মাসুদ মজুমদার
এক দিকে চলছে রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টির নানামুখী উদ্যোগ-আয়োজন। অন্য দিকে আছে রাজনীতিতে জায়গা করে নেয়ার অন্তহীন প্রচেষ্টা। তার পরও বলতে হবে, বাংলাদেশের রাজনীতি এখন নির্বাচনমুখী। কার্যত বিরোধী দল এখনো মহাজোট সরকারের নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রের কারণে আড়ষ্ট, তবে আত্মপ্রত্যয়ী। প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সরকারি বাধার কারণে বিরোধী দল রাজপথে সক্রিয় হতে পারে না, কিন্তু জনমনে আবার বেগম খালেদা জিয়ার উপস্থিতি দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়ে উঠছে। বিরোধী দলকে রাজনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়নে বাধা দিতে সরকার এখনো চরমপন্থা অবলম্বন করে চলেছে। হামলা-মামলা, ধরপাকড় ও গুম-অপহরণ কমলেও অব্যাহত রয়েছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর অবস্থান কিছুটা শিথিল হলেও সরকার ও সরকারি দলের অনুগত হয়ে কাজ করতে তারা বাধ্য হচ্ছে। দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি এখনো সরকারের নিয়ন্ত্রণে। দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের আগের মতোই ব্যবহার করা হচ্ছে। পুলিশ নিজ ইচ্ছায় কিছু করতে পারে না; কিন্তু ‘ধরে আনতে বললে বেঁধে আনা’র কাজটি অতি উৎসাহের সাথেই করছে। তাই অর্থনীতি, রাজনীতি এমনকি ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলোও সরকার নিয়ন্ত্রিত অল্প কিছু লোকের হাতে জিম্মি হয়ে যাচ্ছে। উন্নয়নের ডুগডুগি যতই বাজুক, দেশের অর্থনীতি ভালো নেই। বিনিয়োগ আসছে না। সিন্ডিকেট করে পণ্যের অযৌক্তিক দাম বাড়িয়ে বণিকেরা পুঁজি স্ফীত করছে। অবক্ষয়, দুর্নীতি ও অনৈতিকতা সব কিছুকে গ্রাস করছে। নিষ্ঠুরতা, নৃশংসতা ও পৈশাচিকতার প্রসার ঘটেছে। সাংবিধানিক সংস্থাগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না। দুদক নিয়ে টিআইবির মন্তব্য ষোলআনা সত্য। অপরাজনীতি, দলীয়করণ ও দমননীতির কারণে দেশের পরিস্থিতিতে একধরনের গুমোট পরিবেশ ও অনিশ্চয়তার গন্ধ ছড়াচ্ছে।
এ পরিস্থিতির মধ্যেও জনগণ যখনই সুযোগ পায়, বিরোধীদলীয় জোট বিশেষত, খালেদা জিয়াকে ইতিবাচক অর্থে সমর্থনের গ্রিন সিগন্যাল দেয়। অর্থাৎ জোরজবরদস্তি করে সরকার পরিচালিত হলেও- এই পুলিশি ব্যবস্থার ভেতরেও জনগণ তাদের ক্ষোভ ও অসন্তুষ্টির কথা নিঃশব্দে জানান দিতে চেষ্টা করে।
সরকার যখন বিচার বিভাগ ও প্রধান বিচারপতির ওপর অনভিপ্রেত হস্তক্ষেপ করেছে- তখন জনগণের অভিমত বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও প্রধান বিচারপতির অবস্থানের পক্ষে দেখা গেছে। ১২ নভেম্বরের জনসভার অনুমতি দিয়েও জনসমাগম নিয়ন্ত্রণের অপচেষ্টা জনগণের চোখে সরকারের অবস্থান মোটেও উন্নত করেনি। বিএনপি-জামায়াতের প্রতি সরকারের বাড়াবাড়িমূলক আচরণকে জনগণ সমর্থন দিচ্ছে না। বরং বিএনপি-জামায়াতের ধৈর্যের রাজনীতি তাদের প্রতি সিম্প্যাথি ও সমর্থন বাড়াচ্ছে; কিন্তু দেশকে সামগ্রিক অর্থে পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত করার কারণে মিডিয়া সেল্ফসেন্সরশিপ মেনে চলতে বাধ্য হচ্ছে। যারা আশ্রিত ও প্রশ্রয়প্রাপ্ত, তারাও অহেতুক মোসাহেবি করে নিজেদের ক্রেডিবিলিটি হারাচ্ছে। বোবাকান্নার আসল কারণ, গণতন্ত্র চর্চা বাধাগ্রস্ত হওয়ায় ভিন্নমতগুলো প্রকাশ্যে প্রতিফলিত হতে পারছে না, এতে পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সরকার।