অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
মানুষ তার ভালো কর্ম দিয়ে অগনিত হৃদয়ে স্থান করে নেয়। জনপ্রিয় হয়। কার জনপ্রিয়তার মাত্রা কতটুকু তার সঠিক পরিমাপ করাটা সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। এজন্য কোনো এলাকার বা কোনো দেশের বা পুরো বিশ্বের বর্তমানের বা অতীতের শীর্ষ জনপ্রিয় ব্যক্তিটি কে তা বাছাই করাটা সম্ভব হয় না। তবে মাঝে মাঝে কোনো ব্যক্তিকে ঘিরে এমন কিছু ঐতিহাসিক ঘটনা সংগঠিত হয় যা তাকে শীর্ষ জনপ্রিয় ব্যক্তির কাতারে নিয়ে যায়। বাংলাদেশে তেমনই একজন ব্যক্তি হলেন আল্লামা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদী।
বাংলাদেশের ইতিহাস ঘাটলে বঙ্গবন্ধু, জিয়াউর রহমান, মাওলানা ভাসানীসহ অসংখ্য ব্যক্তির নাম পাওয়া যাবে যারা তাদের জীবদ্দশায় তুমুল জনপ্রিয় ছিলেন। তাদের প্রত্যেকের বেলায় এমন কিছু ঐতিহাসিক ঘটনাও পাওয়া যাবে যা তাদের তুমুল জনপ্রিয়তার সাক্ষ্য দিবে। কিন্তু ২০১৩ সালে মাওলানা সাঈদীর ফাঁসির রায়কে ঘিরে এই দেশে যেই ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে ইসলামপ্রিয় ও সাধারণ জনতা তা শুধু বাংলাদেশই নয় বিশ্বের ইতিহাসেও বিরল।
১৯৪০ সালে পিরোজপুর জেলার জিয়ানগরে(ইন্দুরকানি) জন্মগ্রহন করেন মাওলানা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদী। একজন ইসলামিক স্কলার ও কোরআনের তাফসীরকারক হিসেবে দেশে ও বিদেশে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেন তিনি। ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীতে যোগ দেন এবং ১৯৮৯ সালে দলটির মজলিসে শূরার সদস্য হন। দুইবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন খ্যাতিমান এই ইসলামি ব্যক্তিত্ব।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন, ইসলামপ্রিয় জনতা ও সাধারণ মানুষের মাঝে মাওলানা সাঈদীর জনপ্রিয়তা ও প্রভাব ঈর্ষনীয়। আর এটাই তার জন্য কাল হলো। রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলায় ব্যর্থ হয়ে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের বানোয়াট অভিযোগ দাঁড় করায় আওয়ামী লীগ সরকার। ওই অভিযোগে ২০১০ সালে তাকে গ্রেফতার করা হয়। তিন বছর পর তার বিরুদ্ধে প্রথমে ফাঁসির আদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল। পরবর্তীতে অপিল করা হলে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। বলা যায়, ব্যাপক জনরোষের ভয়েই সরকার নিয়ন্ত্রিত আদালত তাকে যাবজ্জীবন দিতে বাধ্য হয়।
২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি যুদ্ধাপরাধের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনাল মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় প্রদান করে। বিতর্কিত বিচারের এই ন্যাক্কারজনক রায় ঘোষণার পরই রচিত হয় বাংলাদেশের ইতিহাসের এক ঐতিহাসিক অধ্যায়। রায়কে প্রত্যাখ্যান করে সারাদেশে দলমত নির্বিশেষে মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। সেদিন পুরুষের পাশাপাশি যে পরিমানে নারীরা সারাদেশে রাস্তায় নেমেছে তার দৃষ্টান্তও ইতিহাসে বিরল।
