প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা দীর্ঘ ছুটি শেষে দেশে ফিরছেন আর কয়েকদিন পরেই। সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে তিনি এই সপ্তার শেষে কিংবা আগামী সপ্তার শুরুতেই দেশে ফিরবেন। অবশ্য এমন ইঙ্গিত এস কে সিনহা ঢাকা ত্যাগের কিছুক্ষণ আগে প্রকাশ্যেই জানিয়ে গেছেন। কিন্তু তারপরও মানুষের মনে প্রশ্ন, প্রধান বিচারপতি আদৌ ফিরতে পারবেন কিনা এবং দেশে ফেরা সম্ভব হলেও পদে বসতে পারবেন কিনা?
প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা বিদেশ যাবার পর সুপ্রিম কোর্টের বিবৃতির ধারাবাহিকতায় এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেছেন, তিনি দেশে ফিরে এলেও দায়িত্বে বসতে পারবেন না। কিন্তু এরপরে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ও দিল্লীতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী প্রায় একই সঙ্গে বলেছেন, প্রধান বিচারপতি দেশে ফিরে পদে বসতে পারবেন। এতে কোনও বাধা নেই। অন্যদিকে আবার আইন মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এডভোকেট আবদুল মতিন খসরু এর পাল্টা বক্তব্য দিয়ে বলেছেন, প্রধান বিচারপতির দায়িত্বে বসা সুদূর পরাহত।
গত ১৩ অক্টোবর বিমান বন্দরে যাবার মুহূর্তে প্রধান বিচারপতি সুপ্রিমকোর্টের প্যাডে নিজের বক্তব্য তুলে ধরেছেন। তাতে লিখিতভাবেই জানিয়েছিলেন যে তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ। তার ওই বক্তব্যে তখন সরকার বেকায়দায় পড়ে গিয়েছিল। প্রধান বিচারপতিকে ছুটিতে যেতে বাধ্য করা হয়েছে বলে বিএনপিসহ বিরোধীরা যে অভিযোগ তুলছিলো এস কে সিনহা যাওয়ার আগের সেইসব বক্তব্যেরই সত্যায়ন করেছেন। অবশ্য পরদিন ১৪ অক্টোবর এস কে সিনহার বক্তব্যের কাউন্টার দেয়া হয়েছে সুপ্রিমকোর্টের রেজিস্র্টার কার্যালয় থেকে।
রেজিস্ট্রার জেনারেল স্বাক্ষরিত সুপ্রিম কোর্টের বিবৃতিতে বলা হয়, প্রধান বিচারপতিকে ছাড়া আপিল বিভাগের অন্য বিচারপতিদের নিয়ে বসেছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। তিনি প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে ১১টি অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য আপিল বিভাগের বিচারপতিদের হাতে দিয়েছেন। দুর্নীতির অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে অন্য বিচারপতিরা প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আদালতে বসতে রাজি নন।
একই দিন (১৪ অক্টোবর) এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘ছুটিতে থাকা প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার আবার ফিরে আসা সুদূরপরাহত’। সাংবাদিকরা জানতে চেয়েছিলেন, ‘প্রধান বিচারপতির ফিরে এসে কার্যভার গ্রহণের সুযোগ আছে কি-না?’ জবাবে মাহবুবে আলম আরও বলেন, ‘এখন যদি অন্যান্য বিচারপতিরা প্রধান বিচারপতির সঙ্গে না বসতে চান, তাহলে সম্পূর্ণ অচলাবস্থার সৃষ্টি হবে। আর এটা সুদূরপরাহত।’
এ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্যের পরদিন অর্থাৎ ১৫ অক্টোবর আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেছেন, ছুটিতে থাকা প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বিরুদ্ধে ওঠা নৈতিক স্খলনসহ ১১টি অভিযোগের অনুসন্ধান করবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এসব অভিযোগের সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত তিনি প্রধান বিচারপতির দায়িত্বে ফিরতে পারছেন না বলে মনে করছি আমি।
আইনমন্ত্রীর বক্তব্যের দুই দিন পর ১৭ অক্টোবর তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেছেন, প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এস কে) সিনহা ছুটি কাটিয়ে দেশে ফিরলে দায়িত্ব নেবেন। এ দিন সচিবালয়ে তথ্য অধিদফতরের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা স্বেচ্ছায় ছুটিতে গেছেন এবং স্বেচ্ছায় ফিরে এসে দায়িত্ব নেবেন’।
তথ্যমন্ত্রী বলেন, সংবিধানের এখতিয়ার অনুযায়ী সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতিরা ভূমিকা রাখছেন। প্রধান বিচারপতি স্বেচ্ছায় ছুটিতে গেছেন, স্বেচ্ছায় ফিরবেন এবং দায়িত্ব নেবেন। এখানে সরকারের কিছু করার নেই, সরকারের কোনো হস্তক্ষেপ নেই, সরকারের কোনো পরামর্শও নেই।
তার আগের দিন ১৬ অক্টোবর দিল্লির ফরেন করেসপন্ডেন্টস ক্লাবে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে দিল্লিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী বলেছেন, ‘চিকিৎসার পর সুস্থ হয়ে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা যখনই দায়িত্ব নেয়ার জন্য প্রস্তুত হবেন, তখনই নিতে পারবেন। এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত। তিনি যদি কাল সকালে আবার দায়িত্ব নিতে চান আমার ধারণা, তাতে কোনো সমস্যা হবে না।’ অথচ এর আগে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম প্রকাশ্যেই বলেছেন, প্রধান বিচারপতি আবার দায়িত্ব নেবেন, সেই সম্ভাবনা ‘সুদূর পরাহত’। আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়েছেন, আপিল বিভাগের বাকি পাঁচজন বিচারপতি যেখানে তার সাথে এক বেঞ্চে বসতে রাজি নন, সেখানে তার দায়িত্বে ফেরার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
