হাসান রূহী
গত ৩ এপ্রিল র্যাবের সাথে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ জেএসএস সন্তুলারমা গ্রুপের সন্ত্রাসী জ্ঞান শংকর চাকমা নিহত হয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। এ সময় ৭টি এসএমজি, নগদ অর্থ ও বেশ কিছু সামরিক সরঞ্জাম উদ্ধার করে র্যাব। র্যাবের দাবি অনুযায়ী এই জ্ঞান শংকর গত ১৮ মার্চ বাঘাইছড়ি হত্যাযজ্ঞের সন্দেহভাজন।
জ্ঞান শংকরের বাহিনীর সাথে র্যাবের এই বন্দুকযুদ্ধে উদ্ধারকৃত অন্য অস্ত্রশস্ত্রের মধ্যে রয়েছে ৪৩৭ রাউন্ড গুলি, ১১ রাউন্ড ব্যবহৃত গুলির খোসা এবং ৪ লাখ ৩৬ হাজার নগদ টাকা। সাতজন মানুষের রক্তে হোলি খেলা সন্ত্রাসীর এ বিদায় কোনো সুখের খবর দিয়ে গেল বলে যারা মনে করছেন, তারা আসলেই বসবাস করছেন এক বোকার স্বর্গে। অন্যান্য ‘বন্দুকযুদ্ধ’ কিংবা ‘ক্রসফায়ার’ এর মত এটি কোনো নাটক নয় তা বলে উড়িয়ে দেয়ার সুযোগও কম।
নাটক হোক কিংবা বাস্তবই হোক চলুন আমরা বুঝার চেষ্টা করি নিহত জেএসএস সন্ত্রাসী জ্ঞান শংকর কি জ্ঞান দিয়ে গেলেন। অনুধাবনের চেষ্টা করি কি বার্তা দিয়ে গেলেন তিনি!
=> কেন আপত্তিকর ছিল পার্বত্য শান্তিচুক্তি?
১৯৯৭ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ষড়যন্ত্রে পা দিয়ে নোবেল প্রাইজের লোভে লোভাতুর হয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার শান্তি চুক্তির নামে এক আজগুবি চুক্তি করে বসে। যার আপত্তিকর অংশগুলোর বিরোধীতা করেছিল তৎকালীন বিরোধী দল বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ বেশকিছু দেশপ্রেমিক ও সচেতন সংগঠন। কিন্তু তাতে কোন প্রকার কর্ণপাত না করে তড়িঘড়ি করে চুক্তি সম্পাদন করে আ. লীগ। আর আজ এর সুদূর প্রসারী ফল ভোগ করছে বাংলাদেশ।
কথিত ওই শান্তিচুক্তির সবচেয়ে আপত্তিকর অংশ ছিল সেনাবাহিনী প্রত্যাহার সংক্রান্ত ধারা। যা দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য চরম উদ্বেগজনক একটি ধারা।
কথিত ওই শান্তিচুক্তির ১৭ এর (ক) ধারায় বলা হয়েছে- ‘সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে চুক্তি সই ও সম্পাদনের পর এবং জনসংহতি সমিতির সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরত আসার সাথে সাথে সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিডিআর) ও স্থায়ী সেনানিবাস (তিন জেলা সদরে তিনটি এবং আলী কদম, রুমা ও দীঘিনালা) ব্যতীত সামরিক বাহিনী, আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সকল অস্থায়ী ক্যাম্প পার্বত্য চট্টগ্রাম হইতে পর্যায়ক্রমে স্থায়ী নিবাসে ফেরত নেওয়া হইবে এবং এই লক্ষ্যে সময়সীমা নির্ধারণ করা হইবে। আইন-শৃঙ্খলা অবনতির ক্ষেত্রে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ে এবং এই জাতীয় অন্যান্য কাজে দেশের সকল এলাকার ন্যায় প্রয়োজনীয় যথাযথ আইন ও বিধি অনুসরণে বেসামরিক প্রশাসনের কর্তৃত্বাধীনে সেনাবাহিনীকে নিয়োগ করা যাইবে। এই ক্ষেত্রে প্রয়োজন বা সময় অনুযায়ী সহায়তা লাভের উদ্দেশ্যে আঞ্চলিক পরিষদ যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ করিতে পারিবেন।’
(খ) তে বলা হয়েছে- ‘সামরিক ও আধা-সামারিক বাহিনীর ক্যাম্প ও সেনানিবাস কর্তৃক পরিত্যক্ত জায়গা-জমি প্রকৃত মালিকের নিকট অথবা পার্বত্য জেলা পরিষদের নিকট হস্তান্তর করা হইবে।’
প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী বাংলাদেশের কোথায় স্থায়ী সেনাক্যাম্প করবে কিংবা কোথায় অস্থায়ী সেনাক্যাম্প করবে তার নির্দেশনা বাংলাদেশ সরকার জেএসএস এর মত সন্ত্রাসী সংগঠনের কাছ থেকে কেন নেবে? কোথায় সেনাবাহিনী থাকবে আর কোথা থেকে প্রত্যাহার করতে হবে তা কেন অস্ত্র, মাদক, চোরাচালান আর সন্ত্রাসের গডফাদার সন্তুলারমা বলবে?
