মুসাফির রাফি
এই কলামটি লেখার পেছনে দৈনিক প্রথম আলোর একটা রিপোর্ট এবং রিপোর্টটার ভাষা আমার ক্ষেত্রে প্রনোদনা হিসেবে কাজ করেছে। তাই এই কলামেরও বেশ কিছুটা অংশ জুড়েই প্রথম আলোর এই সংক্রান্ত রিপোর্টটির উদ্বৃতি দেয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না। বিগত কয়েক মাসে বেশ কয়েকটি কলাম লিখেছি এই ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড নিয়েই। তারপরও সোনার ছেলেদের অপ্রতিরোধ্য সন্ত্রাস থামছেইনা, তাই আমার কলামও চলছে অব্যহতভাবেই।
দৈনিক প্রথম আলো গতকাল মঙ্গলবারের ছাত্রলীগের সন্ত্রাস প্রসঙ্গে বর্ননা দিতে গিয়ে লিখেছে, মাত্র আধা ঘণ্টায় কী কী জিনিস ভাঙা যায়, তার নমুনা দেখিয়েছে ছাত্রলীগ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গতকাল মঙ্গলবার বেলা তিনটা থেকে সাড়ে তিনটা পর্যন্ত ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা যা যা ভেঙেছেন, তার তালিকাটা বেশ দীর্ঘ। অবকাঠামোর মধ্যে রয়েছে প্রক্টরের কার্যালয়, নাট্যকলা এবং আরবি বিভাগের ছয়টি শ্রেণিকক্ষ। যানবাহনের মধ্যে রয়েছে নয়টি শিক্ষক বাস, তিনটি মাইক্রোবাস, একটি পিকআপ, টেলিভিশন চ্যানেলের একটি গাড়ি এবং এক শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত গাড়ি।
ভাঙচুরের তালিকায় না থাকলেও ট্রেনের ওপর কম ঝাল মেটাননি ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। চট্টগ্রাম শহর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে চলাচল করা শিক্ষার্থীদের শাটল ট্রেনের হোস পাইপ গতকাল সকালেই কেটে দেওয়া হয়। এরপর শহর এবং ক্যাম্পাসের মধ্যে শাটল ট্রেনে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়।
ছাত্রলীগের এই ক্ষোভের কারণ, সোমবার বিকেল থেকে কয়েক দফা ক্যাম্পাসে সংগঠনের দুটি পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এরপর রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহজালাল এবং শাহ আমানত হলে তল্লাশি চালায় পুলিশ। রাত ১টা থেকে ৪টা পর্যন্ত তিন ঘণ্টার তল্লাশিতে ২টি এলজি এবং ১০টি রামদা উদ্ধার করা হয়। এছাড়া পরিচয়পত্র ছাড়া হলে অবস্থান করায় ৮ কর্মীকে আটক করে পুলিশ। অভিযান চালানোর সময় পুলিশ ‘বাড়াবাড়ি’ করায় গতকাল ছাত্রলীগের একটি পক্ষ ক্যাম্পাসে অবরোধ ডাকে। অবরোধ সফল করতে গিয়েই এই বিশৃঙ্খলা হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সূত্র জানায়, গাড়ি ভাঙচুর করা নেতা-কর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের বিলুপ্ত কমিটির সভাপতি আলমগীর টিপুর অনুসারী। তাঁরা চট্টগ্রামের মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী হিসেবেও ক্যাম্পাসে পরিচিত। পরিবহন পুলে গাড়ি ভাঙচুর করা নেতা-কর্মীরা সেখান থেকে বিশ্বিদ্যালয়ের কলাভবনে নাট্যকলা বিভাগের সামনে আসেন। এই বিভাগের পাশেই প্রক্টরের কার্যালয়। তারা প্রক্টরের পদত্যাগের দাবিতে স্লোগান দিতে দিতে দ্বিতীয় দফায় ভাঙচুর শুরু করেন। প্রথমে শ্রেণিকক্ষ, পরে প্রক্টরের কার্যালয় শেষে কার্যালয়ের সামনে থাকা গাড়ি ভাঙচুর করেন তারা।
