আজ এক নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করছে বাংলাদেশের রাজনীতি। রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে মামলা ইতিহাসে নতুন কিছু নয়। যেমন নতুন নয়, তাদের কারাভোগও। তবে ইতিহাস সাক্ষী, কখনো কখনো এক-একটি মামলা শুধু একজন রাজনীতিবিদ নয়, পুরো দল, সম্প্রদায় বা দেশের ইতিহাসের গতিপথও ঠিক করে দেয়।
কেমন হবে বাংলাদেশের রাজনীতির বকশীবাজার অধ্যায়? উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। নানা প্রশ্ন, নানা ফতোয়া। কী রায় হবে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে।
কোন্দিকে তার গন্তব্য। এটা তো শুধু সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর একার যাত্রাপথ নয়। এ পথের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে তার দল এবং পরিবারের পথও। এ এক অগ্নিপরীক্ষা। শুধু খালেদা জিয়ার জন্য নয়, শাসক দলের জন্যও। গত নয় বছর ধরে অনেকটা নির্বিঘ্নেই দেশ শাসন করেছে আওয়ামী লীগ। কখনো কখনো মাঠে সহিংস আন্দোলন হয়েছে। আখেরে যা সরকারের জন্য লাভজনক হিসেবেই বিবেচিত হয়েছে।
এবারের চ্যালেঞ্জটা অবশ্য ভিন্ন। একেবারেই আলাদা। পর্যবেক্ষকদের কেউ কেউ একে রাজনীতির টার্নিং পয়েন্ট হিসেবেই অভিহিত করেছেন। ট্রাম্পকার্ড ছুড়ে দিয়েছে শাসকমহল। জিতলে বাজিমাত। হারলে কী হয় তা অবশ্য এখনই বলার সময় আসেনি। দীর্ঘপথ সামনে। প্রতিটি দিনই হবে স্নায়ু পরীক্ষার। লক্ষণীয় যে, বিএনপি জোটের পক্ষ থেকে এখনো পর্যন্ত কোনো আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়নি। কড়া কোনো প্রতিক্রিয়াও দেখা যায়নি। সর্বশেষ গতকালের সংবাদ সম্মেলনেও খালেদা জিয়া তেমন কোনো শক্ত কথা বলেননি। কোনো আন্দোলনের ডাকও দেননি। এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর বিয়োগান্ত পরিস্থিতিতে রাজনীতির ময়দানে এসেছিলেন খালেদা জিয়া। ৩৫ বছরের ক্যারিয়ারে নানা ঝড়ঝাপ্টাও গেছে তার ওপর দিয়ে। এরশাদের আমলে গৃহবন্দি হয়েছিলেন। ফখরুদ্দীন জমানায় সংসদ ভবনের বিশেষ কারাগারে বন্দি ছিলেন এক বছরের কিছু বেশি সময়। পরে কারাগার থেকে মুক্তি পেলেও ‘রাজনীতির বন্দিদশা’ থেকে এখনো মুক্তি মেলেনি তার। একের পর এক চ্যালেঞ্জ আসছে। এরই একটি চূড়ান্ত পর্যায়ে আজ বকশীবাজারের অস্থায়ী আদালতে যাবেন জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায় শুনতে। নিজেকে নির্দোষ দাবি করে তিনি বলেছেন, ন্যায় বিচার হলে খালাস পাবেন। বকশীবাজারে যাওয়ার আগে গত কয়েকদিনে দলীয় নেতাদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেছেন খালেদা জিয়া। মতামত নিয়েছেন তৃণমূল নেতাদের। সাফ বার্তাও দিয়েছেন তাদের। একাধিক সূত্রে জানা গেছে, দলীয় নেতাদের কোনো ধরনের সহিংসতায় না জড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। দলীয় প্রধানের সাজা হলেও এখনই যে বিএনপি হার্ডলাইনে যাচ্ছে না সে বার্তাও মোটামুটি স্পষ্ট। যেকোনো মূল্যে ঐক্য ধরে রেখে দলকে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত করতে চান খালেদা জিয়া। যদিও দলের ভেতরে এখনই বিশ্বাস-অবিশ্বাসের নানা চিত্র রয়েছে। খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে বিএনপি কীভাবে চলবে সে প্রশ্নও বড় হচ্ছে।
কী হবে আজ? একটি আদালতের ভেতরের চিত্র। অন্যটি বাইরের। আইন অনুযায়ী, সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড থেকে শুরু করে সর্বনিম্ন যেকোনো দণ্ড দিতে পারেন আদালত। বাইরের চিত্র কেমন হবে? রাজপথ দখলে রাখতে সবরকমের প্রস্তুতিই সম্পন্ন হয়েছে শাসক মহলের তরফে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি মাঠে থাকবে আওয়ামী লীগ। যদিও ঢাকার বাইরের চিত্র এখনো স্পষ্ট নয়। কিন্তু এটা নিশ্চিত যে, আজ বাংলাদেশের রাজনীতি ফের এক গভীর অনিশ্চিত পথে যাত্রা শুরু করছে।
গুলশান, নাজিম উদ্দিন রোড অথবা কাশিমপুর ঘিরেই আগামী দিনের রাজনীতির ধরকষাকষি চলতে পারে। সে ইঙ্গিত এখন অনেকটাই স্পষ্ট। সাজা হলে খালেদা জিয়া কি নির্বাচনে অংশ নেয়ার যোগ্যতা হারাবেন? নানা মুনীর, নানা মত। সংখ্যাগরিষ্ঠ আইনবিদদের মতে, নির্বাচনে যোগ্যতা-অযোগ্যতার প্রশ্ন আসবে আপিল বিভাগের রায়ের পর। আবার কেউ কেউ বলছেন, বিচারিক আদালতে রায়ের পরই তিনি নির্বাচনে অযোগ্য হবেন। আবার অন্য একটি মত হচ্ছে, উচ্চ আদালত সাজা স্থগিত করলেই কেবল খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন।
