মুসাফির রাফি
অতি সম্প্রতি যেই কথাটি শুনতে শুনতে আমাদের কান নষ্ট হয়ে গেছে, তা হলো আমাদের দেশ নাকি নিম্ন আয়ের দেশ থেকে উন্নত হয়ে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় পৌছে গেছে। একটি দেশের উন্নয়ন, কোন দলের একক অর্জন নয়। এটা গোটা দেশের অর্জন, দেশের মানুষের অর্জন। তথাপি সরকারের এই উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার প্রচারনা কেন যেন মানুষকে স্বস্তি দিতে পারছেনা। বরং মানুষ এই দাবী নিয়ে ঠাট্টা তামাশা করছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো খুললে সাধারন মানুষের নেতিবাচক মন্তব্য ও পরিহাস সহজেই চোখে পড়ে। কারনটা কি? এত বড় (!) একটা অর্জন কেন আমাদেরকে তৃপ্তি দিতে পারছেনা? সেই হিসেব নিকেষ মেলাবার আগে আসুন জেনে নেই, উন্নয়নশীল দেশ মানে আসলে বিষয়টা কি আর বাংলাদেশের বর্তমান স্ট্যাটাসটাই বা আসলে কি?
আমাদের সরকার দাবী করছেন, ‘ডেভলপিং কান্ট্রি’ হতে যে তিনটি শর্ত পূরণ করতে হয় তা বাংলাদেশ অর্জন করেছে। শর্ত অনুযায়ী একটি দেশকে উন্নয়নশীল হতে হলে সেই দেশকে প্রথমত, মাথাপিছু আয় ১ হাজার ২৪২ মার্কিন ডলার হতে হয়, বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৬১০ মার্কিন ডলার। দ্বিতীয়ত, মানব সম্পদের উন্নয়ন অর্থাৎ দেশের ৬৬ ভাগ মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত হতে হয়, বর্তমানে বাংলাদেশের ৭০ ভাগ মানুষের জীবনযাত্রার মানের উন্নতি হয়েছে। আর তৃতীয়ত, অর্থনৈতিকভাবে ভঙ্গুর না হওয়ার মাত্রা ৩০ ভাগ হতে হবে, বাংলাদেশে এ মুহূর্তে তা ২৬ ভাগ অর্জন করেছে। বিশ্বের ইকোনমিক ও সোস্যাল কাউন্সিল উল্লেখিত তিনটি বিষয় বিবেচনা করে কোনও দেশকে নিম্নমধ্য আয়ের দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল (ডেভলপিং) দেশে পরিণত হওয়ার ঘোষণা দেয়। গত শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে ত্রিবার্ষিক বৈঠক শেষে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসিও (সিডিপি) এ সিদ্ধান্ত নেয় এবং এই সংক্রান্ত একটি চিঠি শুক্রবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধির কাছে হস্তান্তর করা হয়।
সম্প্রতি সাংবাদিকদের সাথে মত বিনিময় কালে সরকারের শিল্পমন্ত্রী তোফায়েল আহমদ জানান ‘এ ঘোষণা কার্যকর হতে প্রস্তুুতির সময় থাকবে। আশা করা যায়, বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে ২০২১ সালে বিশ্বে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হবে।’
কিন্তু প্রকৃত বাস্তবতা আসলে তেমন নয়। আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির জন্য বাংলাদেশকে অপেক্ষা করতে হবে ২০২৪ সাল পর্যন্ত। আর সেই পর্যন্ত অর্থনৈতিক অগ্রগতি অব্যাহত রাখতে হবে। কেননা জাতিসংঘ ২০২১ সালে একটি পর্যালোচনা করবে। এরপর ২০২৪ সালে আরেকটি মূল্যায়ন হবে বাংলাদেশের। সব কিছু ঠিক থাকলে ঐ বছরই আসবে চূড়ান্ত স্বীকৃতি। অর্থাৎ উন্নয়নশীল দেশ হয়ে গেছে মর্মে যারা দাবী করছেন তারা আসলে চাপাবাজি ছাড়া আর কিছুই করছেন না। প্রশ্ন হলো তাহলে এখনই কেন এই উদযাপন?
