মুসাফির রাফি
বেশ অবাক হয়ে যাওয়ার মত খবর পড়লাম ইংরেজী দৈনিক ঢাকা ট্রিবিউনে, গত ৩০ মার্চ এর সংস্করনে। সংবাদের শিরোনাম হলো ‘Awami League working to win over religious voters’। এই প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকার নতুন করে সহস্রাধিক মসজিদের নির্মান এবং সংস্কার করার পরিকল্পনা করেছে। মুলত নির্বাচনকে টার্গেট করে ধর্মমনা মানুষকে হাতে রাখার জন্যই আওয়ামী লীগ এরকম কাজ করছে বলে ধারনা করছেন বিশ্লেষক মহল।
এই পরিকল্পনা অনুযায়ী আওয়ামী লীগ নিজ দল ও মহাজোটের ৩০০ জন সংসদ সদস্যের জন্য সর্বমোট ৭ হাজার ৮শ ৮৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করবে, যা দিয়ে তারা নিজ নিজ সংসদীয় এলাকার প্রায় ১৮শ মসজিদকে ৬ তলায় উন্নীত করবেন।
এর পাশাপাশি সরকারের ধর্ম মন্ত্রনালয়ের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান ইসলামিক ফাউন্ডেশন একটি প্রকল্পের প্রস্তাব তৈরী করছে যার আওতায় ১ হাজার ১০টি এবতেদায়ী মাদ্রাসা বিনির্মান করা হবে। দারুল আরকাম নামক এই প্রকল্পের আওতায় বিশাল এই কর্মজজ্ঞটি চালানো হবে।
একই সংগে সরকার অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করে দেশের বিভিন্ন স্থানে ৫৬০টি মডেল মসজিদ এবং ইসলামিক কালচারাল সেন্টার বা ইসলামিক সংস্কৃতি কেন্দ্র নির্মানের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ১১ মাস আগে এই প্রকল্পটি একনেকের বৈঠকে অনুমোদিত হয়েছিল।
এর আগে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারীর বিতর্কিত নির্বাচনের আগেও সংসদ সদস্যরা একই রকমের বিশেষ বরাদ্দ পেয়েছিলেন। তবে সেটা মসজিদ নির্মান বা সংস্কারের জন্য নয়। সেই সংসদ সদস্যদেরকে ৬ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল সংসদীয় এলাকাগুলোর রাস্তার সংস্কার ও উন্নয়ন কাজের জন্য। কিন্তু এবার মসজিদ বা মাদ্রাসা নির্মানের জন্য আগ বাড়িয়ে সরকারের এই বাড়তি আগ্রহকে অনেকেই দেখছেন নির্বাচনী রাজনীতি হিসেবে।
এই ব্যপারে আওয়ামী সংসদ সদস্য মাহবুব আরা বেগমকে গিনিকে প্রশ্ন করা হয়, যে কোন সরকার এই বিশেষ বরাদ্দের দিকে যাচ্ছে? এটা কি শুধু ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর সমর্থন পাওয়ার জন্যই?
আওয়ামী সংসদ সদস্য গিনি অবশ্য এমন দাবী অস্বীকার করেন। তার মতে এটা জনগনকে হাতে আনার জন্য নয়। ধর্মমনা মানুষগুলো প্রকৃতার্থে অনেক দিক থেকে পিছিয়ে আছে। আর সেটাকে বিবেচনায় নিয়েই সরকার এই বিশেষ বরাদ্দ দিয়েছে।
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করেন, যত চাই করুক না কেন, যতভাবেই আওয়ামী লীগ ধর্মভক্ত মানুষের মনে জায়গা পাওয়ার চেষ্টা করুক না কেন, আওয়ামী লীগ কখনোই ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর সমর্থন পাবেনা। কেউ কেউ মনে করছেন, যদিও সরকার সাম্প্রতিক সময়ে কওমী সনদকে স্বীকৃতি দিয়ে হেফাজতে ইসলামকে নিষ্ক্রিয় করতে পেরেছে, কিন্তু ভোটের রাজনীতিতে এর খুব একটা প্রভাব পড়বেনা।
আওয়ামী লীগ ভোটের রাজনীতিতে কতটা লাভবান হবে বা ধর্মমনা মানুষগুলো আওয়ামী লীগকে বিশ্বাস করে ভোট দেবে কিনা সেটা অবশ্য আমার কাছে খুব একটা বিবেচ্য নয়। আমার কাছে দুটো জিনিষ গুরুত্বপূর্ন। প্রথমত নির্বাচন কমিশনের আরপিও আইন অনুযায়ী নির্বাচনের প্রচারনায় বা জনসমর্থন আদায়ের প্রচেষ্টায় ধর্মকে ব্যবহার করার সুযোগ নেই। আওয়ামী লীগ যদিও বলছে তারা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে উন্নত করার জন্যই এই বরাদ্দ দিচ্ছে তবুও স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, ধর্মীয় জনগোষ্ঠী যে পিছিয়ে আছে, তা টানা ১০ বছর দেশ শাসন করার পর এই নির্বাচনী বছরে এসে কেন আওয়ামী লীগের নজরে পড়লো?