প্রশ্ন অনেক। খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশ নিতে না পারলে বিএনপি কি নির্বাচনে যাবে। আলোচনা যা, যেকোনো পরিস্থিতিতেই বিএনপি আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে চায়। খালেদা জিয়াও দলকে এমনটাই নির্দেশনা দিয়েছেন। কিন্তু শাসক মহল কী চায় সে প্রশ্নই বড়।
রাজনীতি শেষ পর্যন্ত শুধু শক্তির খেলা নয়, এটা কৌশলের খেলাও। গত কয়েকদিন উভয়পক্ষই বেশকিছু চাল চেলেছে। কারা এগিয়ে তা এখনই বলা মুশকিল। তবে এই খেলা সামনের দিনগুলোতে আরো জটিল হবে। যেখানে রাজনীতিবিদরা শুধু একাই চাল চালবেন না। দেশি-বিদেশি নানা শক্তি জড়িয়ে পড়বে এতে। জনগণকে শেষ পর্যন্ত দর্শক হয়ে থাকতে হয় কি-না তাই হবে দেখার বিষয়। কারণ একদিনের বাদশাহি এরই মধ্যে তারা হারিয়ে ফেলেছে।
এদিকে, বকশীবাজারে স্থাপিত বিশেষ অস্থায়ী আদালতে ঢাকার পঞ্চম বিশেষ জজ আদালতের বিচারক মো. আখতারুজ্জামান জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায় ঘোষণা করবেন। গত ২৫শে জানুয়ারি এই মামলার বিচারিক কার্যক্রমের শেষ ধাপ যুক্তিতর্কের শুনানি শেষে রায়ের জন্য ৮ই ফেব্রুয়ারি দিন ধার্য করেন আদালতের বিচারক।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের নামে বিদেশ থেকে আসা দুই কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৪৩ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে ২০০৮ সালে রাজধানীর রমনা থানায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এই মামলা দায়ের করে। মামলার অন্য আসামিরা হলেন- খালেদা জিয়ার বড় ছেলে ও বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, সাবেক মুখ্য সচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী, প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ভাগ্নে মমিনুর রহমান, মাগুরার সাবেক সংসদ সদস্য কাজী সালিমুল হক কামাল ও ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ। তারেক রহমানকে পলাতক দেখিয়ে তার বিরুদ্ধে ২০১৭ সালের ২৬শে জানুয়ারি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে আদালত। আর কাজী সালিমুল হক কামাল ও শরফুদ্দিন আহমেদ বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। এছাড়া কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী ও মমিনুর রহমান মামলার শুরু থেকেই পলাতক থাকায় তাদের বিরুদ্ধেও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়।
এ মামলায় সাড়ে ৯ বছর আইনি লড়াই করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। ২০০৮ সালের ৩রা জুলাই জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা দায়ের করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এরপর থেকেই আইনি লড়াইয়ে নেমেছিলেন খালেদা জিয়া। ২০১৪ সালের মার্চে এ মামলায় অভিযোগ গঠন করা হয়।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় গত বছরের ১৯শে ডিসেম্বর রাষ্ট্রপক্ষে যুক্তি উপস্থাপন শুরু করে ওই দিনই তা শেষ করেন দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল। ওই দিন তিনি যুক্তিতর্কের শুনানিতে বলেন, এই মামলার ৩২ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য ও নথিপত্র উপস্থাপনের মাধ্যমে প্রসিকিউশন খালেদাসহ অন্য আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণে সক্ষম হয়েছে। তাই, এ মামলার বিচারে খালেদা জিয়ার সর্বোচ্চ সাজার (যাবজ্জীবন কারাদণ্ড) আর্জি জানান তিনি। এরপর ২০শে ডিসেম্বর থেকে শুরু করে গত ১৬ই জানুয়ারি পর্যন্ত মোট ১৪ কার্যদিবসে খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। খালেদার পক্ষে সিনিয়র আইনজীবী আব্দুর রেজাক খান, খন্দকার মাহবুব হোসেন, জমির উদ্দিন সরকার, মওদুদ আহমদ ও এ জে মোহাম্মদ আলী যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। খালেদার আইনজীবীরা আদালতকে জানান, জাল জালিয়াতি করে এই মামলার নথিপত্র তৈরি করা হয়েছে। প্রসিকিউশন যে সব অভিযোগ এনেছে তা সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে প্রমাণ করতে পারেনি। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলাকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসামূলক মামলা আখ্যায়িত করে খালেদার আইনজীবীরা আদালতের কাছে খালেদার খালাসের আর্জি জানান। এরপর কারাগারে থাকা দুই আসামি কাজী সালিমুল হক কামাল ও শরফুদ্দিনের পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন তাদের আইনজীবী মো. আহসান উল্লাহ। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলাকে ঘিরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাজনৈতিক উত্তাপ গড়িয়েছিল আদালত পর্যন্ত। এই মামলার বিচারকাজ হয়েছে বকশীবাজারের কারা অধিদপ্তরের প্যারেড গ্রাউন্ডে স্থাপিত অস্থায়ী আদালতে। এই আদালতে গত কয়েক বছরে মামলার শুনানিতে প্রসিকিউশন ও আসামিপক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে প্রতিনিয়তই হয়েছে বাক-বিতণ্ডা আর হট্টগোল। যা ছিল মামলার শেষ দিনের শুনানি পর্যন্ত। আদালতের এই পরিস্থিতি সামলাতে কখনো কখনো আদালতের বিচারক ও পুলিশকেও হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার বিচারকাজ যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে (যুক্তিতর্কের শুনানি) তখনও এ বাকবিতণ্ডা ও তর্ক-বিতর্ক পৌঁছে চরমে। এমনকি দুইপক্ষের আইনজীবীদের হট্টগোলের কারণে আদালতের বিচারকের এজলাস ত্যাগ করার ঘটনাও ঘটেছে।
মোট ২৩৬ কার্যদিবস শুনানির পর এ মামলাটি রায়ের পর্যায়ে আসে। মামলার অভিযোগপত্রে থাকা ৩৬ সাক্ষীর মধ্যে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের উপ-সহকারী পরিচালক হারুনুর রশিদসহ মোট ৩২ জন সাক্ষী আদালতে সাক্ষ্য দেন। ২০১৪ সালের ২২শে সেপ্টেম্বর এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। গত বছরের ১২ই জানুয়ারি সাক্ষীদের জবানবন্দি, জেরা ও পুনঃজেরা সম্পন্ন হয়। এরপর খালেদা জিয়া ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪২ ধারা অনুযায়ী তার বক্তব্য পেশ করেন। ২০১৭ সালের ১৯শে অক্টোবর বক্তব্য শুরু করেন তিনি। গত বছরের ৫ই ডিসেম্বর তার বক্তব্য শেষ করেন খালেদা জিয়া।
২০১৪ সালের ১৯শে মার্চ এ মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে ঢাকার তৃতীয় বিশেষ জজ আদালতের বিচারক চার্জ (অভিযোগ) গঠন করে বিচার শুরুর নির্দেশ দেন। তবে, অভিযোগ গঠনের আগে ও পরে মামলার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে উচ্চ আদালতে যান খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা। উচ্চ আদালতের আদেশে দুইবার এ মামলার বিচারক বদল হয়। এ মামলায় প্রথমে বিচারিক দায়িত্ব পালন করেন ঢাকার তৃতীয় বিশেষ জজ আদালতের বিচারক বাসুদেব রায়। পরে খালেদা জিয়া এই বিচারকের প্রতি অনাস্থা জানিয়ে হাইকোর্টে আবেদন করলে আদালত তাতে সাড়া দেন। এরপর এ মামলায় বিচারিক দায়িত্ব পান ঢাকার তৃতীয় বিশেষ জজ আদালতের বিচারক আবু আহমেদ জমাদার। একপর্যায়ে তার প্রতিও অনাস্থা জানিয়ে খালেদা জিয়া আবারো উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হন। পরে উচ্চ আদালতের আদেশে আবু আহমেদ জমাদারের পরিবর্তে ঢাকার পঞ্চম বিশেষ জজ আদালতের বিচারক মো. আকতারুজ্জামান এই মামলার বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব পান।
এদিকে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায়কে কেন্দ্র করে রাজধানীর বকশীবাজারের আদালত প্রাঙ্গণ ও তার আশপাশ এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। কারা অধিদপ্তরের প্যারেড গ্রাউন্ডে স্থাপিত অস্থায়ী এই আদালত ও তার আশপাশ এলাকায় গতকাল ঘন ঘন টহল দিয়েছেন পুলিশ, র্যাব ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। সন্দেহভাজনদের জিজ্ঞাসাবাদ ও তল্লাশি করা হয়েছে। পুলিশ ও র্যাবের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আদালত ও তার আশেপাশের এলাকায় নিরাপত্তা প্রস্তুতির তদারকি করেন।
সূত্র: মানবজমিন