এদেশের দেশপ্রেমিক জনগণ এই অন্যায্য চুক্তি সম্পাদনের আগেই এসব প্রশ্ন তুলেছিল। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। কারণ ক্ষমতাসীন নেত্রীর চোখে তখন ছিল নোবেল প্রাইজের স্বপ্ন মাখানো রঙিন চশমা। ফলে অস্ত্র সমর্পনের নাটক মঞ্চস্থ করার ২২ বছর পরে এসে পুরনো থ্রিনটথ্রি রাইফেলের বদলে জেএসএস সন্ত্রাসীদের হাতে দেখা যাচ্ছে চকচকে অত্যাধুনিক সব সমরাস্ত্র।
=> পাহাড়ে এখন যা হচ্ছে
জেএসএসের অস্ত্র সমর্পণের সময় চুক্তির বিরোধিতা করে অস্ত্র সমর্পণ না করে তাদেরই একটি অংশ জেএসএস থেকে বেরিয়ে গিয়ে ইউপিডিএফ নামে নতুন সংগঠন গড়ে তোলে। যা পুনরায় ভেঙ্গে হয় ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক। এরপর স্বার্থগত দ্বন্দ্বে জেএসএসও ভেঙে জেএসএস (এমএন লারমা) নামে নতুন আরো একটি সংগঠন তৈরি হয়।
এরা পাহাড়ে বসবাসকারীদের কাছ থেকে আদায় করছে বিপুল অংকের চাঁদা। তা দিয়ে সশস্ত্র গ্রুপকে শক্তিশালী করছে। গোপনে বিদেশ থেকে কেনা হচ্ছে ভারি, দামি ও অত্যাধুনিক অস্ত্র। সামরিক আদলে কাঠামো তৈরি করে নিজেদের সংগঠিত করছে। হঠাৎ করে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের জেএসএস, ইউপিডিএফ ও জেএসএস সংস্কারপন্থি গ্রুপ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। গত কয়েক মাস থেকে পাহাড়ে এমন এক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এদের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করার কারও সাহস নেই। যদি জানতে পারে কেউ অভিযোগ করেছে- তাহলে পরের দিন তার লাশ ফেলে দেয়া হচ্ছে অথবা অপহরণ করা হচ্ছে। দুর্গম এলাকা হওয়ায় এসব খবর বেশিরভাগ সময়ই মিডিয়ায় আসে না।
তারা বিভিন্ন দেশ থেকে অত্যাধুনিক অস্ত্র সংগ্রহ করছে। আর অস্ত্র কেনা ও নিজেদের সংগঠন চালানোর জন্য তারা চাঁদা আদায় করছে সাধারণ মানুষ, চাকরিজীবী ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে । ফলে জিম্মি হয়ে পড়েছে তিন পার্বত্য জেলার সাধারণ মানুষ। প্রাণ ভয়ে তারা কেউই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে যান না।
তারা বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পোশাক ব্যবহার করে থাকে। এর মধ্যে জেএসএস (সন্তু) গ্রুপের রয়েছে প্রায় ৯শ’ জন সশস্ত্র সন্ত্রাসী।