কার্যালয়, শ্রেণিকক্ষ ও গাড়ি ভাঙচুরের সঙ্গে নেতা-কর্মীরা জড়িত নয় বলে দাবি করেছেন ছাত্রলীগের বিলুপ্ত কমিটির সভাপতি আলমগীর টিপু।
যারা ভাঙচুর করেছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান প্রক্টর মোহাম্মদ আলী আজগর চৌধুরী। গতকাল সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছিলেন তিনি। এ সময় সেখানে কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের ডিন সেকান্দর চৌধুরী, সহকারী প্রক্টর ও সাংবাদিকেরা উপস্থিত ছিলেন। অতর্কিতভাবে কিছু ছাত্রলীগের নেতাকর্মী এসে তাঁর কার্যালয় ও তাঁকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে। সরে গিয়ে তিনি রক্ষা পান। অন্যরা আত্মরক্ষার জন্য নিচে বসে পড়েন।
বিগত ১০ বছর মহাজোট সরকারের আমলে ছাত্রলীগ সন্ত্রাস চালিয়েছে অদম্য মাত্রায়। তবে সর্বশেষ গত কয়েকমাসের অবস্থা যেন আরো ভয়াবহ। সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন দাবীতে আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদেরকে তারা যেভাবে আক্রমন করেছে, যেভাবে হলগুলোতে নিরীহ ছাত্রছাত্রীদের উপর হামলা করেছে, যেভাবে বোরকা পড়া মেয়েদেরকে অসম্মান করেছে তা বাংলাদেশের ইতিহাসে আগে কখনো দেখা যায়নি। ছাত্রলীগের তান্ডবের জন্যই বিগত মাসগুলোতে দফায় দফায় বন্ধ করতে হয়েছে বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ক্যাম্পাস।
গতকাল রাতে টিভিতে শহীদ মিনারে ছাত্রলীগের শো-ডাউন করে শহীদ মিনারে পুস্পস্তবক প্রদানের ঘটনা দেখলাম। মারাত্মক বিশৃংখলা চোখে পড়লো। কিন্তু বিস্ময়ের সাথে লক্ষ করলাম, উপস্থাপনায় থাকা ব্যক্তি অন্ধের মত মন্তব্য করলেন, বললেন, অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে এগিয়ে আসছে ছাত্রলীগ। আসলে আমাদের এই সব দালাল সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবিরা ছাত্রলীগের শত অন্যায় দেখেও না দেখার ভান করেন, তাদেরকে প্রশ্রয় দেন, ফলে ছাত্রলীগ যেন দিন দিন আরো বেয়াড়া হওয়ার প্রেরণা পায়।
আমাদের সরকার প্রধান, মন্ত্রী, এমপিরাও বিভিন্ন প্রোগ্রামে, বক্তব্যে ঢালাওভাবে ছাত্রলীগকে ডিফেন্ড করেন। ছাত্রলীগের অন্যায়গুলোকে অস্বীকার করেন। নানা খোঁড়া যুক্তি দাঁড় করিয়ে ছাত্রলীগের অপকর্মগুলোকে প্রোটেকশন দেন। টকশোতে আসা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরাও দলকানা মানসিকতার কারনে ছাত্রলীগের সমালোচনা করতে গিয়ে দ্বিধায় থাকেন।
এই বাস্তবতায় এটা নি:সন্দেহে বলা যায়, চলমান সহিংসতা ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ড হওয়ার জন্য ছাত্রলীগ একা দোষী নয়, বরং গোটা সিস্টেম, গোটা প্রশাসনই এই দোষে দোষী। কেননা এরা প্রত্যেকেই ক্ষমতার মোহে ছাত্রলীগের জুলুমকে সহ্য করছে, আর মজলুমদের উপর চড়াও হচ্ছে। অনাচার করার জন্য ছাত্রলীগ যতটা দায়ী, তাদেরকে বরদাশত করার জন্য এই প্রশাসনও কম দায়ী নয়। তাই জাতি হিসেবে আমাদেরকে হয়তো আরো অনেকদিন খেসারত দিয়েই যেতে হবে, দেখে যেতে হবে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী তান্ডব।