মুহাম্মদ মিজানুর রহমান
“গণতন্ত্র, জনগণের জন্য, জনগণের দ্বারা গঠিত জনগণের সরকার ” আব্রাহাম লিংকন গেটিসবার্গ এর বক্তৃতায় এই কথাই বলেছিলেন।
প্রকৃতপক্ষে বর্তমানে পৃথিবীতে গণতন্ত্র বা জনগণের শাসন বলে কিছু নেই। ‘গণতন্ত্র’ একটি মুখরোচক শব্দ ছাড়া আর কিছুই নয়। জনগণের নামে গুটিকয়েক ব্যক্তিই রাষ্ট্রের শাসনকার্য পরিচালনা করে জনগণের স্বার্থের পরিবর্তে নিজের ও নিজ ফেমিলির / পরিবারের স্বার্থ রক্ষা করেন তারা। এমন কি এই প্রতিনিধিরা স্বার্থের জন্য এতটাই অন্ধ্য হয়ে পড়েন যে তাদের ক্ষমতার জুলুম অত্যাচার থেকে রেহাই পায়না তাদের নিকট আত্মীয় এবং প্রতিবেশীরাও। ‘গণতন্ত্র’ মানে “ধোঁকাবাজ তন্ত্র” বা “ধোঁকাতন্ত্র” ।
জনগণের অধিকার শুধু ভোট দেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। ভোটের পরে শাসনকার্য পরিচালনায় জনগণের কোনো ভূমিকা থাকে বলে আমি মনে করি না। বর্তমানে ভোটেরও প্রয়োজন হয় না। এখন ভোট ছাড়া সরকার তৈরি হয়। যার জলন্ত উদাহরন ‘বাংলাদেশ’ জাতীয় নির্বাচন ৫ জানুয়ারী ২০১৪। গণতন্ত্র এমন একটি সরকার যেখানে প্রত্যেক সদস্যের অংশগ্রহণ রয়েছে। আর এ অংশগ্রহণ কথাটিও বিতর্কিত।
গণতন্ত্রের মাতৃভূমি ব্রিটেনের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় জনমত কতোটুকু প্রতিফলিত তা লক্ষ করুন। ব্রিটিশ শাসন ব্যবস্থায় সংবিধান অনুযায়ী সংসদকে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী করা হয়েছে। মন্ত্রিসভার মন্ত্রিগণ তাদের রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনায় সংসদের অনুমোদন নিতে বাধ্য। তবে সরকারি কার্যক্রমের যাবতীয় রূপরেখা অঙ্কিত হয় মন্ত্রিসভায়। যেখানে কয়েকজন প্রভাবশালী মন্ত্রীই মূলত সরকারি উন্নয়নমূলক কাজের দিক-নির্দেশনা এবং সরকারি নীতিমালা প্রণয়নে প্রভাব বিস্তার করে থাকেন। অন্য মন্ত্রীদের ভূমিকা সেখানে গৌণ। কেবিনেটে প্রধানমন্ত্রী একমাত্র ভূমিকা পালন না করলেও প্রধান ভূমিকা যে তাঁর এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। তিনি শুধু সরকার প্রধান নন, দলীয় প্রধান এবং পার্লামেন্টেরও নেতা। তাঁর প্রভাব এড়িয়ে সাধারণত কোনো সরকারি সংসদ সদস্য ভিন্নমত পোষণ করেন না বা ভিন্নমত পোষণ করতে সাহসী হন না। একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনায় যাবতীয় ক্ষমতা একজন ব্যক্তির হাতেই ন্যস্ত হচ্ছে। এ পদ্ধতিকে গণতন্ত্র বা জনগণের শাসন না বলে ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতা পরিবর্তনের একটি পদ্ধতি বলাই শ্রেয়। আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে, একে গণতন্ত্র না বলে প্রধানমন্ত্রী বা একক ব্যাক্তি বা রাজতন্ত্র বা পরিবার তন্ত্রের ভিন্ন রূপ দ্বারা পরিচালিত সরকার ব্যবস্থা বলাই অধিকতর যুক্তিযুক্ত। যাকে আমরা সাধারণ ভাষায় গণতন্ত্র বা জনগণের শাসন বলে থাকি। আসলে এটা জনগন বা নাগরিকদের সাথে চরম ধোঁকাবাজি ছাড়া আর কিছু নয়। অথচ আমরা “বাংলাদেশ” কথায় কথায় ব্রিটিশ পার্লামেন্ট এর তুলনা দেই।