মাওলানা সাঈদীর জনপ্রিয়তা যে শুধু মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো না তার প্রমানও পাওয়া যায় সেদিন। অসংখ্য হিন্দু নারী –পুরুষও সেদিন প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসে। মাওলানা সাঈদী যেই এলাকা থেকে দুইবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন সেই এলাকাটিও ছিলো হিন্দু অধ্যুষিত। তাদের মাঝেও সাঈদীর জনপ্রিয়তা ছিলো আকাশচুম্বী। ফাঁসির রায় প্রত্যাখ্যান করে তারাও নেমে এসেছিলো রাস্তায়।
সেদিন প্রতিবাদি জনতার উপর হামলে পড়ে পুলিশ-র্যাব-বিজিবির সমন্বয়ে গঠিত সরকারের যৌথবাহিনী। সাথে ছিলো ছাত্রলীগ-যুবলীগও। নির্বিচারে গুলি চালিয়ে শুধু ২৮ ফেব্রুয়ারিতেই সারাদেশে হত্যা করা হয় নারীসহ অন্তত ৭০ জনকে। একদিনে এতসংখ্যক লোকের মৃত্যু বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ও হয়নি। একজন ব্যক্তির জন্য একদিনে এতলোকের প্রাণ দেয়ার ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসেও বিরল।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর তথ্যমতে ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু করে পরের ৮ দিনে সারাদেশে হত্যা করা হয় মোট ১৪৭ জনকে। তবে অধিকারসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের পরিসংখ্যান মতে মৃতের সংখ্যা ১৫৫। এছাড়া পুলিশের গুলিতে একই সময়ে আহত হয়েছিলেন প্রায় ৫ সহস্রাধিক, গ্রেপ্তার করা হয় প্রায় ২ সহস্রাধিক আর নিখোঁজের সংখ্যাও ছিলো অনেক।
মাওলানা সাঈদীর প্রতি সাধারন মানুষের ভালোবাসার তীব্রতার প্রমান পাওয়া যায় দু একটি টেলিভিশনে প্রচারিত ফুটেজ থেকে। ফুটেজগুলোতে দেখা গেছে পুলিশের গুলিতে নিজের সন্তান বা স্বামী বা স্ত্রী মারা গেলেও তিনি একটুও ব্যথিত নন। তিনি শুধুই মাওলানা সাঈদীর মুক্তি চান, সেটা নিজের জীবনের বিনিময়ে হলেও।
‘ফাঁসির দড়িতে আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুর আগে যেন আমার মৃত্যু হয়’- আল্লাহর কাছে এমনই আকুতি জানিয়ে আসছিলেন পুলিশের গুলিতে নিহত বগুড়ার শাজাহানপুরের সাজাপুর মণ্ডলপাড়ার দিনমজুর মেহেরাজের স্ত্রী রাজেনা বেগম। তার জানাজায় একমাত্র ছেলে রানা মিয়া উপস্থিত মুসল্লিদেরকে তার মায়ের এমন আর্তির কথা জানান। ভালোবাসার এমন অসংখ্য দৃষ্টান্ত তখন পত্রিকা ও টেলিভিশনের খবরগুলোতে দেখা গিয়েছে। যেগুলো একজন দেলোয়ার হোসাইন সাঈদীর তুমুল জনপ্রিয়তার সাক্ষ্য বহন করে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে জনপ্রিয়তায় শীর্ষস্থানে অবস্থানকারী একজন হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন। যার আহ্বানে ছাত্র জনতা শ্রমিক নির্বিশেষে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো। কিন্তু তার আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা একসময় ধ্বসে পড়ে। ক্ষমতার দাম্ভিকতা তাকে আকাশ থেকে মাটিতে নামায়। এমন জনপ্রিয় একজন ব্যক্তি অনাকাঙ্খিতভাবে পরিবারসহ খুন হলেও আমরা সারাদেশে তার কোনো প্রতিক্রিয়া দেখিনি। এমনকি কথিত আছে তার জানাজায় ১৭ জন মাত্র মানুষ অংশ নিয়েছিলেন।