আইনমন্ত্রী এবং এটর্নি জেনারেলের এমন বক্তব্যের পর ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমগুলো এ নিয়ে সোচ্চার হয়ে উঠে। ‘সংখ্যালঘু’ প্রধান বিচারপতিকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে সরানো হয়েছে বলে জোর অভিযোগ তোলা হয়। তাই এটা মনে করা হচ্ছিল যে, ভারতের চাপেই অবশেষে দিল্লিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার মোয়াজ্জেম আলী এবং তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু প্রধান বিচারপতিকে পদে বসতে দেয়ার ব্যাপারে প্রায় একই সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে আশ্বস্ত করেন।
মোয়াজ্জেম আলী তার বক্তব্যে বোঝাতে চাইলেন, বাংলাদেশের বিচার বিভাগ প্রধান বিচারপতিকে তার পদ থেকে হটিয়ে দিয়েছে, বিষয়টা আসলে এমন নয়। মোয়াজ্জেম আলী প্রথমে রসিকতা করেন। তিনি বলেন, ‘একজন সিভিল সার্ভেন্ট হিসেবে আমি দুটো জিনিস সব সময় এড়িয়ে চলি। এক, নিজের শ্বশুরবাড়ি নিয়ে কখনো প্রকাশ্যে কথা বলি না। কারণ তাতে আমার বাড়ির দরজা আমার জন্য বন্ধ হয়ে যেতে পারে। দুই, আদালত বা বিচারপতিদের নিয়ে কোনো মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকি। কারণ, কী বলতে কী বলব, আর আদালত অবমাননার দায়ে ছয় মাস কোর্টে চরকির মতো ঘুরতে হবে। এটা আমি ভয় পাই।’
তিনি আরো বলেন, ‘প্রধান বিচারপতি দেশের রাষ্ট্রপতির কাছে লিখিতভাবে ছুটির আবেদন করেছেন। তাতে তিনি বলেছেন, বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন অসুস্থতায় ভুগছেন। আগে থেকেই তিনি ক্যান্সারে ভুগছেন, কাজেই তিনি অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে চিকিৎসা করাতে চান। এ জন্য লম্বা ছুটি প্রয়োজন। স্বভাবতই রাষ্ট্রপতি তা মঞ্জুরও করেছেন। এখন যদি তিনি সুস্থ হয়ে ফিরে আসেন কিংবা পুরোপুরি সুস্থ না হয়েও কাজে যোগ দিতে চান, তবে তিনি আবার কাজে যোগ দেবেন। এই তো ব্যাপার।’
কিন্তু পরবর্তীতে আইন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি আব্দুল মতিন খসরুর বক্তব্যে নতুন সন্দেহের সৃষ্টি হয়। ১৯ অক্টোবর তিনি বলেছেন, “বিচারক যদি কখনও বিতর্কিত হন, দুর্নীতির অভিযোগ থাকে, ওনার সাথে সাথে পদত্যাগ করতে হয়। অন্যান্য বিচারপতিদের কাছে মাননীয় বিচারপতি এস কে সিনহা বলেছেন উনি রিজাইন করবেন। রিজাইন করার পরিবর্তে উনি একটা স্টেটমেন্ট দিয়ে চলে গেলেন … আবার এসে চেয়ারে বসতে চাচ্ছেন। অন্য বিচারপতিরা বলেছেন, আমরা ওনার সাথে আর বসবো না। ওনার আসার আর সুযোগ নাই। আমার মনে হয় এটা সুদূরপরাহত।”
বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে ১১ অভিযোগের কথা বলা হলেও সেগুলো এখনো আনঅফিসিয়ালি। এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো তদন্তও শুরু হয়নি, প্রমাণিত তো নয়ই।
এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও আইনজীবী ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন বলেন, “প্রেসিডেন্ট এটা (অভিযোগ থাকলে) সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে পাঠাতে পারতেন। সেটাতেও সুপ্রিম কোর্টের জাজেরাই থাকতেন। কাউন্সিল হইলেই চিফ জাস্টিস কিন্তু ডিসপিউটেড হয়ে যেতেন। তিনি আর কোর্টে বসতে পারতেন না। এটুকু করলেই তো হয়ে যেতো।”
প্রসঙ্গত, প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার চাকরির মেয়াদ ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত। সুপ্রিম কোর্টের দিনপঞ্জি অনুসারে সরকারি ছুটিসহ ১৬ ডিসেম্বর থেকে সুপ্রিম কোর্টের অবকাশ শুরু হলে তা ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রলম্বিত হবে। ছুটিতে থাকা প্রধান বিচারপতি যদি না ফিরতে চান স্বাভাবিক নিয়মের ধারাবাহিকতায় ছুটি বর্ধিত করতে পারবেন। কিন্তু সে রকমের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। কারণ, তিনি যাওয়ার সময়ই মৌখিক ও লিখিতভাবে জানিয়ে গেছেন, আবার ফিরবেন। পদে বসবেন। বিভিন্ন সূত্র থেকেও এমন তথ্যই পাওয়া যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে এস কে সিনহা আগামী ১০ নভেম্বরের আগেই দেশে ফিরবেন এবং প্রধান বিচারপতির চেয়ারে বসার উদ্যোগ নেবেন। তিনি আবার চেয়ারে বসার পর কী পরিস্থিতি দাঁড়ায় সেটিই এখন সংশ্লিষ্ট সকল মহলের কাছে দেখার এবং কৌতুহলের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সূত্র: শীর্ষনিউজ
Discussion about this post