“ভোটের মাধ্যমে মতামত প্রকাশের বা সঠিক রায় প্রদানে জনগণ ভুল করলেও সেটা গণতন্ত্র এবং জনগণের শাসন। এখানেই গণতন্ত্র বা গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা অথবা গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার মৌলিকত্ব, বিশেষত্ব, এবং গুরুত্ব। একটি মোটরগাড়ি উন্নতমানের নাও হতে পারে। তাই বলে আমরা গরুর গাড়িকে সমর্থন করতে পারি না। কারণ, একটি অনুন্নত মানের মোটরগাড়ি একটি উন্নত মানের গরুর গাড়ির চেয়ে উৎকৃষ্ট। এই গণতান্ত্রিক যুগে, গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনার অগ্রগতির যুগে, জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র গঠনের প্রতিযোগিতার যুগে আমরা অতীতের রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র এবং সামরিক শাসনের খড়্গতলে বলি হতে পারি না।” গণতন্ত্রের পক্ষে এ রকম যুক্তিবিদ ও তর্ক বাঘিশ আমরা হর হামেসাই দেখে এবং শুনে থাকি।
“হাজার হাজার বছর পূর্বে প্রাচীন গ্রিস এবং রোমের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নগর রাষ্ট্রগুলোতে অতিমাত্রায় ক্ষুদ্র আয়তন এবং স্বল্প জনসংখ্যার কারণে সভা-সমিতির মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে সরাসরি জনগণের মতামত নেওয়া সম্ভব হয়েছিল। এটাকে প্রত্যক্ষ বা বিশুদ্ধ গণতন্ত্র বলা হয়। কালের পরিক্রমায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে প্রাচীন যুগের নগর রাষ্ট্রের বিলুপ্তি ঘটেছে। আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার জনক ম্যাকিয়াভেলি ষোড়শ শতাব্দীতে আধুনিক জাতীয় রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করেন। এ জাতীয় রাষ্ট্রের বিশাল আয়তন এবং বিপুল জনসংখ্যাহেতু প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র সম্ভব নয়। তাই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাই জনগণের কল্যাণে রাষ্ট্রীয় শাসনকার্য পরিচালনা করেন। এ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদেরই জন অভিমত বা জনগণের কণ্ঠস্বর বলে মনে করা হয়। তারা নির্বাচিত হয়ে জনগণের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করবে বলে আশা করা হয়। এটাকে পরোক্ষ বা প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র বলা হয়। এ প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাই আধুনিক গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার ভিত্তি।” বর্তমানে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, দার্শনিক ও রাজনীতিবিদদের এসব পুরোনো খোঁড়া যুক্তির জোরেই নিজেরা পণ্ডিত বনে যান।
