দলের বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতিই ঐক্যবদ্ধ করেছে বিএনপিকে। আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে দলটিতে এই মুহূর্তে মতবিরোধ কম। পাশাপাশি সমূহ বিপদের আশঙ্কায় নেতায় নেতায় দ্বন্দ্ব কমে গেছে। কমে গেছে সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে লন্ডনে বসবাসরত দলের সিনিয়র নেতাদের দূরত্বও। দলটির বিভিন্ন পর্যায়ে খোঁজখবর নিয়ে এসব তথ্য জানা গেছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের মতে, পরিস্থিতিই বিএনপিকে ঐক্যবদ্ধ করেছে। তিনি বলেন, তারেক রহমানের নেতৃত্বে বিএনপি এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে ঐক্যবদ্ধ। তা ছাড়া সরকার আমাদের যে বিপদের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে তাতে ঐক্যবদ্ধ না হয়ে উপায় কী! এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দু-একটি ক্ষেত্রে হয়তো শূন্যতা বা গ্যাপ ছিল। এতে মধ্যস্বত্বভোগীরা বিভ্রান্তি সৃষ্টির সুযোগ পেত। কিন্তু ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সবার সঙ্গে পরামর্শ করেন, কথা বলেন। এতে যাঁরা বিএনপিকে ভাঙার স্বপ্ন দেখছেন তাঁদের সে স্বপ্ন ধূলিস্যাৎ হয়ে গেছে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দাবি করেন, ‘বিএনপিতে অনৈক্যের বিষয়টি আসলে প্রচারণা। তারপরও বলব, আমাদের ওপর সরকার যে স্টিমরোলার চালাচ্ছে সেই পরিস্থিতি আমাদের পরস্পরকে বেশি করে কাছে টানার বা ঐক্যবদ্ধ করার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে।’ কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘বিএনপি চেয়ারপারসনকে কারাগারে নিয়ে সরকার মনে করেছে আমাদের দুর্বল করবে। কিন্তু বিএনপি নেতাকর্মীরা বুঝতে পেরেছে তারা ঐক্যবদ্ধ না থাকলে বিপদ কাউকে ছাড়বে না। ফলে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নির্দেশনায় বিএনপি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ইস্পাত কঠিন ঐক্য প্রতিষ্ঠা হয়েছে দলের মধ্যে।’
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিএনপি সব সময়ই ঐক্যবদ্ধ আছে। তবে চেয়ারপারসনকে কারাগারে নেওয়ার পর নেতাকর্মীরা আরো বেশি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছে। ঐক্যবদ্ধ না হলে আমাদের অস্তিত্ব থাকবে না এটি আমরা এখন সবাই বুঝতে পারছি।’
সূত্র মতে, দশ বছর ধরে বিএনপির সিনিয়র বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের যোগাযোগ প্রায় বন্ধই ছিল। দলের মধ্যে ওই নেতারা ‘তারেকবিরোধী’ বলে পরিচিত হয়ে উঠিছিলেন। কিন্তু এখন ওই নেতাদের সঙ্গেও তারেকের প্রতিদিন যোগাযোগ হচ্ছে। পরস্পরের সঙ্গে তাঁরা দিনে কয়েকবার করে কথা বলছেন। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে পরস্পরের সঙ্গে পরামর্শ করছেন তাঁরা।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার পাঁচ বছর সাজা হওয়ায় এখন তিনি কারাগারে রয়েছেন। বিএনপির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তারেক রহমান এখন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্বে আছেন। দলটির ৩৯ বছরের ইতিহাসে ৩৬ বছর ধরে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন খালেদা জিয়া।
তবে খালেদা জিয়ার সময়, বিশেষ করে গত দশ-পনেরো বছরে দলের মধ্যে ‘তারেকপন্থী’ বলে আলাদা একটা বলয় সৃষ্টি হয়, যা নিয়ে বিএনপিতে মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে। বিশেষ করে সিনিয়রদের বড় একটি অংশের সঙ্গে বিভিন্ন প্রশ্নে তারেকের কিছুটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়। দলের মধ্যে এসব নেতা ‘খালেদা জিয়াপন্থী’ বলে পরিচিত ছিলেন। কারণ তাঁরা তারেকের অনেক সিদ্ধান্ত, বিশেষ করে তাঁর সমর্থকদের তৎপরতায় প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ ছিলেন।
