ড. আবদুল লতিফ মাসুম
বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্বাভাবিকতা বলতে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। সবটাই এখন ষড়যন্ত্র, কুটিলতা ও প্রতারণা। রাজনীতি বলতে আমরা যে শুভ্রতা, সততা ও সেবার কথা বুঝি তা এখন অবলুপ্ত প্রায়। আভিধানিকভাবে পলিটিক্স বা রাজনীতি যে স্বতসিদ্ধ সংজ্ঞা দেয়, এখন তা আর প্রযোজ্য নয়। আগে ‘ভিলেজ পলিটিক্স’ শব্দ দিয়ে অন্যায়-অনাচার, দূরাচার, চাপাবাজি, ধাপ্পাবাজি এবং জালিয়াতিকে বোঝানো হতো। এখন ভিলেজ পলিটিক্সই ন্যাশনাল পলিটিক্সকে ধারণ করছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলছে কে কতভাবে কিভাবে জনগণকে প্রতারিত করতে পারে?
গেল কয়েক দিন ধরে এমনি একটি রাজনৈতিক প্রচারণা ও প্রতারণার শিকার হয়েছে সাধারণ জনগণ। আর সেটা হচ্ছে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নাগরিকত্ব বিষয়। বিতর্কটির সূত্রপাত প্রধানমন্ত্রীর লন্ডন সফরের সময়। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সংবর্ধনা সভায় বলেন, ‘লন্ডন হাইকমিশনে নিজের পাসপোর্ট জমা দিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ছেড়েছেন। সে কিভাবে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হন?’ পরে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী চ্যালেঞ্জ করে বলেন, তাহলে সে পাসপোর্ট প্রদর্শন করা হোক। এর উত্তরে প্রতিমন্ত্রী ঢাকায় আহূত সংবাদ সম্মেলনে পাসপোর্ট দেখাতে না পারলেও একটি ফাইল নোট প্রদর্শন করেন। তাতে পাসপোর্ট জমা দেয়ার কথা বলা হয়েছে। বিএনপির তরফ থেকে ওই চিঠির সত্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়েছে। তারেক রহমানের আইনজীবী ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, তারেক রহমান ব্রিটিশ সরকারের কাছে আছেন। পাসপোর্ট জমা দিয়ে ট্রাভেল পারমিট নিয়েছেন।
ব্রিটিশ এসাইলাম আইনের ১৭ ধারা মোতাবেক পাসপোর্ট ও গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট তাদের কাছেই থাকার কথা। তারেক রহমানের পাসপোর্ট বাংলাদেশ হাইকমিশনে যাওয়ার কথা নয়। যা হোক তারেক রহমান কি পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণ করেছেন তা সবারই জানা কথা। তার মানে এই নয় যে, তিনি বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পরিত্যাগ করেছেন। গোটা বিশ্বের নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী জন্মসূত্রের নাগরিকত্ব কখনো কোনো কারণে অবলুপ্ত হয় না। বাংলাদেশের অসংখ্য নাগরিক বিদেশে রয়েছে। বাংলাদেশ তার বিদেশে নাগরিকত্বপ্রাপ্ত লোকদেরকেও তার দেশের নাগরিক মনে করে। একে বলা হয়, ডবল সিটিজেনশিপ।
