ইবনে ইসহাক
কোটা নিয়ে বেশ বিপাকেই আছে ছাত্ররা। এই সমস্যা নিয়ে ছাত্ররা আন্দোলনে নামে প্রথম ২০০৬ সালে। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকা কোটার আকার ছাত্রদের আরো বেশি হতাশায় ফেলে দিচ্ছে। বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধাদের নাতিদের কোটায় অন্তর্ভুক্ত করা এবং এর ধারাবাহিকতা ছাত্রদের উত্তপ্ত করেছে। তারা এর অবসান চায়। এটা ছাড়াও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার ছড়াছড়ি ব্যাপকভাবে লক্ষণীয়। প্রতিবছরই মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বাড়ছে। এটাও ছাত্রদের বিরক্তির অন্যতম কারণ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর সর্বপ্রথম ১৯৭২ সালে তৎকালীন শেখ মুজিবের আমলে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে কোটা ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়। সে সময় মেধাতালিকা ২০ শতাংশ বরাদ্দ রেখে, ৪০ শতাংশ জেলাভিত্তিক, ৩০ শতাংশ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযুদ্ধাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য এবং ১০ শতাংশ যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্থ নারীদের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে বেশ কয়েকবার এই কোটা ব্যবস্থাটি পরিবর্তন করা হয়।
আমাদের দেশে নিবন্ধিত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দুই থেকে আড়াই লাখ অর্থাৎ এক হাজার মানুষের মাঝে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ১.২ জন বা ১.৫ জন। যা সমগ্র জনসংখ্যার ০.১২/০.১৫ শতাংশ। ০.১২ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধার জন্য কোটার পরিমাণ ৩০ শতাংশ। যা হাজারে রূপান্তর করলে দেখা যায়, এক হাজার জনতার মাঝে ১ থেকে ১.৫ (দেড়) জন মুক্তিযোদ্ধার জন্য কোটার পরিমাণ ৩০০।
বর্তমানে বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে ৫৫ শতাংশের বেশি কোটা রয়েছে যার মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ, জেলাভিত্তিক কোটা ১০ শতাংশ, নারীদের জন্য ১০ শতাংশ এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য ৫ শতাংশ। তবে নিয়ম অনুসারে এসব কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে ১ শতাংশ প্রতিবন্ধীদের জন্য বরাদ্দ রয়েছে।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধানের ১৯ (১), ২৯ (১) ও ২৯ (২) অনুচ্ছেদ সমূহে চাকুরির ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের সমান সুযোগের কথা বলা হলেও বাস্তবে মেধাবীরা সবচেয়ে বেশি বৈষম্যের শিকার।
যাই হোক গড়ে উঠা কোটা বিরোধী আন্দোলন ইতিমধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। আওয়ামী সরকার শুরু থেকেই এই আন্দলনের কঠোর বিরোধী হয়ে তার অবস্থান নিশ্চিত করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত মাসে চট্টগ্রামের এক ভাষণে স্পষ্ট উচ্চারণ করেছেন কোটায় কোন সংস্কার হবে না।
তারপরও বেকার যুবক ও ছাত্রদের আন্দোলনে দৃঢ় অবস্থান আওয়ামীলীগকে ভিন্ন চিন্তা করতে বাধ্য করেছে। আওয়ামীলীগ প্রথমে চেয়েছে পুলিশ দিয়ে ছাত্রদের হটিয়ে দিতে। ৮ এপ্রিল সন্ধ্যার পর তারা এমন আচরণই করেছে। কিন্তু ছাত্ররা যখন তাদের জীবন বাজি রেখেছে তখন তারা আন্দোলন নিয়ে ভিন্ন চিন্তা করতে শুরু করে করেছে। এরই মধ্যে সরকার ঘোষণা দিয়েছে ৯ এপ্রিল আন্দোলনকারীদের সাথে সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের আলোচনায় বসবেন।