তাদের অধীনে রয়েছে সামরিক কায়দায় ৬টি কোম্পানি। জেএসএস (সংস্কার) এর রয়েছে ২টি কোম্পানি। তাদের সশস্ত্র সন্ত্রাসীর সংখ্যা প্রায় পৌনে ৩শ’। আর ইউপিডিএফ এর ৪টি কোম্পানির অধীনে রয়েছে প্রায় ৭শ’ সশস্ত্র সদস্য।
তাদের রয়েছে নিজস্ব সেনাপ্রধান, আলাদা আলাদা কোম্পানি, বিভিন্ন উইং, শরীরে থাকে বাহিনীর পোশাক, হাতে অত্যাধুনিক ওয়াকিটকি, কাঁধে চকচকে ভারি ও দামি অস্ত্র। তারা প্রত্যেকেই প্রশিক্ষণ পাওয়া দক্ষ ও ক্ষিপ্র। ভারত ও মিয়ানমারের সীমান্তঘেঁষা পাহাড়ের দুর্গম অঞ্চলগুলোতে তাদের বিচরণ।
শুধু পোশাক আর অস্ত্র নয় তাদের রয়েছে নিজস্ব পরিচয়পত্র, মুদ্রা ও পতাকা। পাহাড়ে জুম্মল্যান্ড ও স্বায়ত্তশাসিত সরকার গঠনকে টার্গেট করে নীরবে সশস্ত্র কার্যক্রম পরিচালনা শুরু করেছে এই সশস্ত্র সংগঠনগুলো। এ সব সংগঠনগুলো ফেসবুক, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে নিজেদের পতাকা, মুদ্রা ও পরিচয়পত্রের প্রচারণা চালাচ্ছে।
=> চাঁদাবাজির মহোৎসব
পাহাড়ে আঞ্চলিক এসব দলগুলোর বেপরোয়া চাঁদাবাজি চলছে। গাড়িপ্রতি চাঁদা দিতে হয়। পুলিশকে বলেও কোনো লাভ হয় না। চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে সন্ত্রাসীরা প্রায়ই গাড়ি ভাঙচুর করছে। উপজাতিদেরও এ চাঁদা দিতে হয়। তাদের কাছে অবৈধ অত্যাধুনিক অস্ত্র থাকায় এসব অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে চাঁদাবাজি করা হচ্ছে।
তিন পার্বত্য জেলায় জেএসএস (সন্তু), জেএসএস (সংস্কার) ও ইউপিডিএফ ধার্যকৃত চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালেই শুরু হয় অপহরণ, নির্যাতন, নিপীড়ন, হত্যা, ধর্ষণ। পুড়িয়ে দেওয়া হয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাড়ি-ঘর, যানবাহন। নাকের ডগায় বসে অনেকটা ফ্রি-স্টাইলে এই চাঁদাবাজি চললেও কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না প্রশাসন। যারা ব্যবস্থা নিবেন সেই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও বেতনের ১০-১৫ শতাংশ চাঁদা দিতে হয় তিনটি গ্রুপকে।
প্রতিদিনই পার্বত্য অঞ্চল থেকে উপজাতি সশস্ত্র গ্রুপগুলো এক থেকে দেড় কোটি টাকার চাঁদা আদায় করছে। বছর শেষে যার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৪০০ কোটি। এ ছাড়া পাহাড়ের আঞ্চলিক সংগঠনগুলো চাঁদার এ অর্থ দিয়ে দেশ-বিদেশে দেশবিরোধী প্রচারণা ও তাদের অস্ত্র ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করার কাজ করে থাকে বলেও জানা যাচ্ছে।