অনেকেই মনে করছেন এটা আইওয়াশ। নির্বাচনী বছরে জনগনকে বোকা বানানোর জন্য এটা সরকারের চাল। আর দালাল মিডিয়া আর সাহিত্য সংস্কৃতি অঙ্গনের বিরাট একটি দলকানা গ্রুপ বরাবরের মতই এবারও সরকারের সাথে তাল মেলাচ্ছে। বিভিন্ন মন্ত্রনালয় নানা ধরনের প্রোগ্রাম করছে। জেলা প্রশাসকরাও জেলায় জেলায় আনন্দ শোভাযাত্রা বের করছেন। মিথ্যা একটি অর্জন নিয়ে সরকারীভাবে বাংলাদেশ যেই জোচ্চুরীটা করলো আমি জানিনা পৃথিবীতে আর কোথাও এমন নজির পাওয়া যাবে কিনা।
চালের কেজি ৫০ টাকার নীচে নামাতে না পারলেও আওয়ামী লীগ উৎসব যে খুব ভালভাবেই উদযাপন করতে পারে তা বলাই বাহুল্য। এর আগে ২০১৪ সালে আন্তর্জাতিক সালিশ আদালতের রায়ে ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ মীমাংসায় বাংলাদেশের প্রায় সাড়ে ১৯ হাজার বর্গকিলোমিটার সমুদ্র এলাকা পাবার বিষয়টি উদযাপন করেছিল এই আওয়ামী সরকার।
একইভাবে ২০১২ সালে, মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের জন্য আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে (ইটলস) করা মামলায় বাংলাদেশ জেতার পরেও একই রকমভাবে উদযাপন করা হয়েছিল। এমনকি প্রতিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে ফেরার পরও বেশ উৎসবে মাতে আওয়ামী লীগ। আসলে দল আর দলীয় নেতাকর্মীরা যেই টাকা এই ১০ বছরে অবৈধভাবে কামাই করেছে, তার কিছু অংশ এভাবে না উড়ালে বোধ হয় সরকারের বদহজম হতো।
তবে এবার সরকারের এই মিথ্যা প্রচারনায় পানি ঢেলে দিয়েছে জার্মানীর একটি গবেষনা প্রতিষ্ঠান। তারা সম্প্রতি প্রকাশিত একটি গবেষনা প্রতিবেদনে জানিয়েছে যে, বাংলাদেশ এখন স্বৈরশাসনের অধীন এবং সেখানে এখন গণতন্ত্রের ন্যূনতম মানদন্ড পর্যন্ত মানা হচ্ছে না। বিশ্বের ১২৯ টি দেশে গণতন্ত্র, বাজার অর্থনীতি এবং সুশাসনের অবস্থা নিয়ে এক সমীক্ষার পর জার্মান প্রতিষ্ঠান ‘বেরটেলসম্যান স্টিফটুং’ তাদের রিপোর্টে এই মন্তব্য করে। রিপোর্টটি গত শুক্রবার প্রকাশ করা হয়েছে।
রিপোর্টে ১২৯ টি দেশের মধ্যে ৫৮ টি দেশ এখন স্বৈরশাসনের অধীন এবং ৭১ টি দেশকে গণতান্ত্রিক বলে বর্ণনা করা হয়েছে। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৭ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ে এই সমীক্ষা চালানো হয় যেসব দেশের ওপর, তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে পাঁচটি দেশের কথা। এই ৫টি দেশ হলো বাংলাদেশ, লেবানন, মোজাম্বিক, নিকারাগুয়া এবং উগান্ডা।
রিপোর্টে বলা হচ্ছে, এই পাঁচটি দেশ এখন আর গণতন্ত্রের ন্যূনতম মানদন্ড পর্যন্ত মানছে না। এসব দেশে বহু বছর ধরেই গণতন্ত্রকে ক্ষুন্ন করা হচ্ছিল। এসব দেশের ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনী ব্যবস্থার কারণেই এটা ঘটেছে বলে মন্তব্য করা হয় রিপোর্টে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পর্যালোচনা চলাকালে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতা, বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড, মৌলবাদীদের হামলা সংঘটিত হতে দেখা গেছে।