ওরা প্রথমে চেয়েছিল ছাত্রলীগ দিয়ে আন্দোলনের নেতৃত্ব নিয়ে নিতে। কিন্তু শুরুতেই ছাত্রলীগের বিরোধী আচরণের জন্য সেটা সম্ভব হয়নি। ছাত্ররা ছাত্রলীগকে বয়কট করেছে। মজার ব্যাপার হলো এই আন্দোলনে ঢাবি ছাত্রলীগের অনেক নেতাই সক্রিয় অংশগ্রহন করেছে। তারা তাদের নেতাদের দুরভিসন্ধি আগেই বুঝতে পেরেছে। তাই আন্দোলনকে রাজনীতিমুক্ত রাখতে তারা যথেষ্ট সচেষ্ট ছিল।
৮ এপ্রিল মধ্যরাতে ছাত্রলীগ সভাপতি ও সেক্রেটারী স্বয়ং উপস্থিত থেকে আন্দোলনকারীদের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়াতে ও তাদের হটিয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু ছাত্ররা তাদের সে সুযোগ দেয়নি। এক পর্যায়ে ছাত্রদের ধাওয়া খেয়ে সেখান থেকে দলবলসহ পালিয়ে যায় ছাত্রলীগ সভাপতি সোহাগ ও সেক্রেটারী জাকির।
ষড়যন্ত্র এখানেই থেমে থাকে নি। ছাত্রলীগ আন্দোলনকারীদের ইমেজ নষ্ট ও তাদের যৌক্তিক আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে উপাচার্যের বাসভবনে ন্যাক্কারজনক হামলা চালায়। উদ্দেশ্য ছিল এর দায় আন্দোলনকারীদের উপর চাপিয়ে ফায়দা হাসিল করবে। আন্দোলনকে নস্যাৎ করে দিবে। কিন্তু সারাদিন পুলিশের মার খেয়েও অহিংস অবস্থানে থাকা আন্দোলকারীদের গায়ে তারা কলঙ্ক চাপাতে পারেনি। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে বিভিন্ন ফুটেজ যখন পাওয়া গেল তখন দেখা গেল এটা ছাত্রলীগেরই কাজ। তাদের সে প্রজেক্টও মাঠে মারা গেল।
৯ এপ্রিল ১১ টায় আন্দোলনকারীদের সাথে বৈঠক করার কথা থাকলেও সরকারের পক্ষ থেকে কোন নির্দেশনা আসেনি। আন্দোলনকারীরা সাংবাদিকদের মাধ্যমে বারবার জানালো আমরা সরকারের সাথে আলোচনায় বসতে প্রস্তুত। অবশেষে ধানমন্ডিতে আন্দোলনকারীদের ২০ জনের একটি প্রতিনিধি দলের সাথে আলোচনায় বসেছেন ওবায়দুল কাদের।
এই মিটিংটাই ছিল আওয়ামীলীগের আন্দোলন হাইজ্যাক করার সবচেয়ে মোক্ষম পরিকল্পনা। সরকারের সাথে ওই আলোচনায় আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে যিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি হলে ছাত্রলীগের মহসিন হলের নেতা। অবশ্য তিনি পদত্যাগ করেই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সেখানে বাঘা বাঘা আওয়ামী নেতা ও পুলিশ অফিসার দিয়ে আন্দোলনকারীদের বাধ্য করা হয় ৭ মে পর্যন্ত আন্দোলন স্থগিত করতে।
আলোচনা শেষে মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন তারা ৭ মে পর্যন্ত সময় চেয়েছেন। এর মধ্যে কেবিনেট মিটিঙে তারা কোটা সংস্কার নিয়ে যাচাই বাছাই করবেন। ওবায়দুল কাদের কোন আশাব্যঞ্জক প্রতিশ্রুতিও দেন নি। আলোচনার ওবায়দুল কাদেরের লাভ ১ মাস আন্দোলন স্থগিত করতে পেরেছেন। আর আন্দোলনকারীদের কোন লাভ হয়নি, কারণ তারা সংস্কারের আশ্বাসটাও আদায় করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
আওয়ামীলীগ মূলত চেয়েছিল কোনভাবে আন্দোলন দমিয়ে দেয়া। এরপর আন্দোলনকারী নেতাদের ভয়ভীতি দেখিয়ে আন্দোলনকে নস্যাৎ করে দেয়া। একদিকে যাচাই বাছাইয়ের জন্য এক মাস সময় নিয়েছে অন্যদিকে আরেক মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীকে দিয়ে হুমকি দেয়ানো হয়েছে। মতিয়া চৌধুরী বলেছেন, আন্দোলনকারীরা রাজাকারের বাচ্চা। তাদের দেখে নেয়া হবে। একই সাথে হুমকি দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বলেছেন আইসিটি এ্যাক্টে মামলা করা হবে। আরেক মন্ত্রী তারানা হালিমও হুমকি দিয়েছেন। এদিকে অর্থমন্ত্রী আরো আগ বাড়িয়ে বলেন বেসরকারি ভার্সিটিগুলো থেকেও তিনি ভ্যাট নেয়া শুরু করবেন।
