অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
হল-মার্ক, বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারিকে ছাপিয়ে এবার দেশের ব্যাংকিং খাতে আরো বড় অনিয়ম ও লুটপাটের সন্ধান মিলেছে। এই অনিয়ম হয়েছে আরেক সরকারি জনতা ব্যাংকে। অনিয়ম ও কেলেঙ্কারির হোতা ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবুল বারাকাত।
বিভিন্ন গণমাধ্যমসূত্রে জানা যায়, নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে ভয়ংকর রকম উদারভাবে একই গ্রাহককে ৫ হাজার ৫০৪ কোটি টাকার ঋণ ও ঋণসুবিধা দিয়েছে জনতা ব্যাংক। এক গ্রাহককেই মাত্র ৬ বছরে এভাবে ঋণ দেওয়ায় বিপদে পড়েছে ব্যাংক, গ্রাহকও ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না।
জনতা ব্যাংকের মোট মূলধন ২ হাজার ৯৭৯ কোটি টাকা। মূলধনের সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ দেওয়ার সুযোগ আছে। অর্থাৎ এক গ্রাহক ৭৫০ কোটি টাকার বেশি ঋণ পেতে পারেন না। কিন্তু দেওয়া হয়েছে মোট মূলধনের প্রায় দ্বিগুণ।
ব্যাংক দেখভাল করার দায়িত্ব যাদের, সরকারের নিয়োগ দেওয়া সেই পরিচালনা পর্ষদই এই অপকর্ম করেছে। হল-মার্ক ও বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির পর এটিকেই পারস্পরিক যোগসাজশে সাধারণ মানুষের আমানত নিয়ে ভয়ংকর কারসাজির আরেকটি বড় উদাহরণ বলে মনে করছেন ব্যাংকাররা। তারা বলছেন, এটি একক ঋণের বৃহত্তম কেলেঙ্কারি।
ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান আবুল বারাকাতের সময়কালে এই বিশাল অর্থ দেওয়া হয়। ২০০৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর থেকে ৫ বছর জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। এ সময় ব্যাংকের পর্ষদ সদস্য ছিলেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা বলরাম পোদ্দার, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপকমিটির সাবেক সহসম্পাদক নাগিবুল ইসলাম ওরফে দীপু, টাঙ্গাইলের কালিহাতী আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী যুবলীগ নেতা আবু নাসের প্রমুখ।
অ্যানালাইসিস বিডির অনুসন্ধানে জানা যায়, আবুল বারাকাতের পৃষ্ঠপোষকতায় সরকার দলীয়দের নিয়ে গঠিত পর্ষদ রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ঐ ব্যক্তিকে বার বার ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা করে। বিশেষ করে ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ঋণ দেওয়া হয় খেয়ালখুশিমতো। জনতা ব্যাংকের সাবেক এবং বর্তমান কয়েকজন ব্যাংকার যাঁরা বাংলাদেশের আর্থিক খাতের খোঁজখবর রাখেন, তাঁরাও জানেন এক গ্রাহককে এত অর্থ দেওয়ার কথা। এমনকি ঐ ব্যক্তির পৃষ্ঠপোষক হিসেবে আবুল বারকাতের নামও তাঁরা বলেছেন।
আবুল বারাকাতকে দেশের মানুষ কট্টর ইসলাম বিদ্বেষী বামপন্থী একজন অর্থনীতিবিদ হিসেবেই চেনে। তিনি অধুনালুপ্ত সোভিয়েত রাশিয়াতে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি বিষয়ে উচ্চতর পড়াশোনা করেছেন। ইসলাম ও ইসলামী ব্যাংকিংয়ের বিরুদ্ধে সদা তৎপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক প্রায় সময়ই বক্তৃতা বিবৃতিতে কোনো প্রকারের প্রমান ছাড়াই ইসলামী ব্যাংকসমূহের বিরুদ্ধে জঙ্গি অর্থায়নের মিথ্যা অভিযোগ আরোপ করেন। এমনকি ইসলামী ব্যাংক থেকে ‘ইসলামী’ শব্দ বাদ দেয়া উচিত বলেও মন্তব্য করেন কট্টর ইসলাম বিদ্বেষী এই অধ্যাপক।