=> জ্ঞান শংকর যে জ্ঞান দিয়ে গেলেন
চুক্তি হয়েছে। কিন্তু সে চুক্তি মানা হয়নি। অস্ত্র ছিল, অস্ত্র আছে, দিন দিন অত্যাধুনিক অটোমেটিক সমরাস্ত্র যুক্ত হচ্ছে পার্বত্য অঞ্চলে ঘাপটি মেরে থাকা সন্ত্রাসীদের অস্ত্রাগারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের সার্বভৌমত্ব খর্ব করে মহান জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে ১১৯টি সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করার ঘোষণা দেয়ার মত ধৃষ্টতা প্রদর্শন করেছেন। বাকীগুলোও কয়েক ধাপে প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু সেনা প্রত্যাহার কি সমাধান এনে দেবে? নাকি ভয়ানক কোনো ঝুঁকিতে ফেলবে বাংলাদেশকে? সে চিন্তা এখনই করতে হবে আমাদের।
গত ১৮ মার্চ রাঙামাটির বাঘাইছড়ির সাজেকে নির্বাচনী দায়িত্ব পালন শেষে ফেরার পথে নির্বাচনসংশ্লিষ্ট লোকজনের ওপর সন্ত্রাসী হামলা চালানো হয়। হামলায় প্রিসাইডিং কর্মকর্তাসহ সাতজনকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় গুরুতর আহত হন আরও ১৯ জন। র্যাবের দাবি অনুযায়ী এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের ঘটনার প্রধান সন্দেহভাজন ছিলেন জ্ঞান শংকর চাকমা।
প্রশ্ন হচ্ছে এই ঘটনার জন্ম দিয়ে দেশের মানুষকে কি বার্তা দিলেন জেএসএস সন্ত্রামী জ্ঞান শংকর? উত্তর খুবই সহজ, সরল। কিন্তু সেই সহজ-সরল বার্তা বুঝতে দেরী করলে পস্তাতে হবে বাংলাদেশকে।
জ্ঞান শংকরের বার্তা বলে দেয়, শান্তি চুক্তি হলেও সে চুক্তিকে থোরাই কেয়ার করেন তারা। এতে তাদের ভয়ঙ্কর মারণাস্ত্রের আমদানি, ট্রেনিং, সন্ত্রাসী কার্যক্রম ও এসবের আঞ্জাম দিতে অবৈধ চাঁদাবাজি কোনোটিই বন্ধ হয়নি, হবে না। বরং সেনাবাহিনীর অবস্থান শিথিল করার প্রতিটি সুবিধা গ্রহণ করে তারা বহুগুনে বৃদ্ধি করেছে রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতা।
জ্ঞান শংকরের সাথে থাকা বিপুল অস্ত্র, গোলাবারুদ আর অর্থ পরিস্কারভাবে সে বার্তা দেয়। বার্তা দেয় ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও এদেশের কথিত কিছু বামপন্থী সুশীল নামধারী কুলাঙ্গারের পরিকল্পনায় স্বাধীন জুম্মল্যান্ড ঘোষণার। বিশ্বব্যাপি নিজস্ব পরিচয়পত্র, মুদ্রা ও পতাকার প্রচার চালিয়ে তারা ভেতরে ভেতরে অনেক দূরই অগ্রসর হয়েছে তা অস্বীকার করার সাহস বর্তমান সরকারের নেই।
=> করণীয় কি?
