অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
সারাবিশ্বের মুসলমানদের জীবন আর রক্ত কি বন্ধক দেয়া আছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে? নাকি কথিত নিরাপত্তা পরিষদের মোড়ল পাঁচ দেশ মুসলমানদের রক্ত কিনে নিয়েছে? তাহলে কেনো তাদের একেকটি ভেটো প্রদান লাখ লাখ মুসলমানের জীবনকে অনিরাপদ করে তোলে? মুসলমানদের জীবন মৃত্যু কেনো তাদের সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করবে?
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্য চীন, ফ্রান্স, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্র। এসব দেশের ভেটো ক্ষমতার কারণে জাতিসংঘ আজ খেলার পুতুলে পরিণত হয়েছে। সিরিয়া, মিয়ানমার, প্যালেস্টাইন, ইরাক, আফগানিস্তান এবং আফ্রিকার বিভিন্ন দেশসহ সারা বিশ্বে সাধারণ মানুষ বিশেষ করে মুসলিমরা নিপীড়নের শিকার হচ্ছে এই পাঁচ দেশের কারণেই। তাদের কারণে কিছুই করতে পারছেন না জাতিসংঘ।
কথিত মোড়ল সেজে বসে থাকা এই ৫টি দেশের তুলনায় তো সারা বিশ্ব অনেক অনেক বড়। তাহলে কেনো সারা বিশ্বের প্রায় দুইশত দেশ মাত্র পাঁচটি দেশের হাতে বন্দি থাকবে? মানবতার মুখোশ পড়া এই দেশগুলোর অমানবিকতার মুখোশে উন্মোচিত হয়েছে বহু আগেই। কয়েকদিন ধরে সিরিয়ার গৌতায় নির্বিচারে সাধারন মুসলমান নারী শিশু হত্যার জন্যও এই পাঁচটি দেশের একে অপরের স্বার্থসংশ্লিষ্ট দ্বন্দ্বই দায়ী।
সিরিয়ার পূর্ব ঘৌটায় গত এক সপ্তাহে রুশ সমর্থিত সিরিয়ার সরকারিবাহিনীর হামলায় এ পর্যন্ত ৫০০ মানুষ নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও কয়েকশ। সরকারি বাহিনীর হামলা ও বিদ্রোহীদের উপস্থিতির কারণে এলাকাটিতে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন অর্ধলক্ষাধিক মানুষ। জরুরি মানবিক সহায়তা পৌঁছে দিতে পারছে না ত্রাণ সংস্থাগুলো। এ অবস্থায় বৃহস্পতিবার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ঘৌটায় অস্ত্রবিরতির একটি প্রস্তাবে ভোটাভুটি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ভেটো ক্ষমতাসম্পন্ন রাশিয়ার প্রস্তাবটিতে সমর্থন না থাকায় তা ভোটেই তোলা হয়নি।
অস্ত্রবিরতিতে রাশিয়াকে সমর্থন দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও ফ্রান্সের পক্ষ থেকে আহ্বান জানানো হচ্ছে। কিন্তু রাশিয়া অস্ত্রবিরতি প্রস্তাবে সমর্থন জানাতে রাজি হচ্ছে না। তারা দাবি করছে, প্রস্তাবটিতে ঘৌটায় যাদের বিরুদ্ধে সিরীয় বাহিনী হামলা চালাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করা হয়নি। একই সঙ্গে রাশিয়ার দাবি, পরিস্থিতি সম্পর্কে ভুয়া তথ্য ছড়ানো হচ্ছে।
খামার ও ছোট ছোট শহর নিয়ে গঠিত পূর্ব ঘৌটা সিরিয়ার বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে থাকা শেষ গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোর একটি। হাসপাতাল বোমা মেরে ধ্বংস করে দেওয়া এবং এলাকাটিতে খাদ্য ও পানীয়ের অভাব দেখা দেওয়ার খবর প্রকাশিত হলে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পাসের চেষ্টা করা হচ্ছিল। আসাদবাহিনীর হামলায় বিপুল সংখ্যক শিশু হতাহত হওয়ায় ইউনিসেফ প্রতিবেদন হিসেবে সাদা কাগজ প্রকাশ করেছে। ব্যখ্যা দিয়ে তারা বলেছে, পরিস্থিতি এতই ভয়ঙ্কর যে তা বর্ণনা করার মতো কোনও ভাষা নেই।
