অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক বৈশিষ্ট্য হলো নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করা। জনগণ যেখানে স্বাধীনভাবে তাদের পছন্দের ব্যক্তিকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবে। তবে, বাংলাদেশে নির্বাচনের এ প্রক্রিয়ার বিলুপ্তি ঘটেছে দীর্ঘদিন আগেই। বিশেষ করে ২০০৯ সালে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই এ অবস্থার সূচনা হয়।
বাংলাদেশে এক সময় প্রতিটি নির্বাচনই ছিল জনগণের কাছে উৎসবের মতো। নির্বাচন আসলেই মানুষের মধ্যে ঈদের আনন্দ নেমে আসতো। কিন্তু, ২০১২ সালের পর থেকে সেই আনন্দ-উৎসব আতঙ্কে পরিণত হয়।
দেখা গেছে, বিগত কয়েক বছর তফসিল ঘোষণার পর থেকেই শুরু হয়ে যেতো হানাহানি, মারামারি, প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর, প্রতিপক্ষের লোকদের মারধর ও সংঘাত-সংঘর্ষ। নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসতো সাধারণ মানুষের মধ্যে ভয়ভীতি ও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ততই বাড়তে থাকতো।
আর নির্বাচনের দিনতো অধিকাংশ ভোট কেন্দ্রই যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হতো। ভোটকেন্দ্র দখল, জাল ভোট, ব্যালট ছিনতাই করে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া, প্রতিপক্ষের এজেন্টদেরকে বের করে দিয়ে ব্যালটে সিল মারাসহ ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা যা যা করা দরকার সবই করেছে। এছাড়া হামলা-ভাঙচুর, গুলি, অগ্নিসংযোগ ও হতাহতের ঘটনাতো আছে।
কিন্তু, রকিব কমিশন বরাবরই সব কিছু অস্বীকার করে বলেছে যে এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা। নির্বাচন স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু হয়েছে। ব্যর্থতার দায় তারা কখনো স্বীকার করেন নি।
এদিকে, ২০১৭ সালে রকিব কমিশনের বিদায়ের পর মানুষের ধারণা ছিল সহিংসতাও মনে হয় বিদায় নিয়েছে। নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশনের আমলে হয়তো নির্বাচনে আর সেই সহিংসতা দেখা যাবে না। ভয়ভীতি ও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছাড়াই মানুষ স্বাধীনভাবে তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করতে পারবেন।
কিন্তু, দেশের বিভিন্ন স্থানে বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনের চিত্র দেখে মনে হচ্ছে নির্বাচনের সেই সহিংসতা আবারো ফিরে এসেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কুমিল্লার নাঙ্গলকোটে কমপক্ষে ২০ কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দলের লোকজন বুধবার রাতেই ব্যালট নিয়ে নৌকা প্রতীকে সিল মেরে রাখে। বৃহস্পতিবার সকালে ভোটাররা কেন্দ্র গিয়ে চেয়ারম্যান পদের ব্যালট পায়নি ভোট দেয়ার জন্য।
এরপর ভোট গ্রহণ শুরু হওয়ার পর যুবলীগ-ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বিভিন্ন কেন্দ্রে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে অবস্থান করে। তারা কেন্দ্র থেকে বিএনপির এজেন্ট ও সাধারণ ভোটারদের বের করে দিয়ে নৌকায় সিল মারে। আবার কোনো কেন্দ্রে ছাত্রলীগের ছেলেরা ধানের শীষের ব্যাজ ধারণ করে কেন্দ্রে ঢুকে নৌকায় সিল মেরেছে।
এছাড়া কিছু কেন্দ্রে ভোটার না থাকায় ক্ষমতাসীন দলের লোকজন তাদের নেতাকর্মীদেরকে ভোট কেন্দ্রে নিয়ে লাইনে দাঁড় করিয়েছে দেখানোর জন্য। কিছু কেন্দ্রে প্রিজাইডিং অফিসাররা নিজেরাই নৌকা প্রতীকে ভোট দিয়েছে। আবার কিছু কেন্দ্রে ভোটার না থাকায় ক্ষমতাসীন দলের লোকজন নাবালক স্কুলছাত্রদেরকে ভোট দিতে বাধ্য করেছে। নিজের জানের নিরাপত্তার কথা ভেবে প্রিজাইডিং অফিসাররাও কোনো প্রতিবাদ করার সাহস পায়নি।
একই অবস্থা গেছে ভোলা জেলার বিভিন্ন কেন্দ্রেও। জানা গেছে, বিএনপির প্রার্থীরা এসব বিষয় প্রশাসনকে জানালেও কোনো প্রতিকার পায়নি তারা। তাদের অভিযোগ, প্রশাসনের প্রশ্রয়েই ক্ষমতাসীন দলের লোকজন কেন্দ্রদখল করে নৌকায় সিল মেরেছে। অভিযোগ করেও কোনো ফল না পেয়ে বিএনপির কমপক্ষে ১৫ জন চেয়ারম্যান প্রার্থী বাধ্য হয়ে ভোট বর্জন করেছেন।
ব্যালট ছিনতাই, কেন্দ্রদখল, জাল ভোট, আগের দিন রাতেই ক্ষমতাসীন দলের লোকজন ব্যালট নিয়ে নৌকায় সিল মারার ঘটনায় মানুষের আবারও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদা তার পূর্বসূরী কাজী রকিব উদ্দিনের পথে হাটতে শুরু করেছেন বলেও মনে করছেন বিশিষ্টজনেরা।
কেউ কেউ বলছেন, নারায়ণগঞ্জ ও রংপুর সিটি নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার পেছনে নির্বাচন কমিশনের কোনো ভূমিকা নেই। সরকার ইচ্ছে করেই নির্বাচন দুইটি সুষ্ঠু করেছে। সুষ্ঠু নির্বাচন করতে নুরুল হুদা কমিশন যে সক্ষম নয় সেটা আজ কুমিল্লাতে আবারও প্রমাণিত হয়েছে।