ইবনে ইসহাক
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হাসিনা ওয়াজেদ বারংবার অভিযোগ করছেন, সৌদি আরবে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, তার দুই ছেলে- তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকো অবৈধ সম্পদ বিনিয়োগ করেছে। এই অভিযোগ তিনি সংসদে করেছেন, কম্বোডিয়া থেকে ফিরে সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন। সর্বশেষ গত ১৭ তারিখ বিজয় দিবসের একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন।
কম্বোডিয়া সফর সম্পর্কে অবহিত করতে ৭ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে সংবাদ সম্মেলন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সভাপতি মঞ্জুরুল আহসান বুলবুলের এ সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, সৌদিতে খালেদা জিয়া ও তারেক জিয়ার বিশাল শপিংমল ও সম্পদ পাওয়ার খবর বিদেশ থেকে এসেছে। টাকা পাচার, মানিলন্ডারিং বিএনপি এবং খালেদা জিয়ার ছেলেরা করেছে।
পরদিন তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় হাসিনার দেওয়া বক্তব্য মানহানিকর, মিথ্যা ও বানোয়াট বলে দাবি করেছে বিএনপি। অবিলম্বে এই ধরনের মানহানিকর মিথ্যা বক্তব্য প্রত্যাহার করে করে ক্ষমা না চাইলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ৮ তারিখ শুক্রবার সকালে গুলশানে চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এই মন্তব্য করেন।
প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, প্রধানমন্ত্রী মিথ্যা, বানোয়াট ও কাল্পনিক তথ্য নির্ভর বক্তব্য দিয়েছেন। বিএনপি চেয়ারপারসনকে রাজনৈতিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন করার জন্যই তিনি এই অলীক অপপ্রচার করছেন।
তিনি প্রধানমন্ত্রীকে তার বক্তব্য প্রত্যাহার করে খালেদা জিয়া ও জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানান। অন্যথায় তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের হুমকি দেন বিএনপির এই নেতা।
সেদিন প্রধানমন্ত্রীকে সতর্ক করে তিনি বলেন, ‘কাচের ঘরে বসে অন্যের ঘরে ঢিল ছুড়বেন না। বেআইনি মিথ্যা তথ্য প্রচার বন্ধ করুন এবং এই মানহানিকর মিথ্যা তথ্য প্রচারের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন। অন্যথায় আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে আমরা বাধ্য হব।’
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী কানাডাভিত্তিক একটি কথিত টেলিভিশন চ্যানেলের বরাত দিয়ে অপরিচিত কয়েকটি অনলাইন মাধ্যমে এই মিথ্যা তথ্য রটনা করা হয়েছে যে, খালেদা জিয়া ও তাঁর সন্তানেরা সৌদি আরবের ‘আল আরাফা’শপিংমল এবং কাতারে বাণিজ্যিক ভবন ‘তিনারাট’এ বিনিয়োগ করেছেন। আরাফাত রহমান কোকো কাতারে ‘ইকরা’নামের একটি বহুতল ভবনের মালিক। আরবসহ ১২টি দেশে জিয়া পরিবারের ১২ বিলিয়ন ডলারের (প্রায় এক লাখ কোটি টাকা) সম্পদ রয়েছে। এই অভিযোগ এনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণমাধ্যমকে শুধু অভিযুক্তই করেননি, রীতিমতো তিরস্কার করেছেন। তিনি সাংবাদিকদের কাছে জানতে চেয়েছেন কেন এই নিউজ প্রচার করা হল না?
জিয়া পরিবারের এই কথিত দুর্নীতির খবর প্রকাশিত হয়েছিলপ্রধানমন্ত্রীর তথ্য বিষয়ক উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী সম্পাদিত বাংলাদেশ অবজারভারে। প্রতিবেদনের সংবাদের উৎস বলা হয়েছিল ‘গ্লোবাল ইন্টিলিজেন্স নেটওয়ার্ক (জিআইএন) এবং কানাডার টিভি চ্যানেল দ্য ন্যাশনাল এই খবর দিয়েছে।
ইন্টারনেট ঘেঁটে দ্য ন্যাশনাল নামে কানাডার কোনো টিভি চ্যানেলের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। কানাডার রাষ্ট্রীয় টিভি চ্যানেলে দ্য ন্যাশনাল নামে একটি নিউজ প্রোগ্রামের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। তবে সেখানে সার্চ দিয়ে খালেদা সংক্রান্ত কোনো খবর পাওয়া যায়নি। আর ‘গ্লোবাল ইন্টিলিজেন্স নেটওয়ার্ক’নামে কোনো গণমাধ্যম ইন্টারনেটে খুঁজে পাওয়া যায়নি।’
প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক এমন গুজব ছড়ানোর প্রতিবাদে সেদিন মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘দায়িত্বশীল গণমাধ্যম স্বাভাবিকভাবেই কল্পিত এইসব তথ্যের ওপর ভিত্তি করে খবর প্রকাশ করেনি। সেই কারণে প্রধানমন্ত্রী শিষ্টাচারবিবর্জিত অশালীন ভাষায় গণমাধ্যমকে তিরস্কার করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর এই ধরনের মিথ্যা ভিত্তিহীন ও বানোয়াট বক্তব্য শুধু অশালীন নয়, এটা বেআইনি ও শাস্তিযোগ্য। খালেদা জিয়া, বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকোর বিরুদ্ধে সম্পদের কল্পকাহিনি জোর করে গণমাধ্যমে প্রচারের অপচেষ্টা শুধু শেখ হাসিনার রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও দেউলিয়াপনাই প্রমাণ করে।’
মির্জা ফখরুল ৮ ডিসেম্বর আরো বলেছিলেন, ‘দেশ বিদেশের পত্রপত্রিকায় আপনাদের দলের মন্ত্রী, নেতা ও পরিবারে সদস্যদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। কানাডার বেগমপাড়া, ব্রিটেন, আমেরিকা, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, বেলারুশ, সুইস ব্যাংক, পানামা অবশোর ইনভেস্টমেন্ট তালিকায় আপনাদের অনেকের নাম উঠে আসছে। ফ্লোরিডা, ওয়াশিংটন ডিসি, সিএটল বাফেলো, আমেরিকা, কানাডাসহ ব্যয়বহুল শহরগুলোতে কাদের সন্তানদের এবং পরিবারে সদস্যদের নামে বাড়ি ও সম্পদ কেনা হয়েছে, তার হিসাব জনগণ রাখছে।’
হাসিনা ওয়াজেদকে ক্ষমা চাইতে আহ্বান করে মির্জা ফখরুল বলেন ক্ষমা না চাইলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। প্রধানমন্ত্রী হাসিনা ওয়াজেদের ক্ষমা চাওয়ার তো কোন লক্ষণই নেই বরং তিনি আবারো সেই বানোয়াট তথ্য জাতির সামনে উপস্থাপন করেছেন।
এদিকে মির্জা ফখরুলেরও কোন তৎপরতা লক্ষনীয় নয়। আট তারিখের সংবাদ সম্মেলনের পর সারাদেশে আওয়ামী নেতারা এই বিষয়ে প্রচারণা চালিয়েছে। হাসিনা ওয়াজেদ আবারো বলেছেন। কিন্তু তিনি নির্বিকার। তার এই নির্বিকার অবস্থা কেন? তিনি কি ভয় পেয়েছেন? নাকি বিচার ব্যবস্থার উপর তার আস্থা নেই। তার এই নির্বিকার অবস্থার মানে তো এমনও হতে পারে বিএনপি জিয়া পরিবারের বিরুদ্ধে আনা এই অভিযোগ মেনে নিয়েছে। আসল ব্যাপারটা কী? মির্জা ফখরুল কি আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন?
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট
Discussion about this post