অলিউল্লাহ নোমান
দখলদার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল জাতির উদ্দেশ্যে ভাষন দিয়েছেন। নির্বাচনের নামে প্রহসনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলে রাখার চার বছর অতিক্রম করেছে। এ উপলক্ষ্যেই মূলত তাঁর এই ভাষন। পাশাপাশি সারা দেশে চলছে উন্নয়ন মেলা। সরকারের উন্নয়ন (!) মানুষের সামনে উপস্থানের লক্ষ্যেই মূলত: এই মেলার আয়োজন। ভাষনে প্রধানমন্ত্রী নানা প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন। বিরোধী দল থেকে এর নানা মূল্যায়নও চলছে।
ইতোমধ্যেই কিন্তু শেখ হাসিনা রেকর্ড গড়তে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে সরকার প্রধান হিসাবে একটানা ক্ষমতায় ৯ বছর। এর আগে আর কেউ এত দীর্ঘ সময় একটানা কাটাতে পারেনি। নতুন রেকর্ড এটি। যেমন করেই হোক তিনি ক্ষমতায় টিকে আছেন বা দখলে রাখতে সক্ষম হয়েছেন। এটাও তাঁর একটা বিশেষ যোগ্যতা। যোগ্যতা না থাকলে ৫ জানুয়ারীর মত একটা ইলেকশনের পর ক্ষমতায় টিকে থাকার কথা নয়। বলতে হবে যোগ্যতা দিয়েই তিনি ক্ষমতায় আছেন। এটা তাঁর একক ক্যারিশমা। শেখ হাসিনা বিহীন আওয়ামী লীগকে একবার চিন্তা করেন। তখনই তাঁর ক্যারিশমা নিয়ে কারো সন্দেহ থাকবে না।
শেখ হাসিনার ভাষনের পর আশা করেছিলাম বিরোধী দল সরকারের ব্যর্থতা গুলো তুলে ধরবেন। সময় অবশ্য এখনো যায়নি। ভবিষ্যতে যে কোন সময় বিরোধী দল এই কাজটি করতে পারেন।
শেখ হাসিনা সাফল্যের জয়গান করেছেন। এটা তিনি করতেই পারেন। সরকার প্রধান হিসাবে এটাই তাঁর কাজ। তবে তাঁর বর্ণিত সাফল্য গুলোর পাশাপাশি কিছু কথা রয়েছে।
১
২০১০ সালের ডিসেম্বরে শেয়ার মার্কেটে ধ্বস নেমেছিল। বলা হয়, ৩০ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী রীতিমত পুঁজি হারিয়ে পথে বসে গেছে। পুঁজি হারানোর শোকে বেশ কয়েকজন আত্মহত্যা করেছেন। এনিয়ে একটি তদন্ত কমিটি হয়েছিল। কিন্তু সরকার সেই কমিটির রিপোর্ট প্রকাশ করেনি। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল মুহিত একদা বলেই ছিলেন শেয়ারবাজারে পুঁজি লুটেরাদের নাম বলা যাবে না। সবাই জানেন এরা কারা। সরকারের ঘনিষ্ট কিছু ব্যবসায়ী যেমন জড়িত, বিরোধী দলের কারো কারো নামও উঠে এসেছিল পত্রিকার পাতায়। মিলেমিশেই পুঁজি লুট করা হয়েছে। বিভিন্ন ভাবে উঠে এসেছিল তখন টাকার অংক। শেয়ারবাজার থেকে লুটের পরিমান ছিল এক লাখ কোটি টাকা। রাষ্ট্রের এক বছরের বাজেটের কাছাকাছি। সরকারের এই সাফল্যের (!) বিষয়টি তো শেখ হাসিনা বলবেন না। বিরোধী দল অন্তত বলার রয়েছে।
২
ঋনের দেশের ব্যাংক গুলো এক রকম ফতুর হয়ে গেছে। ঋনের নামে ব্যাংকের সব টাকা নিয়ে গেছে সরকারি দলের লুটেরা ব্যবসায়ীরা। ব্যাংক গুলো নাজুক অবস্থায় রয়েছে। পত্র পত্রিকায় হরহামেশাই উঠে আসছে ব্যাংক গুলোর চিত্র। ঋনের নামে সোনালী ব্যাংক থেকে শুধু একজন চার হাজার কোটি টাকার বেশি নিয়েছিল। সেটা ধরাপড়ার পর অর্থমন্ত্রী জাতীয় সংসদে দাড়িয়ে বলেছিলেন এটা তেমন কিছু নয়। আসলেও তিনি সত্য কথাটাই বলেছিলেন সেদিন। চার হাজার কোটি টাকা আওয়ামী লুটেরাদের কাছে কিছুই নয়। এর চেয়েও বেশি টাকা লুট হয়েছে। গত ৯ বছরে শুধু ঋনের নামে কত টাকা লুট হয়েছে? এর একটা শ্বেতপত্র অন্তত বিরোধী দল বের করতে পারত ততদিনে।
৩
