৯৯। তবে এ সংখ্যা বর্তমানে আরও বেড়েছে। এ রিপোর্টে আরও দেখা যায় যে, দেশের মোট ছাত্র সংখ্যার ৩০% মাদরাসা ছাত্র।
বর্তমান বছরে ফাযিল পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ২৪ হাজার এবং কামিল পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ৯ হাজার। ডিগ্রি ও মাস্টার ডিগ্রি কলেজের ছাত্র সংখ্যার তুলনায় এ সংখ্যা অপ্রতুল। এর কারণ, ফাযিল ও কামিল মাদরাসা অনুমোদন দানকারী কোনো বিশ্ববিদ্যালয় না থাকায় ছাত্ররা ফাযিল শ্রেণীতে ভর্তি না হয়ে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিড় জমায়। এছাড়া বিগত সরকারের শুভ দৃষ্টির অভাব ও মাদরাসার ক্ষেত্রে বিরাজমান বৈষম্যের কারণে অনেক মাদরাসা ছাত্র মাদরাসায় অধ্যয়নে আগ্রহবোধ করে না।
আজকের দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে চলমান প্রক্রিয়ায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে যে অবিশ্বাস্য বৈপ্লবিক উন্নতি সাধিত হয়েছে, তার জন্য বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশ এক কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। এদেশের শিক্ষিত সমাজকে এর মোকাবিলা করতে হবে। প্রতিযোগিতাপূর্ণ এ বিশ্বে টিকে থাকা এক কঠিন ব্যাপার।
এদেশের অন্যান্য শিক্ষিত সমাজের ন্যায় মাদরাসার শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিদেরও এ ব্যাপারে সমানভাবে এগিয়ে ব্যক্তিদেরও এ ব্যাপারে সমানভাবে এগিয়ে আসতে হবে। মাদরাসার পাঠক্রম ও পাঠ্যসূচীকে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিসম্মত এবং যুগোপযোগী করে গতিশীল করতে হবে। এজন্য বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডকে প্রয়োজনীয় ও উপযুক্ত লোকবল দ্বারা সুসজ্জিত করতে হবে। অবিলম্বে একটি এফিলিয়েটিং ক্ষমতাসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে মাদরাসায় উচ্চতর শিক্ষাক্ষেত্রে সর্বাধুনিক কলা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার প্রসার ঘটাতে হবে।