রাজনৈতিক আশ্রয়ের সময়কালটি একটি অস্থায়ী এবং ট্রানজিশনাল সময়কাল। পৃথিবীর আর সব রাজনৈতিক নেতাদের মতো তারেক রহমান সাময়িকভাবে ব্রিটেনে রাজনৈতিক আশ্রয়ে রয়েছেন। একটি অনুকূল সময়ে তিনি বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করবেন- এটাই স্বাভাবিক। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর ওই মন্তব্যকে রাজনৈতিক মহল ‘অদ্ভুত, যুক্তিহীন ও বেআইনি’ বলে মন্তব্য করেছেন। যখনই তারেক রহমান দেশে ফেরার মতো অবস্থায় আসবেন, তখনই তিনি আসতে পারবেন। কাজেই ¯্রফে রিটেনশন বা জমা রাখার জন্য ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্র বিভাগ থেকে তার পাসপোর্ট লন্ডন হাইকমিশনে পাঠাবার যে তথ্য প্রচার করা হচ্ছে তা দিয়েও কোনো আইন কিংবা যুক্তিতে প্রমাণ হয় না যে, তিনি বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পরিত্যাগ করেছেন। বিএনপি নেতারা এ ধরনের অপপ্রচারকে ‘রাজনৈতিক মূর্খতা’ বলে বর্ণনা করেছেন।
সর্বশেষ খবর অনুয়ায়ী আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ‘এই মুহূর্তে তারেক রহমান বাংলাদেশের নাগরিক নয়।’ তিনি অবশ্য স্বীকার করেছেন যে, তিনি যেকোনো সময় বাংলাদেশে আসতে পারেন এবং নাগরিকত্ব অর্জন করতে পারেন। তিনি যুক্তি দেখাচ্ছেন, যেহেতু তারেক রহমান ব্রিটিশ সরকারের রাজনৈতিক আশ্রয়ে রয়েছেন সেহেতু তিনি বাংলাদেশের নাগরিক নন। পাসপোর্ট অধিদফতরের অরাজনৈতিক ব্যক্তিকে দিয়েও তারা সাফাই সার্টিফিকেট দিয়েছেন। তবে জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব যে কখনো বিলুপ্ত হয় না তা তার অজানা থাকার কথা নয়।
এদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ২৬ এপ্রিল সন্ধ্যায় সম্পাদকমণ্ডলীর সভায় তারেক রহমান প্রসঙ্গে বলেছেন, অবশেষে বিএনপি স্বীকার করল যে তারেক রহমান রাজনৈতিক আশ্রয়ে রয়েছে। বিজ্ঞজনেরা সঙ্গতভাবেই মন্তব্য করছেন যে সরকারের দ্বিতীয় ব্যক্তি যদি এতদিন এটা না জানতেন তাহলে তা তার অজ্ঞতা প্রকাশ করে এবং রাজনৈতিক আশ্রয়প্রাপ্ত ব্যক্তিকে যে ফেরত আনা যায় না, তা যদি তিনি না জানেন তাহলে তা তার অযোগ্যতা প্রমাণ করে। সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি ও বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান প্রবীণ আইনবিদ খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন, ‘তারেক রহমান জন্মগতভাবে বাংলাদেশের নাগরিক। তাই তার নাগরিকত্ব বাতিল করার ক্ষমতা কারো নেই। পাসপোর্টের ওপর ভিত্তি করে জন্মগতভাবে কোনো দেশের কোনো নাগরিকের নাগরিকত্বের ব্যাপারে কোনো প্রভাব পড়ে না। পাসপোর্ট বিদেশ ভ্রমণের একটি ট্রাভেল ডকুমেন্ট। এর আগে আমাদের দেশের সর্বোচ্চ আদালত অধ্যাপক গোলাম আযমের মামলায় এ ব্যাপারে স্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন।’ (দৈনিক নয়া দিগন্ত, ২৫ এপ্রিল ২০১৮)
নাগরিকত্ব দু’রকমের। একটি হলো- জন্মগত, আরেকটি হলো অর্জনগত। যে মানুষ যে দেশে জন্মগ্রহণ করে জন্মগতভাবে সে দেশেরই সে নাগরিক। গোটা বিশ্বে এটি বার্থ রাইট বা জন্মগত অধিকার। এ অধিকার অনস্বীকার্য, অলঙ্ঘনীয় এবং অনিবার্য। কোন দেশে বা কোন সমাজে এ নিয়ে তেমন কোনো বিরোধ নেই। কখনো কখনো রাজা বাদশাহ বা আধুনিক একনায়কেরা নাগরিককে নির্বাসনে পাঠান অথবা নাগরিকত্ব কেড়ে নেন। কিন্তু আইনের চোখে সেটি অচল। এ দেশে এবং বিদেশে এর অনেক প্রমাণ রয়েছে।
