মুসাফির রাফি
গত কয়েকদিন ধরেই কথাটা মাথায় ঘুরছে। বাংলাদেশ, আমাদের প্রিয় জন্মভুমি আসলে কোন পথে যাচ্ছে? দেশে সংসদ আছে, বিচার বিভাগ আছে, নির্বাহী বিভাগ তো শক্তিশালী হয়েই আছে, প্রশাসন আছে, সংবিধান আছে, সেনাবাহিনী, পুলিশ বাহিনী বা নির্বাচন কমিশন সবই আছে। কাগজে কলমে শুধু নয়, বাস্তবিকই আছে। তথাপি দেশে কোন গনতন্ত্র নেই। গণতন্ত্রের চর্চা নেই। রাজনৈতিক শিষ্ঠাচার নেই। প্রতিপক্ষকে দমন পীড়ন চলছে বেপরোয়াভাবে।
বাংলাদেশ ইতোপূর্বেও এরকম পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে গেছে। তবে এবারের সংকট অতীতের সব রেকর্ডকেই ছাড়িয়ে গেছে বহুগুনে। আগে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের হয়রানি করা হতো। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম আওয়ামী আমলে তৎকালীন জাসদ নেতা সিরাজ সিকদারকে হত্যা করা হয়েছিল। এই আমলেও আবার শুরু হয়েছে সেই পুরনো কালচার। এবার তৃনমুল নয়, হাত দেয়া হয়েছে দলগুলোর কলিজায়। মূল নেতাদেরকে জেলে পাঠানো হয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং মুল বিরোধী দলের প্রধানকে ৫ বছরের কারাদন্ড দিয়ে জেলে পাঠানো হয়েছে। তার জামিন নিয়ে টালবাহানা চলছে। আরেকটি দলের শীর্ষ নেতাদেরকে তো ফাঁসি দিয়েই হত্যা করা হলো। বাংলাদেশ তো বটেই পৃথিবীর কোন দেশেই এহেন নজির নেই।
আওয়ামী লীগের প্রথম আমলের শেষ দিকে গিয়ে গণতান্ত্রিক শাসন পদ্ধতিকে হত্যা করে একদলীয় বাকশাল শাসন কায়েম করা হয়। বিরোধী দলগুলোকে তখন আর কাজ করতে দেয়া হয়নি। বিরোধী দল বলতে যারা ছিল তারা ছিল নমিনাল ধরনের। সংসদে বিরোধী দলীয় সদস্য ছিল দুই-একজন। সেই নগন্য বিরোধী দলের সামান্য সমালোচনাও তৎকালীন সরকার সহ্য করতে পারতোনা। শুধু রাজনীতিবীদ নয় বরং বিরোধী বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাকেও সেই সময়ে দমন করা হয় ব্যপকভাবে। মাত্র চারটি পত্রিকা বাদে সকল পত্রিকাকে বন্ধ করে দেয়া হয়।
প্রথম আওয়ামী লীগের সেই দু:শাসনের পর যত সরকার আজ অবধি এই দেশের ক্ষমতায় এসেছে কম বেশী সকলেই প্রতিপক্ষকে দমন করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু সেই বাকশালের পথে কেউ যায়নি। বরং বাকশালকে বরাবরই একটি ঘৃন্য ঐতিহাসিক অধ্যায় হিসেবেই চিত্রায়িত করা হয়েছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে। তবে বর্তমান আওয়ামী সরকারের দমন পীড়নের মাত্রা অনেকটা প্রথম আওয়ামী সরকারের মতই। শিকড় তো আসলে এক জায়গাতেই। তখন যিনি ক্ষমতায় ছিলেন এখন তার কন্যাই আছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়।
পথ এক হলেও কৌশল একটু ভিন্ন এবার। এবার ঠিক বাবার পথে হাটেননি কন্যা। বাকশাল তিনি ইতোমধ্যেই কায়েম করে ফেলেছেন কিন্তু ভিন্ন স্টাইলে, নিজের মত করে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তার নিহত পিতার মত সব পত্রিকা বন্ধ করেননি। বরং নতুন নতুন পত্রিকা, নতুন নতুন টিভিকে লাইসেন্স দিয়েছেন। ঐ যে লেখার শুরুতে বললাম, প্রশাসনিক ও সরকারী সকল প্রতিষ্ঠানও কার্যকর আছে। এমনকি দুর্নীতি দমন কমিশন, মানবাধিকার কমিশনও তিনি কার্যকর রেখেছেন তবে সব কিছুকেই নিজের আওতায় এনে। এই সব কমিশন এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো এখন দন্তহীন বাঘ। ক্ষমতা আছে কিন্তু ব্যবহার নেই, আইন আছে কিন্তু কোন প্রয়োগ নেই। বর্তমান সরকার বিচার বিভাগকে বন্ধ করেননি বরং বিচারিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই বিরোধী দল দমনে উদ্যেগ নিয়েছেন। বিভিন্ন মহল থেকে ইতোমধ্যেই বিচারপতি, প্রসিকিউশন, এটর্নী জেনারেলসহ সকলের বিরুদ্ধেই ক্ষমতাসীনদের স্বার্থে কাজ করার অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।