আবার ক্ষুব্ধ ওই নেতাদের সম্পর্কেই দলে তারেকের অনুসারীদের পক্ষ থেকে নেতিবাচক প্রচারণা চালানো হতো বলে মনে করা হয়। কারণ সিনিয়র ওই অংশের নেতারা নিজেরা উদ্যোগী হয়ে তারেকের সঙ্গে কথা বলতেন না। তাঁরা মনে করতেন, জিয়াউর রহমানের সময় থেকে তাঁরা বিএনপির রাজনীতি করেন। আবার জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতাও তাঁরাই। তারেক সংগত কারণেই তাঁদের সমীহ করে চলবেন এমনটাই আশা ছিল ওই নেতাদের।
২০০২ সালের ২২ জুন তারেক রহমান দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব নিযুক্ত হন। অনেকের মতে, সেই সময় পর্যন্ত পরিস্থিতি একরকম সমন্বয় করেই চলছিলেন সবাই। কিন্তু এরপর বনানীতে পৃথক একটি কার্যালয় ভাড়া নেওয়া এবং পরে তাঁকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা সমর্থকগোষ্ঠী তৈরি হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে দলের মধ্যে দুটি বলয় সৃষ্টি হয়। অনেকের মতে, এর ফলেই বিএনপিতে মতবিরোধ বা দলাদলি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, যার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটে এক-এগারো পরবর্তী আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্বাধীন ‘সংস্কারপন্থী’দের উত্থানে। অনেকের মতে, ওই ঘটনারই কিছুটা রেশ গত দশ বছর ধরেও অব্যাহত ছিল। এমনকি গত দশ বছর (২০০৮ সালের ১২ সেপ্টেম্বর থেকে) ধরে তারেকের লন্ডনে নির্বাসিত জীবনযাপন করার পরও। কেউ কেউ এমন অভিযোগ করেন, একদল সমর্থকগোষ্ঠীর দ্বারাই তারেক রহমান বিভ্রান্ত ছিলেন। আর সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টির নেপথ্য ভূমিকায়ও ছিলেন এঁরাই। দলের বড় একটি অংশ এমনও মনে করে, তারেকের ওই বলয়ের সুযোগ নিয়ে একটি গোষ্ঠী দলের মধ্যে এমনই বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে, যার প্রভাব গুলশান কার্যালয় এবং নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয় পর্যন্ত পড়েছে। আর এ কারণেই দলের মধ্যে সিদ্ধান্তহীনতা ও দলাদলিও বেড়েছে, যা এখন অনেকটাই দূর হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ মনে করেন, বিএনপি তার শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে মোকাবেলা করতে বাধ্য হয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। কারণ তারা বুঝতে পেরেছে, একত্র হয়ে না দাঁড়ালে বিএনপির অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে। তিনি বলেন, বিএনপি নেত্রী কারাগারে থাকায় দলটির টিকে থাকা অনেক বেশি জরুরি হয়ে পড়েছে। ফলে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা বা অনৈক্য কমে গেছে। তারেক রহমান এবং সিনিয়র নেতারাও বুঝতে পেরেছেন, আগে দল বাঁচাতে হবে। তাই ভোদাভেদ ভুলে সবাই তৎপর হয়েছেন—যোগ করেন শত নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক বিএনপিপন্থী সুধীসমাজের এই প্রতিনিধি।
জানতে চাইলে নিজ দলের সংকটকালের উদাহরণ দিয়ে জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের বলেন, ‘বিএনপির কথা বলতে পারব না। তবে ১৯৯১-পরবর্তী সময়ে আমাদের চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে কারাগারে নেওয়ার পরই দলের নেতারা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন। কেননা তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন, ঐক্যবদ্ধ না হলে সৃষ্ট বিপদ থেকে মুক্ত হওয়া যাবে না।’
সূত্র: কালেরকণ্ঠ