অতীতে এবং সাম্প্রতিকে এও দেখা গেছে যে, স্বৈরশাসনের যাতনায় এবং রাজনৈতিক কারণে নেতা নেত্রীরা দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। নিকট অতীতের ইরানের ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনী এবং ফিলিপাইনের সিমিয়ন একুইনোর কথা উল্লেখ করা যায়। পাকিস্তানের বেনজির ভুট্টোসহ অন্য নেতাদেরও স্বৈরশাসনের দাপটে রাজনৈতিক আশ্রয় নিতে হয়েছে। তিব্বতের দালাইলামা দীর্ঘকাল ধরে ভারতের রাজনৈতিক আশ্রয়ে রয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর তার দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে রাজনৈতিক আশ্রয় নিতে হয়েছে। থাইল্যান্ডের রাজনৈতিক নেতাদেরও একই ভাগ্য বরণ করতে হয়েছে।
সবাই আমরা জানি যে, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী জিয়াউর রহমানের জ্যেষ্ঠ সন্তান তারেক রহমান তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে নির্মম রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হোন। বিপন্ন অবস্থায় তাকে লন্ডনে সুচিকিৎসার জন্য পাঠানো হয় উচ্চ আদালতের অনুমোদনক্রমে। দীর্ঘ সময় ধরে সেখানে থাকার প্রয়োজন হয় তখনই যখন স্বদেশের সরকার তার দেশে প্রত্যাবর্তনের সব সুযোগ বন্ধ করে দেয়। তার বিরুদ্ধে মামলার পর মামলা রুজু হতে থাকে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলাসহ তার বিরুদ্ধে সাতটি মামলা চলমান। এর মধ্যে দু’টি মামলায় সাত বছর ও ১০ বছর করে সাজা হয়েছে। আইনমন্ত্রীর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী তারেক রহমানের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের দায়ে কাফরুল থানায় দায়ের হওয়া মামলা চলমান রয়েছে। এই মামলায় তারেক রহমান ছাড়াও তার স্ত্রী ডা. যোবায়দা রহমান ও শাশুড়ি সৈয়দা ইকবাল মান্দ বানু অভিযুক্ত রয়েছেন। মামলাটি আদালতে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে।
এই মামলাটি প্রমাণ করে যে, শুধু তারেক রহমান নয় জিয়া পরিবারকে ধ্বংস করাই তাদের লক্ষ্য। একই সাথে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে তার বিরুদ্ধে ২১ আগস্ট গ্রেনেড মামলা ও ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে দায়ের করা রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা চলমান রয়েছে। এ ছাড়া ঢাকার সিএমএম কোর্টে চারটি মানহানির মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এই মামলাগুলোর মধ্যে একটিতে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা ইস্যু করা হয়েছে। আইনমন্ত্রী আরো জানিয়েছেন, তারেক রহমান একটি মামলায় নিম্ন আদালতে খালাস পেলেও ওই মামলায় হাইকোটর্রে আপিল বিভাগ তাঁকে ৭ বছর কারাদণ্ড ও ২০ কোটি টাকা জরিমানা করেছেন। উল্লেখ্য যে, নিম্ন আদালতে খালাস দেয়ার অপরাধে ওই বিচারককে দেশ ছাড়া করা হয়েছে।