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আনাগোনা বাড়লেও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি এখনো ভারতনির্ভর। ভারত আওয়ামী লীগ সরকারকে সর্বাবস্থায় বিবেচনায় রাখতে চায়। এর বাইরে জাতীয়তাবাদী ও ইসলামি শক্তির উত্থান ঠেকাতেও ভারতীয় গোয়েন্দা ও রাষ্ট্রশক্তির আগ্রহ সীমাহীন। সরকার এ কারণে আন্তর্জাতিক বলয়ে বাংলাদেশকে তুলে ধরতে পারছে না। একইভাবে, বাংলাদেশের স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতিও আধিপত্যবাদের কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
জঙ্গিপনা ও চরমপন্থা বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের স্বভাববিরুদ্ধ। এ দেশের গরিষ্ঠ মানুষ শান্তিকামী ও ধার্মিক প্রকৃতির, গণতন্ত্রমনা এবং অসাম্প্রদায়িক। জঙ্গি সাজার দায় সরকারের, চরমপন্থী বানায় অসহিষ্ণু রাজনীতি। সাম্প্রদায়িকতার বিষ ঢালে মতলববাজেরা। সংখ্যালঘুরা প্রকৃত ইসলামপন্থীদের কখনো অনিরাপদ মনে করে না। তার পরও শাসকদের ভয়ে তাদের ভোটব্যাংক হয়ে আধিপত্যবাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নকে অধিকতর নিরাপদ ভাবে। এটা বিভক্তির রাজনীতির কুফল। তাই বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভোটের সংখ্যাতত্ত্ব আমলে নেয়ার মতো একটি বিষয়। কারণ আধিপত্যবাদের বৈরিতার কারণেই গড়ে ৩৭ থেকে ৪১ শতাংশ জনসমর্থন বিএনপি তথা জাতীয়তাবাদী শক্তির পক্ষে। এ ধারায় রাজপথের কর্মী কম, জনসমর্থন বেশি। জাতীয়তাবাদী শক্তির সাথে মডারেট ইসলামপন্থী দলগুলোর সম্পর্ক নিবিড়। জোটবদ্ধ না থাকলেও ইসলামপন্থীদের সমর্থন বিএনপির দিকে ঝুঁকে থাকে আধিপত্যবাদবিরোধী অবস্থান এবং লিবারেল ধারার রাজনীতি চর্চা ও আদর্শগত কারণেই। এখানে পাওয়া-না-পাওয়ার বিষয় গৌণ। তেমনি বামপন্থীরা ঝুঁকে থাকে আওয়ামী লীগের দিকে, এটাও একধরনের ‘মন্দের ভালো’ পছন্দের মতো বিষয়। এ ছাড়া, ইসলামপন্থী দলগুলো ও জামায়াতের কর্মীবহুল অবস্থান সরকার ও বামপন্থীদের দুশ্চিন্তার কারণ। কেননা, জনসমর্থনের বিবেচনায় রক্ষণশীলভাবে হিসাব করে ধরলেও এদের জনসমর্থন বেশি, ভোটের হিসাবে সেটা ক্ষেত্রবিশেষে ১৫ শতাংশের কম নয়, যদিও এটি অসঙ্ঘবদ্ধ। কাস্টিং ভোটের গড় হার সাধারণত ৬০ শতাংশের বেশি হয় না। এই সংখ্যাতত্ত্ব বিএনপি-জামায়াতবিরোধী সব প্রতিপক্ষকে ভাবায়।
এ সংখ্যাতত্ত্ব জাতীয়তাবাদী ইসলামি শক্তির জন্য একটি আশীর্বাদ, একইসাথে একধরনের ‘অভিশাপ’ও। কারণ, ভোটের এ হিসাব আওয়ামী লীগ ও বামপন্থীদের ভড়কে দেয়। হেফাজত ট্র্যাজেডি এবং তোষণ এর বড় প্রমাণ। তাই প্রতিপক্ষ নির্বাচনকে ভয় পায়। ম্যানিপুলেট করে সরকারে যাওয়ার পথ খোঁজে। এ কারণেই ’১৪ সালের ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে ভারতের সমর্থনে আওয়ামী লীগ একতরফা নির্বাচনের পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। দল হিসেবে জামায়াত এখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দল। তার পরও সরকার নানাভাবে বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে ভাঙন ধরাতে চায়। জুলুম করে একটি রাজনৈতিক দলকে নিশ্চিহ্ন করা সম্ভব নয় এটা সরকারের বিলম্বিত বোধোদয়। তাই জোট ভাঙা কিংবা জোট থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার কৌশলও রয়েছে। তবে কিছু ভুলবোঝাবুঝি থাকলেও বিএনপি বা জামায়াত, কেউ জোট ভেঙে দিতে চায় না। তাই বলে সরকারের জোট ভাঙার অন্তহীন চেষ্টা থেমে নেই।