জার্মান সংস্থার এই রিপোর্টটি সরকারের গালে একটি চপোটাঘাতের সমতুল্য বিশেষত যখন জাতে উঠার দাবী করে ব্যপক প্রচারনা চালাচ্ছে তখন এই রিপোর্টটি সামনে আসায় সরকার আসলে অনেকটাই বিব্রত হয়ে পড়েছে। এই কথা বলতেই হয়, যেই ভয়াবহ স্বৈরশাসন বাংলাদেশে চলছে তার খুব সামান্যই রিপোর্টে উঠে এসেছে। বাস্তবতা আসলে অনেকটাই ভয়াবহ। এই দেশে ক্ষমতাসীন দলের বাইরে আর কেউ ভাল নেই। সাধারন মানুষের দুর্ভোগের সীমা নেই। জীবনে কোন নিরাপত্তা নেই। রাস্তায় বের হলেই হয়রানি। যানজটের কারনে ৩৭ হাজার কোটি টাকার লোকসান গুনতে হচ্ছে প্রতি বছর। যানবাহনের গতি ঘন্টায় ৫ কিলোমিটারেরও কম। প্রতিদিন মানুষের ৫০ লাখ কর্মঘন্টা নষ্ট হচ্ছে। দ্রব্যমুল্যে এখন মানুষের নাভিশ্বাসের কারন। জীবনযাত্রার ব্যায় উন্নত দেশের উন্নত শহরের সমান হলেও নাগরিক সুবিধা বলতে এখন আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।
প্রতিপক্ষকে দমনের বিষয়টা এখন একটা শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে আওয়ামী লীগ। সবাই সব বুঝে কিন্তু কারও যেন কোন অনুভুতি নেই। বিরোধী একটি দলের ৫ শীর্ষ নেতাকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। প্রধান বিরোধী দলের চেয়ারপার্সনকে মিথ্যা মামলায় সাজা দিয়ে মাসের পর মাস জেলে আটকে রাখা হয়েছে। ৫ লাখেরও বেশী মামলায় লাখ লাখ বিরোধী নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করে রাখা হয়েছে। কয়েক হাজার বিরোধী নেতাকর্মীকে গুম ও হত্যা করা হয়েছে। বিরোধী দলীয় নেতার জামিন নিয়ে নাটক করা হয়েছে। কোর্ট জামিন দিলে তা দুই মাসেও জেল গেটে পৌছায় না কিন্তু নতুন করে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হলে তা দুই ঘন্টায় পৌছে যায়। গৃহপালিত বিরোধী দল সৃষ্টি করা হয়েছে। সেই পকেট বিরোধী দলের সদস্যদের নিয়ে মন্ত্রীসভা গঠন করা হয়েছে। প্রকৃত বিরোধী দল সভা সমাবেশের অনুমতি চাইলে পুলিশ অনুমতি দেয়না, অযুহাত দেয় আইন শৃংখলার অবনতির আর অন্যদিকে সরকারী দলের লোকেরা রাস্তায় মেয়েদের পোশাক টেনে ছিড়ে ফেললেও তারপরও তাদেরকে মিছিল নিয়ে সমাবেশে যেতে দেয়া হয়, তাদের কোন অনুমতিই লাগেনা।
সব মিলিয়ে শুধু স্বৈরাচারী শাসন নয় বরং একটা ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে। উন্নয়ন তো হয়েছেই, যারা সরকারী দল করে তাদের। সরকারী দলের লোকেরাই আসলে রাস্তায় চোখ ঝলসানো বাতি জ্বালানোর টেন্ডার পায়, অথচ সাধারন মানুষের ঘরে সেই আলোর ছিটেফোটাও পৌছায় না, তাদের ঘরে আছে মোমের আলো আর লোড শেডিং।
তাই আওয়ামী লীগের লোকেরা চোখে মুখে উন্নয়ন দেখে, উন্নয়নের মুখোশ পরে জনগনকে বোকা বানায়। আর এর বিপরীতে জনগন দেখে মুখোশের আড়ালে স্বৈরাচারের ভূত।