সম্প্রতি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায়ে বেগম খালেদা জিয়ার সাথে তারেক রহমানের ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও দুই কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৪৩ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এই সরকারের আমলে দায়েরকৃত ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলায় প্রাথমিক চার্জশিটে তারেক রহমানের নাম ছিল না। পরে তার নাম সংযুক্ত হয়। গ্রেনেড হামলার পেছনে খালেদা ও তারেক জড়িত বলে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। (দৈনিক ইত্তেফাক,২২ আগস্ট ২০১৫) ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার মামলায় তারেক রহমান ও সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ সব আসামিদের মৃত্যুদণ্ড দাবি করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তিতর্কের শেষ দিনে এই দাবি জানানো হয়।
১ জানুয়ারি ২০১৮, গণমাধ্যমে এ সংবাদ প্রচারিত হয়। তারেক রহমানের বক্তব্য প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তার কথা প্রচারের অপরাধে একটি চ্যানেল জবরদখল হয়ে গেছে। উপর্যুক্ত তথ্য ও প্রতিবেদন পর্যালোচনা করলে যে কেউ বুঝতে পারবেন যে রাজনৈতিক শত্রুতার একটি কালো ছায়া অব্যাহতভাবে ধাওয়া করছে তারেক রহমানকে। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে রাজনৈতিক উপায়ে মোকাবেলা না করে তারা যে তারেক রহমানকে নিঃশেষ করার সব প্রয়াস অব্যাহত রেখেছে। এ দেশে সরকার পক্ষ ফাঁসি চেয়েছে, আর ফাঁসির দাবি অপূর্ণ থেকেছে এরকম উদাহরণ বিরল। বিচার বিভাগের যে কী অসহায়ত্ব এস কে সিনহা তার প্রমাণ দিয়ে গেছেন। সুতরাং তার জীবন যে এখানে শঙ্কামুক্ত নয় তা বোঝার জন্য খুব কষ্ট করতে হয় না। সরকার ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রিরা মাঝে মধ্যে আহ্বান জানান তারেক রহমানকে দেশে ফিরে সাহসিকতার সাথে রাজনীতি করার জন্য। তবে তারেক রহমানের ভক্ত অনুরক্তরা চান না যে তিনি অসময়ে দেশে আসুন। নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা উদাহরণ দেন ফিলিপাইনের নেতা সিমিয়ন একুইনোর। তিনি দেশে ফেরার পর বিমানবন্দরেই আততায়ীর গুলিতে নিহত হন। স্বৈরাচার মার্কোসের লোকেরা তাকে শেষ করে দেয়। বিদেশে তিনি কিছুটা নিরাপদ এ কারণে যে তিনি রাজনৈতিক আশ্রয়ে রয়েছেন। যেকোনো দেশ যখন কোনো ব্যক্তিকে আশ্রয় দেয় তখন তার নিরাপত্তার দায়িত্ব তারা নেয়। ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এমআইসিক্স তার নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছে বলে শোনা যায়।
সরকার তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনতে প্রাণান্ত চেষ্টা করছে। দেশের সর্বোচ্চ কর্তৃত্বধারী ব্যক্তি থেকে সবাই একযোগে বলছেন, তারেক রহমানকে অবশ্যই ফেরত আনা হবে। আইনজ্ঞরা বলেন, যেহেতু বাংলাদেশের সাথে ব্রিটেনের কোনো বন্দী বিনিময় চুক্তি নেই, সে কারণে আইনগতভাবে বাংলাদেশের কোনো নাগরিককে বাংলাদেশ সরকার ব্রিটেন থেকে বহিষ্কার করতে অথবা তাদের হাতে অথবা অন্য কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে তুলে দিতে বলতে পারে না। ব্রিটেনের আইন অনুযায়ী সে দেশের সরকার যদি কোনো বিদেশী নাগরিককে ওই দেশ থেকে বহিষ্কার করতে চায় তাহলেও আদালতের নির্দেশনা প্রয়োজন হবে। বহিষ্কৃত ব্যক্তি আদালতের আশ্রয় নিতে পারবেন। প্রাথমিক