এবার আওয়ামী লীগ-বামপন্থী সরকার নির্বাচন করতে আগ্রহী হওয়ার কারণ, বৈধতার সঙ্কট এ সরকারকে বিগত চার বছর ধরে বিব্রত করে চলেছে। এই কষ্ট অসহনীয়, জুতার তলায় তারকাঁটার খোঁচার মতো। তাই ভারতের পৃষ্ঠপোষকতা ধরে রেখেও কৌশলটা সরকার পাল্টাতে চাচ্ছে। এবার একটা নির্বাচন চায়; কিন্তু ছলে বলে কৌশলে সরকার গঠনের লক্ষ্যে পৌঁছতে চাইলেও বিএনপিকে সংসদে নিতে চায়, সরকারে যেতে দিতে চায় না। বিএনপি সংসদে থাকুক, রাজপথে নয় এটা সরকারের ইচ্ছা এবং তারা চায়, বিরোধী দলের আসনে বসুক; কিন্তু সরকার গঠনের পথ করে দিতে এখন পর্যন্ত সরকারের অবস্থান নেগেটিভ। এই কৌশল সম্পর্কে বিএনপিও ওয়াকিবহাল। তাই রাজনৈতিক সমঝোতার পথে দুই কদম এগিয়ে পাঁচ কদম পেছানোর এতসব কাসুন্ধি।
অন্য দিকে, নানা কারণে বর্তমান সরকার জনসমর্থনহীন হয়ে পড়েছে। সাধারণভাবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হলে বিএনপি-জামায়াত জোট উল্লেখযোগ্য আসন পাবে। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক রাজনৈতিক দলগুলোর যে নিবন্ধনপ্রক্রিয়া রয়েছে, তাতে নিবন্ধন বাতিল হওয়ার কারণে জামায়াত দলীয়ভাবে নিজেদের প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করতে পারবে না। তবে স্বতন্ত্র এবং বিএনপির প্রতীকে নির্বাচন করার সুযোগ এখনো আছে। জামায়াত আশা করে, পরিবেশ যা-ই হোক, স্বতন্ত্র এবং জোটের প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেও তারা ভালো ফল পাবে। দলটির নীতিনির্ধারক ও কেন্দ্রীয় পর্যায়েরও অনেক নেতা মামলার জালে জড়িয়ে রয়েছেন। বেশ ক’জন কেন্দ্রীয় নেতা কারাগারে। যুদ্ধাপরাধ মামলায় শীর্ষ পাঁচজনের সর্বোচ্চ শাস্তি আর কয়েকজনের বার্ধক্যজনিত মৃত্যুর কারণে দলটি কার্যত নেতৃত্বশূন্যতায় রয়েছে। প্রকাশ্য তৎপরতাও চালাতে পারে না। অফিসগুলো তালাবদ্ধ। শত শত কর্মী কারাগারে। অসংখ্য মধ্যম সারির নেতা হুলিয়া মাথায় আত্মগোপনে।
এবার নির্বাচনের আবহ সৃষ্টির প্রাক্কালেই বিএনপি-জামায়াতের ওপর সরকার আরো এক দফা ধরপাকড় ও মামলার আঘাত হেনেছে। তার পরও জনগণ পরিবর্তনপ্রত্যাশী। ইতোমধ্যে ছয়টি সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। এ সরকারের আমলে দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া কোনো স্থানীয় নির্বাচনও নিরপেক্ষ হয়নি। তাই সর্বাবস্থায় আশঙ্কা থেকে যায় অনাকাক্সিক্ষত কিছু ঘটে যাওয়ার। আবারো ‘এক-এগারো’ ধরনের মিশ্র একটা কিছু ঘটবে কি না, সময়ই তা বলে দেবে। তবে মোটামুটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে ভোট দেয়ার সুযোগ পেলে জনগণ জাতীয়তাবাদী ইসলামি শক্তিকেই ক্ষমতায় পাঠাতে সচেষ্ট হবে এ ব্যাপারে তাদের দ্বিধা নেই। কারণ ভোটের সংখ্যাতত্ত্বের সাথে এ সরকারের ইমেজ তলানিতে পৌঁছে যাওয়ার বিষয়টি আর রাখঢাক করার ব্যাপার নয়।
গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের লক্ষ্যে দুই পক্ষই ছাড় দেয়ার একটা ইচ্ছা ধারণ করে বসে আছে। তবে রাজনৈতিক কৌশলের কারণে কেউ কারো অবস্থান জানান দিতে যাবে না। বর্তমান সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ। তাই সাংবিধানিক কাঠামোর ভেতর থেকেও গ্রহণযোগ্য ফর্মুলা নিয়ে সামনে এগোনোর পথ অবারিত হতে পারে। নির্বাচন কমিশন অনেক সুপারিশ পেয়েছে। নিবন্ধন না থাকলেও জামায়াতে ইসলামী ১৬ দফা সুপারিশ মিডিয়ায় সরবরাহ করেছে। সরকার ছাড়া সবার অবস্থান একই সমতলে। তাই ব্যাটে-বলে মিলে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তা ছাড়া আন্তর্জাতিক মহল তথা বিশ্বসম্প্রদায়ও তাদের প্রত্যাশার বিষয়টি জানিয়ে রেখেছে।
সূত্র: নয়াদিগন্ত
Discussion about this post