কেউ কেউ বলেন তখন সেনাবাহিনীর ভয়ে মানুষ কিছু করতে পারেনি। কিন্তু আদৌ কি এটা সত্য হতে পারে? একজন মুজিবভক্তও কি ছিলো না যিনি এই ভয়কে উপেক্ষা করে রাস্তায় নামতে পারতেন, জীবন দিতে পারতেন? মাওলানা সাঈদীর জন্য যারা জীবন দিলেন তারা কি পুলিশ-র্যাব-বিজিবির যৌথ বাহিনীর ভয় করেননি। তখনও তো দেশটাকে থমথমে বানিয়ে রাখা হয়েছিলো। রাস্তায় নামলেই তখনও গুলি করা হতো। তারপরও কিন্তু সাঈদীভক্তরা রাস্তায় নেমেছেন। জীবন দিয়েছেন।
মাওলানা সাঈদীর রায় ঘোষণার প্রথম দিনে প্রাণ হারিয়েছেন ৭০ জন। এত লোকের প্রাণহানির পর নিশ্চই দেশজুড়ে থমথমে ও ভয়ংকর অবস্থার তৈরি হয়েছিলো। তারপরেও কিন্তু সাঈদীভক্ত ও ইসলামপ্রিয় জনতা একটুও ভয় পায়নি। গুলি খেয়ে মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও তারা রাস্তায় নামা অব্যাহত রেখেছেন বেশ কয়েকদিন। ৮ দিন ধরে যৌথবাহিনীর গুলির সামনে চলমান এই প্রতিবাদে ১৫৫ জন প্রাণও দিয়েছেন।
বাংলাদেশের আরেকজন শীর্ষ জনপ্রিয় ব্যক্তি হলেন বিএনপি প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান। সেনাবাহিনীতে তার যেমন ব্যাপক জনপ্রিয়তা ছিলো, তেমনি সরকার গঠন করার পর নানা ব্যতিক্রমী কাজের জন্য রাষ্ট্রপতি হিসেবেও তার জনপ্রিয়তা ছিলো আকাশচুম্বী। বিশেষ করে শেখ মুজিবের ধর্মনিরপেক্ষতার বিপরীতে তার ইসলাম ও জাতিয়তাবাদ ধাঁচের নীতি দেশের মানুষের কাছে খুবই প্রশংসিত হয়েছিলো। কিন্তু সেই জনপ্রিয় লোকটি রাষ্ট্রপতি থাকাকালে যখন চট্টগ্রামে সেনানিবাসে একটি ব্যর্থ সেনা অব্যুত্থানে নিহত হন, তখন খোদ চট্টগ্রামের বিএনপির নেতাকর্মীরাও এর কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। তারা ছিলো ভয়ে তটস্থ।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, জিয়াউর রহমানের জানাজায় রেকর্ড সংখ্যক লোক সমাগম ঘটেছিলো। কিন্তু বিবেচ্য বিষয় হলো জানাজাটি ছিলো একটি বিশাল দলের প্রধান নেতার। যেই দলটি ক্ষমতায় রয়েছে। তাদের প্রধান নেতার জানাজায় সারাদেশ থেকে কর্মীবাহিনীর ঢল নামবে সেটাই স্বাভাবিক ছিলো। এই উপস্থিতি তার প্রতি মানুষের ভালোবাসার প্রমাণও দেয়। কিন্তু কাউকে ভালোবেসে তার জানাজায় অংশ নেয়া আর কাউকে ভালোবেসে গুলির সামনে দাঁড়িয়ে জীবন বিলিয়ে দেয়া কখনোই এক ব্যাপার নয়।
মানুষকে ভালোবেসে তার জানাজায় বিপুল মানুষের অংশ নেয়ার প্রমাণ বাংলাদেশে আরো রয়েছে। জামায়াতের সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আযম ও ইসলামি ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মুফতি ফজলুল হক আমিনীর জানাজাতেও বিপুল সংখ্যক লোকের সমাগম ঘটেছিলো।
যুগে যুগে পৃথিবীতে এমন কিছু লোকের আবির্ভাব ঘটে যাদের বেলায় কবির লেখা- “এমন জীবন তুমি করিবে গঠন, মরনে হাসিবে তুমি কাঁদিবে ভূবন” চরণ দুটি যেনো যথার্থ হয়ে দাঁড়ায়। মাওলানা সাঈদী তেমনই একজন ব্যক্তি, যার মরনে নয়, কেবল আদালতের একটি রায়ের বিরুদ্ধেই দল-মত, ধর্ম-বর্ণ, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে মানুষ কেঁদেছে, জীবন দিয়েছে, গুলিতে আহত ও পঙ্গু হয়েছে। তার মুক্তি চেয়ে এখনো মানুষ কেঁদে চলেছে। এমন জনপ্রিয়তার দৃষ্টান্ত বাংলাদেশে অদ্বিতীয়, বিশ্বে বিরল।