‘দেশটি জনগণের’। আমার বিশ্বাসের মূল ভিত্তি দেশটির নাম ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’। নামটি আমাদের সংবিধানে খোদাই করে উল্লেখ করা আছে, যা কোনো অবস্থায়ই পরিবর্তনীয় নয়। সংবিধানের মৌলিক বিষয়াবলির সঙ্গে সংঘাতপূর্ণ কোনো আইন প্রণীত হচ্ছে কি না, তা দেখা সর্বোচ্চ আদালতের দায়িত্ব। আদালতের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা নেই। জাতীয় সংসদ কর্তৃক কোনো আইন প্রণীত হলে আদালত যদি ওই আইন সংবিধানের কোনো মৌলিক ধারার সঙ্গে সংঘাতপূর্ণ বলে প্রমাণ পান, সে ক্ষেত্রে সুস্পষ্টভাবে কোন ধারার সঙ্গে সংঘাতপূর্ণ, তা নির্দিষ্ট করে রায়ের মাধ্যমে প্রণীত আইন বাতিল করতে পারেন সর্বোচ্চ আদালত। আর এজন্যই সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করেছেন সরবোচ্চ আদালত। বুঝতে পারছি না, দেশটি কার! জনগণ যদি দেশের মালিক হন, তাহলে জনগণের প্রতিনিধিদের (ভোট ছাড়াই জোনগণের প্রতিনিধি, কারণ বাংলাদেশে জনগণের প্রতিনিধি হইতে এখন আর ভোট পেয়ে জয়যুক্ত হতে হয় না) ক্ষমতা হরণ করার ক্ষমতা অন্য কোনো সংস্থার থাকে কী করে? আসলে সব ধোঁকাবাজি। সব কলকাঠি এখন বন্দুকের নলের মাধ্যমেই পিছন থেকে নিয়ন্ত্রিত। আর তাই প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা’র ছুটি ও অসুস্থতা এখন প্রকাশ্য দিবালোকে বিতর্কিত।
আর বন্দুকের টিগার তো সে অনেক আগেই হাতে নিয়েছে বিশ্ব মোড়লরা। মোড়লদের আশীর্বাদে মোড়লদের স্বার্থ রক্ষায় আজ গণতন্ত্রের নামে সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক বিনা ভোটের সরকার দ্বারা দেশের নাগরিক দীর্ঘদিন যাবত নির্যাতিত ও নিস্পেশিত। আর একেই যদি গণতন্ত্র বলতে হয় তাহলে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা পরিবর্তন আবশ্যক। বাংলাদেশের বর্তমান সংসদ বিনা ভোটে বন্দুকের নলে পুলিশ বাহিনী দ্বারা নির্বাচিত। এই সংসদ কর্তৃক প্রণীত বহু আইন দ্বারা বিচারকার্য পরিচালিত হচ্ছে। আর বিশ্ব মোড়লরা তা মেনে নিচ্ছে এবং সহযোগিতা করে যাচ্ছে। তাই এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা গণতন্ত্রের সংজ্ঞা পরিবর্তনের।
বিনাভোটের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশ চালাচ্ছেন! সংসদ সদস্যদের জন্য রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে কোটি কোটি টাকা খরচ করছেন! রিজার্ভ চুরির নামে টাকা সরাচ্ছেন! দেশে বিদেশে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার খরচ করে যাচ্ছেন! জনগণের প্রতিনিধি হয়ে! আসলেই কি জনগণ প্রতিনিধি বানিয়েছেন? না বিশ্ব মোড়ল আর একটি বিশেষ রাস্ট্রেকে বিশেষ সুবিধা দিয়ে ক্ষমতা আকরে আছেন। এই যদি হয় গণতন্ত্র তাহলে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা কেন পরিবর্তন নয়?