কথিত গবেষণার মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংকের বিরুদ্ধে ২ হাজার কোটি টাকা জঙ্গি অর্থায়নের অভিযোগ এনেছিলেন আবুল বারাকাত। অথচ ইসলামী ব্যাংকের বর্তমানের সরকার নিয়োজিত চেয়ারম্যান আরাস্তু খান সম্প্রতি বলেছেন তন্ন তন্ন করে খুঁজেও ইসলামী ব্যাংকের জঙ্গি অর্থায়নের বিন্দুমাত্র প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
গত ২৪ ডিসেম্বর অর্থনীতি সমিতির সম্মেলনে ড. আবুল বারকাত বলেন, ‘এবারের সম্মেলনের প্রতিপাদ্য বিষয় অর্থশাস্ত্রে নৈতিকতা। অর্থনীতি হলো নৈতিক বিজ্ঞান। দীর্ঘদিন ধরে দেশের অর্থশাস্ত্রের সঙ্গে নৈতিক বিষয়টি উপেক্ষিত থাকলেও এবারের সম্মেলনের মূল প্রতিপাদ্য হিসেবে বিষয়টি উঠে এসেছে। অর্থনীতি সমাজের ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা ও মানুষের মঙ্গলের জন্য মূল চাবিকাঠি হওয়ায় এখানে নৈতিকতা থাকতেই হবে।’ কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে নৈতিকতার বুলি আওড়ানো সেই বারাকাতের বিরুদ্ধেই আজ অনৈতিকভাবে ৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ লোপাটের অভিযোগ!
আবুল বারাকাতের উদার আনুকূল্য পাওয়া সেই গ্রাহক হচ্ছে এননটেক্স গ্রুপ। এর পেছনের মূল ব্যক্তি হচ্ছেন মো. ইউনুস (বাদল)। তিনি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)। আবুল বারাকাতের আনুকূল্যে বাসের কন্ট্রাক্টর থেকে তিনি আজ শিল্পপতি। ব্যাংকের ৫ হাজার কোটি টাকায় ২২টি প্রতিষ্ঠানের গড়েছেন তিনি। এক ব্যক্তিকে সব ঢেলে দিয়ে নতুন ঋণ দেওয়ার সব সামর্থ্যই এখন হারিয়ে ফেলেছে ব্যাংকটি।
এর আগে সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা (বর্তমানে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল) শাখা থেকে ২০১১ সালের দিকে হল-মার্ক নামের গ্রুপটি বের করেছিল সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা। তাতে সোনালী ব্যাংক এখনো মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি।
আওয়ামী লীগের শাসনামলে উত্থান ঘটেছে মো. ইউনুস (বাদল) এর। এ সময় ব্যাংক যেমন ছিল উদারহস্ত, তেমনি পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছেন একাধিক মন্ত্রীর। পর্ষদের চেয়ারম্যান আবুল বারাকাত ও সদস্যদের অনেকে তো ছিলেনই, পিছিয়ে ছিলেন না ব্যাংকের কর্মকর্তারাও। এমনকি সিবিএ নেতারাও আছেন তাঁর সঙ্গে।
গত ২০ ডিসেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে আবুল বারাকাত বলেছেন, ‘দেশের অর্থনীতি বড় ধরনের ঝুঁকির মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অনেক ব্যাংকের আর্থিক হিসাবে সমস্যা রয়েছে। ঠিকমতো হিসাবপত্র করলে দেশের অর্ধেক ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যাবে।’ তার এই বক্তব্যের দেড় মাসের মাথায় তার নিজের পরিচালিত জনতা ব্যাংকেই তার বক্তব্যের প্রতিফলন দেখা দিলো। এমনকি ব্যাংকটির এমন দেউলিয়াত্বপূর্ণ অবস্থা তিনি নিজেই তৈরি করেছেন। তাহলে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, নিজের অপকর্মের ব্যাপারে ওয়াকিবহাল হয়েই কি সেই বক্তব্য দিয়েছিলেন?
আরো পড়ুন: বারাকাতই জনতা ব্যাংককে শেষ করে দিয়েছেন