এক মাস পর সকল প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে পড়বে রোজার জন্যে। তাই আন্দোলন করার জন্য কাউকে পাওয়া যাবে না। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো এর মধ্যে যারা আন্দোলনকারীদের নেতৃত্ব দিচ্ছে তাদের দেখে নেয়া (মতিয়া চৌধুরীর ভাষায়) হবে। ব্যাস আন্দোলন অন্যান্যবারের মতই নিস্তেজ হয়ে যাবে।
এর মধ্যে থেমে থাকেনি ছাত্রলীগ। ঢাকা কলেজসহ সারা দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সিলেক্টিভ সন্ত্রাসীদের জড়ো করেছে ঢাবিতে। ৯ এপ্রিল সারা রাত ধরে বিভিন্ন হলে গিয়ে ছাত্রদের হুমকি দিয়েছে, মারধর করেছে। এভাবেই তারা আন্দোলন দমন করতে চেয়েছে। কিন্তু তাদের পরিকল্পনাও ভেস্তে গিয়েছে সাধারণ ছাত্রদের দৃঢ়তার কাছে।
কোন প্রতিশ্রুতি ছাড়া ৭ মে পর্যন্ত আন্দোলন স্থগিতের সিদ্ধান্ত মেনে নেয়া সাধারণ ছাত্রদের জন্য ছিল অকল্পনীয়। তারা ভালোভাবেই অনুধাবন করতে পেরেছে এটা আওয়ামীলীগের কূটকৌশল। তারা মূলত আন্দোলনটাকে ছিনতাই করতে চায়। সাথে সাথেই পালটা কমিটি গঠিত হয়। আগের কমিটির সিদ্ধান্ত মানেনি ছাত্ররা। আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সাহসী ঘোষণা আসে নতুন কমিটি থেকে। এই সিদ্ধান্তটাই মূলত আন্দোলনকে বাঁচিয়ে দিয়েছে।
১০ এপ্রিল সরকার যাদের সাথে আলোচনা করেছে তাদেরকে বাধ্য করায় সংবাদ সম্মেলন করতে। তারা সংবাদ সম্মেলন করে ছাত্রদের ৭ মে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলে। যদিও তারা অপেক্ষা করতে বলেছে কিন্তু আমার মনে হয় এটা তাদের চাওয়া ছিল না। এরই মধ্যে দুপুরে তারা আবার ঘোষণা দেন, মতিয়া চৌধুরী যদি ক্ষমা না চান তাহলে আন্দোলন বিকেল পাঁচটা থেকে আবার শুরু হবে।
ব্যাস! আন্দোলন আবার শুরু হলো। নতুন কমিটি আন্দোলনের নেতৃত্ব পুরাতন কমিটির কাছে হস্তান্তর করেছে। দুপক্ষ এক হয়ে আবার উত্তাল করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এখন তাদের একটাই কথা শেখ হাসিনা নিশ্চিত প্রতিশ্রুতি না দেয়া পর্যন্ত তারা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন।
ছাত্রলীগ তার নিয়মিত সন্ত্রাসী কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এই লিখাটা যখন লিখছি তখন জানতে পারলাম, কবি সুফিয়া কামাল হলে ছাত্রলীগের সভাপতি ইফফাত জাহান এশা তার হলের এক ছাত্রীর পায়ের রগ কেটে দিয়েছে। ঐ মেয়ের রক্তাক্ত পা এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল। অনেক ছাত্রীদের সে এবং তার দলবল মারধর করেছে।
ছাত্রদের যৌক্তিক আন্দোলন ছিনতাই করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে আওয়ামীলীগ। এখন পর্যন্ত তাদের ব্যর্থই বলা চলে। তবে ইতিহাস বলে আওয়ামীলীগ ব্যর্থতা মেনে নেয়না সাধারণত। মরণকামড় দিতে চাইবে। তবে আওয়ামীলীগের জন্য কল্যাণ হবে কোন হটকারি সিদ্ধান্ত না নিয়ে ছাত্রদের গণদাবী মেনে নেয়া। কোটা সংস্কার করা। কোটা ৫৬% থেকে নামিয়ে ১০% এ নিয়ে আসা।
ছাত্রদের দাবীর প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানাচ্ছি। বৈষম্যের অবসান হোক। জয় হোক ছাত্রজনতা।