৩০০ আসনের যদি ৩০০ জনের ১৫৪ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিনা ভোটে নির্বাচিত সংসদ হিসাবে গেজেট ভুক্ত হন আর বাকিরা যদি জেলা প্রশাসক কর্তৃক নাম মাত্র ভোট প্রাপ্তির ঘোষণায় গেজেট ভুক্ত সংসদ সদস্য বনে যান তবে আর দেরী নয়, এখনই সময় গণতন্ত্রের সংজ্ঞা পরিবর্তনের। ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকার প্রবণতাই দেশকে নৈরাজ্যের দিকে ঠেলে দেয়। পরাজয় যেনো রাজনীতিবিদদের সহ্য হয় না।
এথেন্সের খ্যাতনামা রাজনীতিবিদ পেরিক্লিস এর মতেঃ- আমাদের শাসনকে গণতন্ত্র বলে চিহ্নিত করি এজন্য যে, শাসন ব্যবস্থার দায়িত্ব ন্যস্ত রয়েছে বহুজনের উপর, কতিপয় ব্যক্তির উপর নয় (We are called a democracy because the administration is in the hands of the many and not in the few)। অ্যারিস্টটল তাঁর Politeia গ্রন্থের চতুর্থ অংশের ষাট অনুচ্ছেদে বলেন : সাধারণভাবে আমরা বলতে পারি, যে ব্যবস্থায় প্রত্যেকের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়নি তা কুলীনতন্ত্র এবং যেখানে প্রত্যেকের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়েছে তা গণতন্ত্র (We may lay down generally that a system which does not allow every citizen to share is oligarchical and that one which does so is democratic)। এসব সংজ্ঞা ছাড়াও বিভিন্ন লেখক গণতন্ত্রকে চিহ্নিত করেছেন বিভিন্ন রূপে। কেউ বলেছেন গণতন্ত্র সম্মতির সরকার (Government by consent)। কেউবা বলেছেন, গণতন্ত্র জনগণের সার্বভৌমত্ব (sovereignty of the people)। কারও মতে, গণতন্ত্র সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন (rule by the majority)। কেউ আবার গণতন্ত্রকে চিহ্নিত করেছেন সীমিত সরকাররূপে (Limited government)। এসবই গণতন্ত্রের সংক্ষিপ্ত সংজ্ঞা।
এসব সংজ্ঞায় গণতন্ত্রের মর্মবাণী অনুরণিত হয় বটে, কিন্তু গণতন্ত্রের অবয়ব সুস্পষ্ট হয় না। যে কোন একটির বিশ্লেষণে প্রবৃত্ত হলে অন্তর্নিহিত বিভ্রান্তি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ধরা যাক, গণতন্ত্র জনগণের শাসন। প্রকৃতপক্ষে জনগণ কোথাও শাসন করেনি এবং করে না। জনগণের শাসন করার ক্ষমতাও নেই। পেরিক্লিস জনগণের শাসন সম্পর্কে আবেগজড়িত কণ্ঠে বিবৃতি দিলেও তিনি জানতেন, জনগণ বলতে যা বোঝায় তারা কোনো সময়ে শাসনকাজের সাথে জড়িত ছিলেন না।
গণতন্ত্রের জনক এরিষ্টটল। এরিষ্টটল Politics গ্রন্থে রাষ্ট্র ও সংবিধান বলতে এক জিনিস বুঝিয়েছেন। সংবিধান হচ্ছে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতা সমূহের বিন্যাস ব্যবস্থা। সংস্থা মাত্রই লক্ষ সেখানে কোন উত্তম সাধন করা, সেখানে সে সংস্থা সকল সংস্থার সেরা এবং অপর সকল সংস্থা সে সংস্থার অন্তর্গত, সে সংস্থার লক্ষ হচ্ছে চরম উত্তমের সাধন এবং এরুপ সংস্থাকে আমরা রাষ্ট্র বলে অভিহিত করি।
রাষ্ট্র ও দলের অভিন্নতা বর্তমানে সমর্থন করা যায় না। কারন দল চাইলেই সংবিধান পরিবর্তন করতে পারে না। বর্তমানে কল্যানমূলক রাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয় কার্য পরিচালনার জন্য সকল দল ও গোষ্ঠীর সমর্থন আবশ্যক। একজনের শাসন যেমন রাজতন্ত্র / স্বৈরতন্ত্র। কতিপয়ের শাসন তেমন অভিজাততন্ত্র / ধনিকতন্ত্র। নাগরিক সাধারনের শাসন হল পলিটি / গণতন্ত্র। পলিটি / গণতন্ত্র হচ্ছে ধনিকতন্ত্র এবং গণতন্ত্রের একটি মিশ্রিত রুপ।