বৃহস্পতিবার কুয়েত ও সুইডেন উত্থাপিত জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের খসড়া প্রস্তাবে অবরুদ্ধ শহরতলীতে ত্রাণ সহায়তা ও বেসামরিক নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়ার জন্য যুদ্ধবিরতির কথা বলা হয়েছে। খসড়া প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ১ হাজার ২৪৪ সম্প্রদায়ের ৫৬ লাখ মানুষের সহায়তা প্রয়োজন। এর মধ্যে অবরুদ্ধ এলাকায় থাকা ২৯ লাখ মানুষের কাছে পৌঁছানো কঠিন। এতে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ৩০ দিনের জন্য অস্ত্রবিরতি কার্যকর করার প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে আইএস, আল কায়েদা ও হায়াত তাহরির আর শামের মতো জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে হামলা চালানোর বিষয়টি প্রস্তাবে অনুমোদন করা আছে। রাশিয়া বাদে নিরাপত্তা পরিষদের সব সদস্যেরই সমর্থন ছিল প্রস্তাবের পক্ষে।
জাতিসংঘে নিযুক্ত রুশ রাষ্ট্রদূত ভাসিলি এ নেবেনজিয়া, যার ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ প্রস্তাবটি পাসের বিরুদ্ধে একমাত্র অন্তরায়, তিনি প্রস্তাবটিকে ভুল তথ্য ও অপপ্রচার আখ্যা দিয়ে বাতিল করে দিয়েছেন। অন্যান্য দেশের দূত ও জাতিসংঘের কর্মকর্তারা বিশ্ব প্রচারমাধ্যমের ‘মগজ ধোলাইয়ের’ শিকার দাবি করে রাশিয়ার দূত বলেন, বিশ্ব প্রচারমাধ্যম যোগসাজশ করে বার বার একই গুজব ছড়িয়ে যাচ্ছে।
স্তুপ করা লাশ, শিশুদের পোড়া দেহ, বোমায় বিধ্বস্ত হাসপাতাল ও ক্ষেপণাস্ত্রের হাত থেকে বাঁচতে পরিবারগুলোর অন্যত্র আশ্রয় নেওয়ার ছবিগুলোকে ‘অপপ্রচার’ আখ্যা দিয়েছেন রুশ রাষ্ট্রদূত। তিনি বলেছেন, ‘ভাবটা এমন যেনও পূর্ব ঘৌটাজুড়ে শুধু হাসপাতাল এবং সেগুলো সব সিরিয়ার বিদ্রোহীদের পক্ষে কাজ করছে।’ তার দৃষ্টিতে, উপস্থাপিত এসব তথ্য আদতে ‘তথ্যযুদ্ধে ব্যবহৃত মিথ্যা।’ নেবেনজিয়া পরিষ্কার করে দিয়েছেন, সিরিয়ার প্রধান সহযোগী রাশিয়া অস্ত্রবিরতির কোনও প্রস্তাব সমর্থন করবে না এখন।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের খবর অনুসারে, অস্ত্রবিরতি প্রস্তাবে রাজি না হওয়ার ক্ষেত্রে রাশিয়া মূল আপত্তির কারণ সিরিয়ায় আল কায়েদার সহযোগী সংগঠন আল নুসরা ফ্রন্ট বা জাভাত ফাতেহ আল শাম জঙ্গিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপের উল্লেখ না থাকা। জঙ্গিগোষ্ঠীটি সিরিয়ার দামেস্কর আবাসিক এলাকাগুলোতে গোলাবর্ষণ করে যাচ্ছে বলে অভিযোগ করে আসছে সিরিয়া ও রাশিয়া। আর তাদের দমনে কার্যকর উদ্যোগ না নেওয়া পর্যন্ত যু্দ্ধবিরতি যেতে চায় না রাশিয়া ও সিরিয়া।
জাতিসংঘ সদর দফতর থেকে আল জাজিরার কূটনৈতিক সম্পাদক জেমস বেইস জানান, বৃহস্পতিবার নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকের পর প্রস্তাবে বেশকিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। পরিষদের সদস্যরা সেখানে কিছু ভাষাগত পরিবর্তন এনেছেন।
শুক্রবার রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ অভিযোগ করেন, সিরিয়ার জাভাত ফাতেহ আল শাম জঙ্গিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কোনও কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না যুক্তরাষ্ট্র। আল নুসরা ফ্রন্ট নামে পরিচিত গোষ্ঠীটি সিরিয়ার পূর্ব ঘৌটায় সহিংসতার মূল কারণ বলেও দাবি করেন তিনি।
উজবেকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল আজিজ কামিলোভের সঙ্গে মস্কোতে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ল্যাভরভ বলেন, ‘জাভাত আল নুসরা পূর্ব ঘৌটার মূল সমস্যা বলে আমি মনে করি। গোষ্ঠীটিকে সচেতনভাবে বা অথবা অচেতনভাবে সিরিয়া সরকারের অন্যান্য বিরোধীদের সঙ্গে সমান করে দেখা হচ্ছে।’