ভেবে দেখুন, একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর জামিন শুনানী নিয়ে কি ভীষণ ছেলে খেলা হচ্ছে। চড়কির মত তার আইনজীবীদেরকে ঘুরানো হচ্ছে। বিচারপতিরা ইচ্ছেমত এজলাস ছেড়ে উঠে যাচ্ছেন, আবার এসে বসছেন। জামিনটাকে দিন কয়েক পেছানোর জন্য এটর্নী জেনারেলসহ সবাই যেন উঠে পড়ে লেগেছেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের হাতে এখন শত শত মামলা। তার অন্য মামলাকে নিয়ে না এগুলেও বিএনপি চেয়ারপার্সনের মামলাকে ৬ মাসে শেষ করেছেন। অথচ তাদের অন্যন্য মামলায় সরকারী দলের মন্ত্রী-এমপিরা দিব্যি মুক্ত বিহঙ্গের মত ঘুরে বেড়াচ্ছেন। পত্রিকা-টিভি আছে তবে সেটা সরকারী দালালদের নিয়ন্ত্রনে। সবাই বিরোধী নেত্রীকে নানাভাবে ছোট করার চেষ্টা করছেন, দুর্নীতিবাজ প্রমান করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করছেন।
বিএনপি শুরু থেকেই এবার শান্তিপূর্ণ ও অহিংস আন্দোলন করে আসছে। তারপরও সম্প্রতি হয়ে যাওয়া বিএনপির শান্তিপূর্ণ কালো পতাকা প্রদর্শন কর্মসূচীতে পুলিশ যেভাবে হামলা চালিয়েছে, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাইকে যেভাবে নাজেহাল করেছে, তা আরেকবার প্রমান করেছে যে বাংলাদেশের গণতন্ত্র এখন অস্তিত্বের সংকটে পড়ে গেছে। পুলিশের রাজনৈতিক কর্মীর ন্যায় আচরন পুলিশের ব্যপারে জনগনের আস্থাকে আরো কমিয়ে দিয়েছে। পুলিশ কর্মকর্তাদের মারমুখী আচরণ ও কথাবার্তায় তাদেরকে ছাত্রলীগের কর্মী ছাড়া অন্য কিছু মনে হয়না।
নির্বাচন কমিশন যেই কাজটাই করে সাধারন মানুষ মনে করে তারা তা সরকারের নির্দেশনাতেই করেছে। সর্বশেষ ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচন স্থগিত করার সিদ্ধান্ত সেটা আরো জোরে শোরে প্রমান করেছে। অন্যদিকে দুদক যেভাবে খালেদা জিয়ার মামলা পরিচালনা করেছে এবং হাইকোর্টেও দুদকের আইনজীবীর যেই ভুমিকা তাতে দুদকের রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ এখন প্রমানীত।
বিচারাঙ্গনের প্রতিও মানুষের আস্থা আগের মত নেই। মাত্র ৬ মাসের মধ্যে দুজন ব্যক্তিকে প্রধান বিচারপতির চেয়ার থেকে এই সরকার যেভাবে হটিয়ে দিলো তাতে বোঝা যায় সরকারের নির্দেশ না মেনে বিচারপতিদেরও খুব একটা বাঁচার উপায় নেই।
এভাবে সেক্টরভেদে আলাদা আলাদাভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে, সব সেক্টরেই অনেক প্রতিষ্ঠান আছে কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলো সত্যিকার অর্থে আর কার্যকর নেই। কার্যকর আছে শুধু সরকারের হুকুম মেনে বিরোধীদেরকে শায়েস্তা করার বেলায়ই। তাই বলতে বাধ্য হচ্ছি ৭৫ এর বাকশাল আবার নব্যরূপে ফিরে এসেছে বাংলাদেশে নতুন মোড়কে। এক কথায় বলা যায় বাকশালের ২০১৮ ভার্সনের ভেতর দিয়েই বাংলাদেশ তার দিন যাপন করছে।
সাবাশ আওয়ামী লীগ, আপনারাই পারেন।