নির্বাচনী বছরের এই বিশেষ বরাদ্দ প্রমান করে সরকার ধর্মকে ব্যবহার করে ভোট ব্যাংক নিশ্চিত করতে চাইছে। তথাপি নির্বাচন কমিশন সরকারের দালালি না করে এই সব অপকর্মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে এটা বোধ হয় এখন পাগলও বিশ্বাস করেনা।
দ্বিতীয়ত যেই বিষয়টা গুরুত্বপূর্ন সেটা ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে পরিচিত আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ও আদর্শিক দেউলিয়াপনা। একটা দল সারাটা জীবন অন্য দলগুলোকে বিশেষ করে ইসলামিক দলগুলোকে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করার দায়ে অভিযুক্ত করে আসলো। অথচ বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাস বলে, এখানে আওয়ামী লীগের চেয়ে বড় ধর্ম ব্যবসায়ী আর কোন দল নয়, আওয়ামী লীগ এক্ষেত্রে এক নাম্বার।
১৯৯৬ সালে ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় আসে তখন আজকের প্রধানমন্ত্রী মাথায় পট্টি, হাতে তসবিহ নিয়ে জনগনের সামনে হাজির হয়েছিলেন। শ্লোগান তুলেছিলেন, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, নৌকার মালিক তুই আল্লাহ।’ ক্ষমতায় আসার পর তারা ধর্মের যেই অবমাননা করেছে বিশেষ করে কুকুরের মাথায় টুপি পড়িয়ে তারা যে বাজে পোস্টার করেছিল তার খেসারত হিসেবেই ২০০১ সালের নির্বাচনে তাদের ক্ষমতা হারাতে হয়।
২০০৮ সালে ক্ষমতায় বসার পর গত ১০ বছরে ধর্ম নিয়ে মুখে সুন্দর সুন্দর কথা বলে বাস্তবিকপক্ষে ধর্মের সবচেয়ে বড় অবমাননা এই আওয়ামী লীগই করেছে। আলেমদেরকে হেয় করেছে। তাদেরকে ধর্ষক ও খুনী হিসেবে মানুষের সামনে উপস্থাপন করেছে। পাঠ্যপুস্তক থেকে ধর্মীয় সব ইতিহাস ও উপাদানগুলোকে কৌশলে উঠিয়ে দিয়েছে। ৫মে ২০১৩ তারিখে হেফাজতে ইসলামের শান্তিপূর্ন জমায়েতে স্মরনাতীতকালের ভয়াবহতম হামলা চালিয়ে অসংখ্য মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষককে তারা আহত নিহত করেছে। জংগীবাদের সাথে জড়িয়ে অসংখ্য মাদ্রাসাকে, অসংখ্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে সিলগালা করে দিয়েছে এই আওয়ামী লীগ।
সেই আওয়ামী লীগ নির্বাচনের সময় এসে মসজিদ মাদ্রাসায় বিশেষ বরাদ্দ দিলেই পুরনো রক্তের ঋন শোধ হয়ে যাবে- সেটা মনে করার কোন কারনই নেই। এটা ধর্ম নিরপেক্ষ আওয়ামী লীগের ধর্মব্যবসা আর ধর্ম নিয়ে রাজনীতির নোংরা বহি:প্রকাশ। জনগন সময়মতোই তা প্রত্যাখান করবে ইনশা আল্লাহ।