ল্যাভরভ বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন জোট জাভাত আল নুসরাকে সত্যিকার অর্থে হামলার লক্ষবস্তু করেছে বলে আমাদের কাছে কোনও প্রমাণ নেই। আমরা অবশ্যই বিষয়টিতে মার্কিন সহকর্মীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। কিন্তু আমাদের কথার কোনও প্রভাব দেখতে পাইনি।’
পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলোতে সিরিয়ায় ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের জন্য সিরীয় বাহিনীকে দায়ী করে খবর প্রকাশের মধ্যেই রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনলেন। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব বিষয়ে ল্যাভরভ বলেন, ‘জঙ্গিরা এই মানবিক বিরতি মেনে চলবে আর দামেস্কর আবাসিক এলাকায় গোলাবর্ষণ চালু রাখবে না, এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই। আমাদের এসব নিশ্চয়তা দেওয়া হয়নি।’
সিরিয়ায় অস্ত্রবিরতির বিষয়টি বিবেচনার রাশিয়া প্রস্তুত রয়েছে বলে বৃহস্পতিবার জানিয়েছিলেন ল্যাভরভ। তবে ‘দামেস্কর আবাসিক এলাকাগুলোতে নিয়মিতভাবে গোলাবর্ষণকারী আইএস, আল নুসরা ফ্রন্ট ও অন্যান্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠী এতে অন্তর্ভুক্ত রাখা যাবে না’ বলে শর্তও দেন তিনি।
বৈঠক শেষে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সকে ‘থ্রি মাস্কেটিয়ার্স’ আখ্যা দিয়ে জাতিসংঘের সিরিয়ার দূত বাসার আল জাফরি বলেছেন, নির্বিচারে সাধারণ মানুষের ওপর বোমা বর্ষণের যে অভিযোগ বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে করা হয়েছে তা অমূলক। তিনি পাল্টা অভিযোগ করেন, আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে পূর্ব ঘৌটা থেকে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার বিষয়টি পুরো এড়িয়ে যাচ্ছে অভিযোগকারী তিন দেশ। ওই সব ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় দামেস্কতে বহু লোক মারা গিয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি।
মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিশ্লেষক ও সাংবাদিক রবার্ট ফিস্ক এক প্রতিবেদনে জানিয়েছেন, সহসাই সিরিয়ার ঘৌটায় হামলা বন্ধ হচ্ছে না। যুদ্ধবিরতিতে রাশিয়ার বিরোধিতার পরও তিনটি বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে সমঝোতার জন্য আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে সিরীয় সরকার। আর এতে রাশিয়া সরাসরি মধ্যস্থতা করছে। তারা পূর্ব ঘৌটায় আটকে পড়া কয়েক লাখ বেসামরিক নাগরিকের জন্য ‘মানবিক করিডোর’ খোলা ও ‘পালানোর রাস্তা’ বিষয়ে আলোচনা করছে।
রবার্ট ফিস্ক আরও লিখেছেন, এসব আলোচনা চললেও নুসরা ফ্রন্ট সিরীয় সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ করতে আগ্রহী হবে না। তার পরিবর্তে সিরিয়ায় লড়াইরত সৌদি আরব সমর্থিত মিলিশিয়া বাহিনী ‘জাইশ আল ইসলাম’ ও কাতার সমর্থিত ‘রাহমান লিজিওন’ সেখানে সমঝোতায় আসতে বেশি আগ্রহী। সৌদি আরব ও কাতারের মধ্যে দূরত্ব থাকার পরও বাহিনী দুটি নিজেদের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করছে।
সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কর কাছে পূর্ব ঘৌটায় প্রায় চার লাখ মানুষের বসবাস। সিরিয়ায় এটাই আসাদ সরকারবিরোধী বিদ্রোহীদের সর্বশেষ ঘাঁটি। ২০১৩ সালে এলাকাটি আসাদ সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। তথ্যসূত্র: বাংলা ট্রিবিউন।