অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
সরকারি মাধ্যমিক স্কুলে এসকেলেটর (চলন্ত সিঁড়ি) স্থাপনের নামে এক মহা লুটপাটের প্রকল্প হাতে নিয়ে সরকার। জানা গেছে, ১,১১৬ কোটি টাকার বিশাল ব্যয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ১৬৩টি স্কুলে এসকেলেটর স্থাপন করার প্রস্তাব দিয়েছে মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতর। প্রতি জোড়া এসকেলেটরের ব্যয় ধরা হয়েছে ৬ কোটি ৮৫ লাখ টাকা।
অপ্রয়োজনীয় ও অযৌক্তিক এই প্রকল্প নিয়ে সমালোচনার ঝড় বইছে সর্বত্র। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেবলমাত্র লুটপাটের জন্যই এই প্রকল্প হাতে নিতে যাচ্ছে সরকার। প্রকল্পে প্রতি জোড়া এসকেলেটরের ব্যয় ধরা হয়েছে ৬ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। অথচ বাজারে ২০-৪০ লাখ টাকায় অনেক উন্নত মানের প্রতি জোড়া এসকেলেটর পাওয়া যাচ্ছে। এসকেলেটর স্থাপনসহ যাবতীয় ব্যয় মিলে যদি প্রতি জোড়া এসকেলেটরের জন্য এক কোটি টাকা খরচও ধরা হয় তাতেও ৫ কোটি ৮৫ লাখ টাকা উদ্বৃত্ত থেকে যাচ্ছে। এসব টাকা লুটপাট করে ক্ষমতাসীনদের পকেট ভরার জন্যই যে এই প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে সেটা এখান থেকেই স্পষ্ট।
অন্যদিকে দেশের শিক্ষার মান, শিক্ষাদান পদ্ধতি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সুযোগ-সুবিধার অপ্রতুলতা নিয়ে যখন বিতর্ক তুঙ্গে, তখন অবকাঠামো উন্নয়নের নামে এসকেলেটর নামক বিলাসী প্রকল্পের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে খোদ সরকারের পরিকল্পনা কমিশন। একই সাথে এ ধরনের অদ্ভুত প্রস্তাবকে বিশাল আকারের লুটপাটের পরিকল্পনা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, যেখানে দেশের বেশির ভাগ সরকারি, আধা সরকারি ও বেসরকারি স্কুলের অবকাঠামো খুবই দুর্বল, ভবন ও ক্লাস রুমের সঙ্কট, বৈদ্যুতিক পাখা ও বাতির সঙ্কট, টয়লেটগুলো ব্যবহার অনুপযোগী, লাইব্রেরি, ল্যাব ও কম্পিউটার কক্ষ নেই বললেই চলে; সেখানে এসকেলেটরের মতো ব্যয়বহুল যান্ত্রিক সিঁড়ি স্থাপন শুধু গরিবের ঘোড়া রোগই নয়, বিপজ্জনকও বটে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাশের দেশসহ অধিকাংশ উন্নত দেশেই স্কুলপর্যায়ে এ ধরনের এসকেলেটরের ব্যবহার নেই। আর দেশের অধিকাংশ বিদ্যালয়ই দোতলার বেশি নয়। কাজেই দোতলায় ওঠানামার জন্য এসকেলেটরের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও এ নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। সাপ্তাহিক সম্পাদক ও টকশো ব্যক্তিত্ব গোলাম মোর্তোজা তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে লিখেছেন, “মস্তিস্ক কতটা উর্বর হতে পারে! ১৬৩ টি সরকারি মাধ্যমিক স্কুলে চলন্ত সিঁড়ি বা এসকেলেটর স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এর জন্যে খরচ হবে ১ হাজার ১ ‘শ ১৬ কোটি টাকা। প্রথমত: এই এসকেলেটরগুলো ৬ মাস থেকে ১ বছরের মধ্যে নষ্ট হয়ে যাবে। এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ- সংস্কার করা স্কুলগুলোর পক্ষে অসম্ভব। দ্বিতীয়ত: অস্বাস্থ্যকর জাঙ্ক ফুড প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের জন্যে স্বাস্থ্যগত দিক বিবেচনাতেও, এসকেলেটর স্থাপন অবৈজ্ঞানিক। যেখানে এখন বড়দেরও লিফটের পরিবর্তে সিঁড়ি ব্যবহারে উৎসাহিত করা হয়। তৃতীয়ত: আসলে কী শিক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করে ১১১৬ কোটি টাকার প্রকল্প।!? বি.দ্র: ঔদ্ধত্যের সীমা ছাড়িয়েছে দুর্নীতিবাজরা: দুদক চেয়ারম্যান। ”
জাহিদ রহমান নামে একজন মন্তব্য করেছেন, “অনেক স্কুলের শিক্ষার্থীরা এখন গাছের নিচে ক্লাস করে সেগুলো ঠিক করা প্রয়োজন সবার আগে। চর ও হাওরের শিক্ষাথীদের জন্যে কোনো নৌকা নেই। আমরা গবেষণায় দেখেছি নৌকা ভাড়া দিতে না পারায় অনেক শিক্ষার্থী স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয় বর্ষা ও বন্যার কালে।”
আলি আহমেদ নামে আরেকজন মন্তব্য করেছেন, “ঢাকায় ফুটওভার ব্রিজে স্থাপিত এসকেলেটর সবগুলিই নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। এয়ারপোর্ট সংলগ্ন ব্রিজের একই দশা। এসকেলেটর সাইড বন্ধ করে দেওয়ায় ব্রিজগুলির একদিকে উঠানামা করতে গিয়ে মানুষ জটের সৃষ্টি হয়।”
ধ্রুবতারা নামে একজন মন্তব্য করেছেন, “এগুলো ধান্ধাবাজি , দেশের টাকা লুটপাট করার নতুন নতুন কৌশল । যেদেশে স্কুল ঘর অনিরাপদ , সংস্কারের অভাবে ছাত্র ছাত্রীদের মাথায় পড়ার উপক্রম, সেখানে এসব সিদ্ধান্ত হাস্যকর। দেশটাকে যতদিন নি:শেষ না করবে ততদিন ক্ষমতাসীনদের এসব অত্যাচার চলতে থাকবে । মানুষ সবকিছু দেখেও না দেখার ভান করবে।”
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসকেলেটর স্থাপনের পক্ষে অবস্থান নিয়ে সংশ্লিষ্ট অধিদফতরের যুক্তি হলো, এর মাধ্যমে এক সাথে অনেক শিক্ষার্থী ওঠানামা করতে পারবে। বহুতল ভবনে তাদের ওঠানামার পরিশ্রম কমে যাবে। অন্য দিকে পিইসি বলছে, এমনিতেই স্কুলগুলোতে জায়গার স্বল্পতা রয়েছে, তার ওপর এসকেলেটর স্থাপনের জন্য অনেক জায়গা প্রয়োজন। এসকেলেটর স্থাপন করতে গেলে প্রতিটি ভবনের মাঝের ও নিচের ফ্লোর ভাঙতে হবে, যা অনেক ব্যয়সাপেক্ষ। এগুলো করতে গেলে একটি বড় সময়ের জন্য স্কুল বন্ধ দিতে হবে; যাতে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার ক্ষতি হবে। তা ছাড়া স্কুল শুরু ও ছুটির সময় শত শত শিক্ষার্থী একসাথে ওঠানামা করতে গেলে ধাক্কাধাক্কিতে পড়ে দুর্ঘটনার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। এসকেলেটর কোনো কারণে আটকে গেলে কোমলমতি শিশুরা আতঙ্কিত হয়ে ছোটাছুটি করলে দুর্ঘটনা অনিবার্য। এতে শিশুদের মাঝে ভীতিসহ নেতিবাচক মানসিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।
বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন নয়াদিগন্ত পত্রিকাকে বলেন, এ ধরনের প্রকল্প প্রস্তাবনা হাস্যকর মনে হচ্ছে। এ প্রকল্পের আর্থিক সুবিধাটা কী হবে সেটি ভেবে দেখতে হবে। আমাদের মতো দেশে যেখানে এখনো শিক্ষা সুবিধায় অনেক সঙ্কট রয়েছে, সেখানে এ ধরনের একটা প্রকল্প অযৌক্তিক। তিনি বলেন, বিদ্যালয় পর্যায়ে বিদেশের কোথাও আমি এসকেলেটর ব্যবহার দেখিনি। এটি বিমানবন্দর, শপিংমলসহ যেখানে লোকসমাগম অনেক বেশি থাকে, সেখানে ব্যবহার করা হয়। এ প্রকল্প মানে অর্থের অপচয়। এসকেলেটর দিয়ে না হবে শিক্ষা, না হবে স্বাস্থ্য।
Discussion about this post