চুক্তি সাক্ষরিত হয়েছে দীর্ঘ ২২ বছর। কিন্তু শান্তিবাহিনী তবুও অবৈধ অস্ত্র ত্যাগ করে শান্তিতে ফিরে আসেনি। সরকারি সবধরনের সুযোগ সুবিধা ভোগ করে রাষ্ট্র বিরোধীতা সহ ভয়ানক সন্ত্রাসী কার্যক্রম করে যাচ্ছে। বরং তারা একাধিক ভাগে বিভক্ত হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্ত্রবাজি, খুন, অপহরণ, চাঁদাবাজি সহ প্রতিনিয়ত রাষ্ট্রদ্রৌহিতা কর্মকান্ডে জড়িত রয়েছে। ১৯৭৭ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৪২ বছর পার্বত্য চট্টগ্রামে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কথিত শান্তিবাহিনীসহ চুক্তি বিরোধী সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠন ইউপিডিএফ নির্মূল করতে তেমন কোন দৃশ্যমান সফলতা দেখাতে পারেনি।
এ পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী সহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ৬১২ জন সদস্য প্রাণ হারিয়েছেন। বাঙালি নিহত হয়েছেন ৩৫ হাজারেরও বেশি।
পূর্বে শান্তিবাহিনীর সংখ্যায় ছিলো অনেক কম। বর্তমানে শান্তিবাহিনী ও ইউপিডিএফ এর কমপক্ষে ১০ হাজারেরও অধিক অস্ত্রধারী সদস্য রয়েছে। যাদের জন্ম পাহাড়েই। ফলে তারা সেনাবাহিনীর বিপরীতে যুদ্ধ করে কিভাবে টিকে থাকতে হয় তা ভালোভাবেই রপ্ত করে থাকে। এমতাবস্থায় পাহাড়ে সেনাবাহিনীর পূর্ণ ক্ষমতা ফিরিয়ে দেয়ার পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান অবস্থার বাস্তবতা স্টাডি করে কৌশল নির্ধারণ করার স্বাধীনতা তাদের দেয়ার কোনো বিকল্প নেই।
পাহাড়ে বসবাসকারী উপজাতিদের সবাই সন্ত্রাসী কার্যক্রমে জড়িত নয়। বলতে গেলে অধিকাংশই শান্তিপ্রিয় মানুষ। তাদের সহযোগিতা ও গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধির মাধ্যমে নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী সন্ত্রাসীদের আইনের শাসনের আওতায় আনা এখন অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু দেশ ও দেশের সার্বভৌমত্বের স্বার্থে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে এখন সেই চ্যালেঞ্জটিই গ্রহণ করতে হবে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাড়া সারাদেশে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যাপারে প্রশাসনের যে দৃষ্টিভঙ্গি, সেই একই দৃষ্টিভঙ্গি যদি পার্বত্য চট্টগ্রামেও না থাকে তবে সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসীদের অপকর্মের দায় প্রশাসনকেই নিতে হবে। বিগত কয়েক দশক ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামে যে লাশের মিছিল, সে মিছিল তৈরীতে প্রশাসনের রহস্যজনক নীরবতাকে দায়ী না করার কোনো সুযোগ আছে কি?
পার্বত্য চট্টগ্রামে অবস্থানকারী বাঙালীরা যতটা অভিযোগ উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে করেন, তারচেয়ে প্রশাসনের বিরুদ্ধে তাদের অভিযোগ কোনো অংশেই কম নয়। পাহাড়ে মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নেই। প্রতিটি মুহূর্ত কাটে ভয়ে আতঙ্কে। তাদের অভিযোগ এখানে মানুষ সন্ত্রাসী কর্তৃক খুন, অপহরণ, চাঁদাবাজির শিকার হলে মামলা করতে গেলে পুলিশ মামলা নেয় না।
কোন সন্ত্রাসীকে সেনাবাহিনীসহ যৌথবাহিনী হাতেনাতে অস্ত্রসহ আটক করে পুলিশকে দিলে পুলিশ মামলার সাক্ষী হতে চায় না। মামলার সঠিক তদন্তপূর্বক চার্জশিট প্রদান করেনা পুলিশ। অনেক সময় অস্ত্রধারী আসামীর সঠিক ভেরিফাই করা হয়না। এসব মামলায় পুলিশের তেমন লাভ হয়না বলে পুলিশের এমন অনীহা। এমনটা জানা গেছে পার্বত্য অঞ্চলে নিয়োজিত থাকা পুলিশ কর্মকর্তাদের থেকেই।
এসব কারণে উপজাতীয় সন্ত্রাসীরা অস্ত্র মামলা থেকে খুব সহজে মুক্তি লাভ করে। সেনাবাহিনীর একাধিক উর্দ্ধতন কর্মকর্তা বলেন, সেনাবাহিনী এতো কষ্ট করে অস্ত্রসহ সন্ত্রাসী চাঁদাবাজদের আটক করে। অথচ সাপ্তাহ-মাস অতিবাহিত হওয়ার আগে জামিনে চলে আসে সন্ত্রাসী চাঁদাবাজরা। এসে পূর্ণরায় অবৈধ অস্ত্র নিয়ে সন্ত্রাসী তৎপরতায় জড়িয়ে পরে। অনেক সময় দেখা যায় সেনাবাহিনী অপরাধী আটক করে থানায় দিলে পুলিশ ছেড়ে দেয়!