এরিষ্টটল এর মতে রাষ্ট্রে অবশ্যই আদর্শগত সদগুন দ্বারা শাসিত হবে এবং শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিরাই শাসন পরিচালনা করবেন। শাসক যদি সদগুনের অধিকারী হয় তাহলে সে গণতন্ত্র হবে রাজনৈতিক অন্যথায় তা হবে অভিজাত তান্ত্রিক। আধুনিক গণতন্ত্রের জনক জন লক। শাসকের প্রতি আনুগত্য নির্ধারিত হবে শাসিতের সম্মতি দ্বারা। লক যুক্তি দিলেন অধিকার একটি স্বাভাবিক প্রত্যয়। প্রত্যেক মানুষের স্বাভাবিক নিয়মে অধিকার থাকতে হবে। সরকারের ক্ষমতায় থাকার যৌক্তিকতা ততক্ষণই থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত সরকার জনগণের অধিকার রক্ষা করতে পারবে। এছাড়াও অনেকের মতে গ্রীক নাগরিক সোলন যাকে আমরা প্লেটো নামে চিনি, আধুনিক গণতন্ত্রের প্রণেতা। সোলোনের আগেও বিভিন্ন সমাজ ব্যবস্থায় গণতন্ত্রের প্রাথমিক ধারণা দেখতে পাওয়া যায়। “গণতন্ত্র” শব্দটি গ্রীক শব্দ (ডিমক্র্যাসি) এর অনুবাদ। পরিভাষায় গণতন্ত্র বলা হয় জনসাধারণের প্রতিনিধি দ্বারা সাম্যের নীতি অনুসারে রাষ্ট্রশাসন করা। গণতান্ত্রিক সরকার বলা হয় কোন শ্রেণি, গোষ্ঠী বা ব্যক্তি বিশেষ কর্তৃক শাসনের পরিবর্তে রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের নিয়ন্ত্রণাধীনে পরিচালিত সরকারকে।
প্রচলিত গণতন্ত্রে রাষ্ট্র প্রধান নির্বাচনের পদ্ধতি মাত্র একটাই। আর তা হল সাধারণ নির্বাচন। রাষ্ট্রের ছোট বড়, যোগ্য-অযোগ্য, বুদ্ধিমান-নির্বোধ নির্বিশেষে সকলের রায় বা মতামত সমানভাবে মূল্যায়িত হবার কথা। পক্ষান্তরে ইসলামী খেলাফত পদ্ধতিতে রাষ্ট্র প্রধান নির্বাচনের পদ্ধতি বহুবিধ। কিন্তু হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (নবি ও রাসূল) সল্লিল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম এবং খোলাফায়ে রাশেদীন ও আদর্শ যুগের কর্মপন্থা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ইসলাম মতামত গ্রহণের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যথাযথ কর্তৃত্বসম্পন্ন যোগ্য কর্তৃপক্ষে মতামতের মূল্যায়ন করে থাকে। পবিত্র ও সর্ব জন স্বীকৃত কুরানুল কারিমে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, “যদি তুমি পৃথিবীর অধিকাংশ লোকের কথামত চল, তবে তারা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করে দেবে।” (সূরা আনআম : ১১৬) প্রচলিত গণতন্ত্রে জনগণকে সকল ক্ষমতার উৎস বলে ব্যখ্যা দেওয়া হয়। আসলেই কি জনগণ সকল ক্ষমতার উৎস? যদি সকল ক্ষমতার উৎস জনগণ হয় তবে বিনা ভোটের সরকার কিকরে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকে? জনগণকে আইনের উৎস মানা ইসলাম ধর্মের বিশ্বাসীদের কাছে ঈমান পরিপন্থী। কেননা ইসলামী আকীদা বিশ্বাসে আল্লাহকেই সর্বময় ক্ষমতার উৎস স্বীকার করা হয়। কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, “তুমি বল সমস্ত কিছুর কর্তৃত্ব কার হাতে?” (সূরা মুমিনূন : ৮৮) অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, “তুমি বল হে সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক আল্লাহ্! তুমি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা প্রদান কর এবং যার নিকট থেকে ইচ্ছা ক্ষমতা কেড়ে নাও।” (সূরা আল ইমরান : ২৬) প্রচলিত