দুনিয়ার ইতিহাসে নজির বিহীন ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভে। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে গচ্ছিত ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের টাকা। সেই টাকা থেবে প্রায় ৮০৮ কোটি টাকা সমমূল্যের ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি হয়ে যায়!! সেই চুরির পর তদন্ত কমিটি হয়েছিল সাবেক গভর্ণর ড. ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে। তদন্ত কমিটির রিপোর্টে কি বলা হয়েছে এখনো জনগনকে জানানো হয়নি। বাংলাদেশে ব্যাংকের গোপন পাসওয়ার্ড কারা কিভাবে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের চুরিতে ব্যবহার করেছেন?? এই ঘটনা কিন্তু ইতিহাসে নজিরবিহীন। এর আগে কখনো এরকম ঘটনা ঘটেনি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে।
৪
পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস জাতীয় রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। প্রাইমারি স্কুলের পরীক্ষা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা। সব ক্ষেত্রেই প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটছে নিয়মিত। এমনকি চাকুরির জন্য প্রতিযোগিতামূলক বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নও ফাঁস হয় ইদানিং।
৫
ইমারত নির্মানে রডের বদলে বাঁশ। এরকম চিত্র প্রকাশিত হয়েছে গণমাধ্যমে। সামান্য বন্যায় হাওড়ের বাঁধ ভেঙ্গে গেছে সুনামগঞ্জে। ফতুর হয়েছেন হাজার হাজার কৃষক। রডের বদলে বাঁশ দিয়ে বিল্ডিং তৈরির উদ্ভাবনী এসবও কি উন্নয়ন মেলায় প্রদর্শিত হচ্ছে!!
৬
কুইকরেন্টাল চালুর আগেই তেরি করা হয়েছে ইনডেমনিটি অ্যাক্ট। অর্থাৎ কুইকরেন্টাল নিয়ে ভবিষ্যতে কেউ প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারবে না কোন আদালতে। অর্থাৎ একরকম দায়মুক্তি আইন তৈরি করেই দুর্নীতি হচ্ছে এই খাতে।
৭
মানুষের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান হচ্ছে জীবনের নিরাপত্তা। জীবনের নিরাপত্তাই এখন সবচেয়ে বড় ঝুঁকিতে। জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রীয় খরচে যাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তারাই খুন করছে মানুষ। বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গুম করা হচ্ছে। এর চেয়ে জঘন্য মানবতাবিরোধী অপরাধ আর দুনিয়ায় নেই। সেই গুম, খুন হচ্ছে বিরোধী দল দমনে সরকারের প্রথম হাতিয়ার।
৮
ইন্ডিয়াকে ট্রানজিটের নামে করিডোর দেওয়া হয়েছে। ১০ লাখের বেশি ইন্ডিয়ান নাগরিক অবৈধভাবে বসবাস করছে বাংলাদেশে। ৫৪ অভিন্ন নদীর পানি প্রবাহ বন্ধ করে দিতে বাঁধ তৈরি করেছে ইন্ডিয়ায়। প্রতিকারে কোন কথা নেই। শুধু ইন্ডিয়াকে সুযোগ সুবিধা দিয়েই যাচ্ছে সরকার। ৯ বছরে সীমান্তে কত মানুষ খুন করেছে ইন্ডিয়া!
এরকম অনেক কিছুই রয়েছে ফিরিস্তি দিয়ে শেষ করা যাবে না। একটি রাষ্ট্রকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
বিরোধী জোটের কি উচিত নয়, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সরকরের এসব ব্যর্থতার ফিরিস্তি জাতির সামনে তুলে ধরা? বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধবে কে? ভাষনের মৃদু সমালোচনা করেই কি বিরোধী জোটের দায়িত্ব পালন শেষ!
লেখক: দৈনিক আমারদেশ পত্রিকার বিশেষ প্রতিনিধি, বর্তমানে যুক্তরাজ্যে নির্বাসিত