নেতৃত্বে উপজাতীয় জনপ্রতিনিধি থাকার কারণে প্রশাসন একপ্রকার জিম্মি সন্ত্রাসীদের কাছে। পার্বত্য শান্তি চুক্তির কারণে এইখানে সব ক্ষমতার মালিক উপজাতীয়রা। প্রশাসন উপজাতীয়দের কথার বাহিরে বিন্দুমাত্রও যেতে পারে না। এমনকি সেনাবাহিনী ও পুলিশের উপর গুলিবর্ষণ হলেও মামলা হয়না।
প্রতিবেশী দুটি রাষ্ট্রের সীমান্ত পথে প্রতিদিনই আসছে অবৈধ অস্ত্র ও মাদক। কিন্তু তা ঠেকাতে প্রশাসনের দৃশ্যমান ক্ষমতা খুবই হতাশাজনক। এভাবে চলতে থাকলে পার্বত্য চট্টগ্রামের নিয়ন্ত্রণ অচিরেই বহিঃশত্রুর হাতে চলে যাবে তা হলফ করে বলা যায়।
তাই এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় করণীয় হলো-
১। অবৈধ অস্ত্র ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স আনতে হবে।
২। সীমান্ত পাহাড়ায় অনেক বেশী আন্তরিক হতে হবে।
৩। অত্যাধুনিক প্রযূক্তির ব্যবহারে সন্ত্রাসীদের গতিবিধির উপর কড়া নজরদারি রাখতে হবে।
৪। উপজাতীয় জনগণের সাথে সুসম্পর্ক বৃদ্ধির পাশাপাশি সন্ত্রাস দমনে তাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা গ্রহণ করতে হবে।
৫। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের ষড়যন্ত্রমূলক গোয়েন্দা তৎপরতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিজেদের গোয়েন্দা তৎপরতার সক্ষমতা প্রমাণ করতে হবে।
৬। পাহাড়ে নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে সেনাবাহিনীর পরামর্শ অনুযায়ী পর্যাপ্ত অস্থায়ী সেনাক্যাম্প স্থাপন করতে হবে।
৭। শান্তিপ্রিয় পাহাড়ি জনগণকে যারা ভুল বুঝিয়ে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে উদ্বুদ্ধ করছে সেসব রাষ্ট্রদ্রোহীদের চিহ্নিত করে আইনের হাতে সোপর্দ করতে হবে। একই সাথে পুলিশ, বিডিআর, আনসারসহ বিভিন্ন নিরাপত্তা বাহিনীদের চাকরির সুযোগপ্রাপ্ত উপজাতীয় ব্যক্তিদের মধ্য হতে কেউ যাতে সন্ত্রাসীদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা না করে তা নিশ্চিত করতে হবে।
৮। পাহাড়ী অঞ্চলে পর্যটন স্পট বৃদ্ধির পাশাপাশি আগত বিদেশী নাগরিকদের ওপর কড়া নজরদারি রাখতে হবে। খ্রিস্টান মিশনারীদের ধর্মান্তর প্রক্রিয়ার দিকে বিশেষভাবে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
৯। পাহাড়ী ও বাঙালিদের মধ্যে সংঘাত নয়, সৌহার্দ্য বৃদ্ধিতে সরকারি ভাবে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে।
১০। যেহেতু পার্বত্য সন্ত্রাসীরা বারবার পার্বত্য শান্তি চুক্তি ভঙ্গ করছে, সেহেতু এ শান্তিচুক্তি থেকে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের সাথে সাংঘর্ষিক ধারাগুলো বাদ দিতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট