রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়নের নিন্দা ও তাদেরকে নাগরিক অধিকার দিয়ে ফেরত নেয়ার আহ্বান জানিয়ে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে একটি প্রস্তাব পাস করেছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল।
মঙ্গলবার জেনেভায় সংস্থার এক বিশেষ অধিবেশনে বাংলাদেশের উত্থাপিত প্রস্তাবটির পক্ষে ৩৩টি ভোট পড়ে। চীন ও ফিলিপাইনসহ তিনটি দেশ প্রস্তাবের বিপক্ষে আর ভারতসহ ৯টি দেশ ভোটদানে বিরত ছিল।
দুটি দেশ ছিল অনুপস্থিত। ৪৭টি দেশ কাউন্সিলের সদস্য। ‘মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠী ও অন্য সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার পরিস্থিতি’ শীর্ষক কাউন্সিলের ২৭তম বিশেষ অধিবেশনে আলোচনা শেষে প্রস্তাবটি পাস হয়।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো এ খবর দিয়েছে। ভোট শেষে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলমও সাংবাদিকদের একই তথ্য জানান। অধিবেশনে তিনি বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন।
অধিবেশনে ভাষণে কাউন্সিলের প্রধান জেইদ রাদ আল হুসেন বলেছেন, মিয়ানমারের রাখাইনে ‘গণহত্যা’ সংঘটিত হয়েছে। মানবাধিকার নিশ্চিত না করে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ‘অপরিপক্ব’ হবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
প্রথমবারের মতো তিনি গণহত্যার কথা বলেছেন। জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের ওপর হত্যাযজ্ঞকে গণহত্যা বলায় মিয়ানমারের ওপর চাপ বাড়বে। জাতিসংঘের সংজ্ঞা অনুযায়ী গণহত্যাকে সবচেয়ে বড় মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে দেখা যায়। তবে আন্তর্জাতিক আইনে জাতিগত নিধনকে আলাদা কোনো অপরাধ হিসেবে স্বীকার করা হয়নি।
তিনি রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়নকে ‘ব্যাপকভিত্তিক, কৌশলগত, মর্মান্তিক এবং বর্বর’ হিসেবে উল্লেখ করে আন্তর্জাতিক তদন্তের আহ্বান জানান। রাদ আল হুসেন বলেন, রাখাইনে রোহিঙ্গাদের যা করা হয়েছে তাতে গণহত্যার যথেষ্ট নজির রয়েছে। রোহিঙ্গাদের ঘরের ভেতর আটকে রেখে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। তাদেরকে কাছ থেকে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে এবং গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।
অমানবিকভাবে মারধর, ছুরিকাঘাত, ধর্ষণসহ নিপীড়নের কথা উল্লেখ করে রাদ আল হুসেন বলেন, ‘এত ঘটনার পরও (সেখানে) গণহত্যার উপাদান অস্বীকার করা যায়?’ রাদ আল হুসেন এর আগে রোহিঙ্গা নিধনকে ‘জাতিগত নিধনের পাঠ্যপুস্তকীয় দৃষ্টান্ত’ বলে মন্তব্য করেছিলেন।
অধিবেশনে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বলেন, রোহিঙ্গাদের এবারের দেশত্যাগ ১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডার গণহত্যার সঙ্গে তুলনীয়। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা সংকট এখন আর দ্বিপক্ষীয় সমস্যা নয়।
অধিবেশনে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কোনো দেশের নাম উল্লেখ না করে বলেন, ‘আমাদের কিছু বন্ধু বলেছে বিষয়টি দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমাধান করার জন্য। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এটি আর দ্বিপক্ষীয় বিষয় নেই।’
তিনি বলেন, ‘আমরা বিষয়টি সব সময় দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমাধানের চেষ্টা করেছি কিন্তু মিয়ানমার বিশেষ করে ২০০৫-এর পর থেকে কখনোই আগ্রহ দেখায়নি। আমরা বিশ্বাস করি, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রাখার প্রয়োজন আছে।’ গত মাসে দু’দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটি সামগ্রিক সমাধানের একটি অংশ।’
অধিবেশনে ভাষণে রাদ আল হুসেন বলেন, রোহিঙ্গাদের ওপর উন্মত্ততা এখনই থামাতে হবে। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, রোহিঙ্গারা আর কত দুর্ভোগ সইলে তাদের (মিয়ানমার) সরকার এবং বিশ্ব তাদের আত্মপরিচয় এবং অধিকার স্বীকার করে নেবে?’ তিনি রোহিঙ্গাদের ওপর এ দফার নিপীড়ন তদন্তে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদকে একটি নিরপেক্ষ ও স্বাধীন তথ্যানুসন্ধান মিশন পাঠানোর আহ্বান জানান। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে কিনা তা তদন্ত করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে সংশ্লিষ্ট আদালতকে।
রাদ আল হুসেন জানান, রোহিঙ্গাদের দুর্দশার কথা শুনতে চলতি বছর বাংলাদেশে তিনটি টিম পাঠিয়েছেন তিনি। তারা রাখাইনে হত্যা, ধর্ষণসহ অকল্পনীয় নিপীড়নের বর্ণনা দিয়েছে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, স্থানীয়রা তো বটেই, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও রোহিঙ্গাদের রোহিঙ্গা নামে ডাকতে চায় না। ফলে তাদের আত্মপরিচয়ের অধিকারও কেড়ে নেয়ার চেষ্টা হচ্ছে।
তিনি বলেন, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের যেভাবে পৈশাচিকভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে তাতে ভবিষ্যতে তাদের ওপর আরও নিপীড়ন নেমে আসতে পারে। নব্বইয়ের দশকে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর পর তাদের ওপর নিপীড়ন চালানো হয় এবং তারা আবার বাংলাদেশে ফিরে আসে। তাই রোহিঙ্গাদের অধিকার নিশ্চিত না করে তাদের ফেরত পাঠানো হলে তা হবে অপরিপক্ব।
রোহিঙ্গাদের ওপর মানবাধিকার লংঘনের বিষয়ে সম্প্রতি মানবাধিকার কাউন্সিলের বিশেষ অধিবেশনের প্রস্তাবটি উত্থাপন করেছিল বাংলাদেশ ও সৌদি আরব। ৪৭ দেশ জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের সদস্য। এই কাউন্সিলের বিশেষ অধিবেশন ডাকার জন্য এক-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ ১৬টির বেশি দেশের সমর্থন প্রয়োজন।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, জাপানসহ কাউন্সিলের ৩৩টি সদস্যদেশ ও ৪০টি পর্যবেক্ষক দেশ বিশেষ অধিবেশন ডাকার প্রস্তাবে সমর্থন দেয়। জানা গেছে, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রস্তাবটি সর্বসম্মতভাবে পাস করানোর চেষ্টা করা হয়। তবে চীনের বিরোধিতার কারণে তা সম্ভব হয়নি।
বাংলাদেশের সঙ্গে প্রত্যাবাসন চুক্তির কথা বলে অধিবেশনে পরিস্থিতি কিছুটা অনুকূলে নেয়ার চেষ্টা করেন জেনেভায় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত হটিন লিন। তিনি বলেন, স্বেচ্ছায়, নিরাপদে, সমর্যাদায় এবং টেকসই প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে তার সরকার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত।
তবে এ সময় তিনি রোহিঙ্গা শব্দ উচ্চারণ করেননি। হটিন বলেন, মিয়ানমারে ফেরার পর রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পে রাখা হবে না। তবে অধিবেশনে মিয়ানমার বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ দূত ইয়াংঘি লি বলেন, ফেরত আসা রোহিঙ্গাদের জন্য ইতিমধ্যে ক্যাম্প বানাতে শুরু করেছে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ। ফলে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের পর তাদের অবস্থা নিয়ে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
যৌন সহিংসতা বিষয়ক জাতিসংঘের শীর্ষ কর্মকর্তা প্রমিলা প্যাটেন অধিবেশনে নারীদের ওপর যৌন নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র বর্ণনা করেন। রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনকারী প্রমিলা বলেন, ‘মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী গণশাস্তির হাতিয়ার হিসেবে ধর্ষণকে ব্যবহার করেছে। নারী ও তরুণীদের গাছের সঙ্গে বেঁধে বহু সেনা আক্ষরিক অর্থেই গণধর্ষণ করে তাদের হত্যা করেছে।’
জানা গেছে, এক দশক আগে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অধিবেশন ডেকেছিল জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিল। ২০০৭ সালের অক্টোবরে জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের পঞ্চম বিশেষ অধিবেশনে মিয়ানমারের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার পর একটি প্রস্তাব পাস হয়েছিল। প্রস্তাবটিতে মিয়ানমারে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ সহিংসভাবে দমনের নিন্দা জানানোর পাশাপাশি কারাবন্দি সব রাজনীতিবিদকে মুক্তির দাবি করা হয়।
থার্ড কমিটি নামে পরিচিত জাতিসংঘের সামাজিক, মানবিক ও সংস্কৃতিবিষয়ক ফোরামে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে বিপুল ভোটে প্রস্তাব পাসের ১৮ দিন পর জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে একটি প্রস্তাব পাস হল।
জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের বিশেষ অধিবেশনে প্রস্তাব পাসের তাৎপর্য সম্পর্কে কূটনীতিকরা বলেছেন, সাধারণ কাউন্সিলের নিয়মিত অধিবেশনে পাস হওয়া প্রস্তাব মেনে চলার বাধ্যবাধকতা আছে।
বিশেষ অধিবেশনের প্রস্তাবও সেভাবে অনুসরণ করতে হয়। এ বিষয়টি বিবেচনায় নিলে প্রস্তাবটি পাস হওয়া যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।
Discussion about this post