আদালত যদি বহিষ্কার আদেশ বহাল রাখেন সে ক্ষেত্রে তিনি ওই দেশের উচ্চ আদালতে আপিল করার সুযোগ পাবেন। এটা একটি দীর্ঘ মেয়াদি ব্যাপার। এ ক্ষেত্রে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রী যা বলছেন তা অবাস্তব এবং একরকম অসম্ভব। ব্রিটেনে কোনো ব্যক্তি আশ্রয় গ্রহণের পর নিজ দেশে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হওয়ার আশঙ্কা থাকে, সে ক্ষেত্রে তারা ওই ব্যক্তিকে প্রত্যার্পণ করে না। একটি অবধারিত প্রশ্ন এখানে উত্থাপিত হতে পারে যে, সরকার যখন দাবি করছে তারেক রহমানের বাংলাদেশের নাগরিকত্ব নেই তখন কিসের ভিত্তিতে তাকে দেশে ফেরানো যাবে? আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, যুক্তরাজ্যের সাথে বাংলাদেশের প্রত্যার্পণ চুক্তি না থাকলেও এই চুক্তি করতে বাধা নেই। মন্ত্রী আরো বলেন, চুক্তি করার জন্য আলোচনা চলছে। তাহলে বোঝা যাচ্ছে সরকারের গরজ এতটাই বেশি যে শুধু তারেক রহমানকে দেশে এনে নিঃশেষ করে দেয়ার জন্য নতুন করে চুক্তি করতে হবে।
নাগরিক সাধারণ সঙ্গতভাবেই প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারেন। তাদের এই গরজের অর্থ কী? এক কথায় উত্তর, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা। তারেক রহমান বাংলাদেশে হত্যা, সন্ত্রাস বা গুরুতর কোনো অপরাধের জন্য অভিযুক্ত নন। সব মামলাই রাজনৈতিক। এ কথা সবাই বোঝে যে, তারেক রহমান হচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের একমাত্র কার্যকর চ্যালেঞ্জ। তাকে নিঃশেষ করে দিতে পারলে আগামী ২০ বছরেও আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী নেতৃত্ব গড়ে ওঠা কঠিন। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে যদি পারিবারিক উত্তরাধিকারে রাজনীতির কথা চিন্তা করা যায়, তাহলে জিয়া পরিবার শেখ পরিবারের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী। সে ক্ষেত্রে জিয়া পরিবারের দৃশ্যমান বলিষ্ঠ নেতৃত্বকে নিঃশেষ করতে পারলে অপর পক্ষের ক্ষমতা একরকম চিরস্থায়ী হয়ে যায়। তা ছাড়া বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে দূরে থেকেও তিনিই সরকারের বিরুদ্ধে একমাত্র কার্যকর নেতৃত্ব তা সবাই বোঝে। উত্তরাধিকারের প্রশ্নটি বাদ দিলেও ব্যক্তিগত গুণাবলি, যোগ্যতা ও কুশলতায় তিনি যেকোনো রাজনৈতিক নেতার চেয়ে অগ্রগামী।
রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অজ্ঞাত। তবে রাজনীতি বিজ্ঞানের নিরীখে আশা করা যায়, অন্য যেকোনো জাতীয় নেতার মতো তারেক রহমান গণতন্ত্রের সংগ্রামে জয়ী হবেন। অতীতে অথবা নিকট অতীতে দেখা গেছে, জাতীয় নেতা বিদেশে অবস্থান করেও নিজ দেশে গণ-আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে অনেক স্বৈরশাসকের পতন ঘটিয়েছেন। যেহেতু তিনি গণতন্ত্রে এবং নিয়মতন্ত্রে বিশ^াস করেন, সেভাবেই একটি গণতান্ত্রিক বিজয়ের পর তিনি দেশে ফিরতে পারবেন। সেদিন তারেক রহমান লাখো মানুষের ভালোবাসা নিয়ে দেশে ফিরে আসবেন। আর এই জাতির নেতৃত্ব দেবেন।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
সূত্র: নয়াদিগন্ত