গণতন্ত্রে জনগণকেই সকল ক্ষমতার উৎস এবং জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত প্রতিনিধিদেরকে আইন বা বিধানের অথরিটি বলে স্বীকার করা হয়। অথচ বিধান দেওয়ার অধিকার একমাত্র আল্লাহর। তাই প্রচলিত গণতন্ত্রের ধারণা ঈমান-আকীদার পরিপন্থী। অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, “কর্তৃত্বতো আল্লাহরই।” (সূরা আনআম : ৫৭) আরো বলা হয়েছে, “আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তদানুসারে যারা বিধান দেয় না তারা কাফের।” (সূরা মায়িদা : ৪৪) আরো বলা হয়েছে, “তুমি তাদেরকে দেখনি যারা দাবি করে যে, তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে এবং তোমার পূর্বে যা অবতীর্ণ হয়েছে তাতে তারা ঈমান এনেছে, অথচ তারা তাগুতের কাছে বিচারপ্রার্থী হতে চায়, যদিও তাদেরকে তা প্রত্যাখ্যান করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।” (সূরা নিসা : ৬০)
তন্ত্র-মন্ত্র এর ভিত্তিতে পরিচালিত রাষ্ট্র ব্যবস্থা কখনো দেশের নাগরিক গনের কল্যান বয়ে আনেনা। বরং তন্ত্র-মন্ত্র ব্যাবস্থা সামগ্রিক অকল্যাণ ও গুম, হত্যা ও পুলিশি ক্ষমতার বাস্তবায়ন ঘটে। যার পেছেনে কলকাঠি নাড়ে একটি বিশেষ সর্ব উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন কোন বাহিনী ও রাস্ট্র। যার বাস্তব উধারন এখন বাংলাদেশ। যেখানে সর্ব উচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতিরও অধিকার হরণ করা হয় ক্ষমতায় টিকে থাকবার জন্য।
ইসলামের ভিত্তিতে গণতন্ত্র পদ্ধতিতে রাষ্ট্র পরিচালনা মানে হল-মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে রাষ্ট্র পরিচালনা করা। আর খেলাফতের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনা মানে হল আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে রাষ্ট্র পরিচালনা করা। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা মানে হল মানুষের সৃষ্ট মতবাদ প্রতিষ্ঠা। আর খেলাফত প্রতিষ্ঠা মানে হল আল্লাহর নির্ধারিত মতবাদ প্রতিষ্ঠা। গণতন্ত্রের মূল থিউরী হল মানুষকে সন্তুষ্ট করা যেভাবেই হোক। আর ইসলামী খিলাফতের মূল উদ্দেশ্য হল আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে জনসেবা করা আল্লাহর নির্ধারিত বিধান অনুপাতে।
গণতন্ত্রের সুবিধাসমূহঃ
১. সহিংসতা ছাড়া ক্ষমতার পরিবর্তন।
২. সংখ্যাগরিষ্ট জনগনের আশা আকাংখার প্রতিফলন।
৩. সরকার জনগণের মন রক্ষা ও বিরোধীদলের সমালোচনার জন্য সর্বাত্মক উন্নয়ন করে।
৪. জনগণ মত প্রকাশের সুযোগ পায়।
গণতন্ত্রের অসুবিধাসমূহঃ
১. দেশের সকল মানুষ সচেতন না থাকলে ভুল মানুষ নেতা হয়।
২. দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করা সম্ভব হয়না।
৩. নির্বাচনে কারচুপি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
৪. সংখ্যালঘুদের স্বার্থ রক্ষা হয়না।
৫. বিরোধীদলের বিরোধিতার কারণে কাজ বাস্তবায়নে প্রচুর সময় ব্যয় হয়।
৬. ভোটাধিকার নির্ধারণের মাপকাঠি বয়স হলে অনেক সময় মূর্খরা অপাত্রে ভোট দেয়।
৭. দলীয় প্রভাবের কারণে খারাপ মানুষ নির্বাচিত হয়।
এত কিছু বিচার বিশ্লেষণের পরে বর্তমান বিশ্বের শাসন ব্যবস্থা ও ক্ষমতা গ্রহন ও পরিবর্তন ও ক্ষমতায় আসীন থাকার ভিত্তি মূলে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা বর্তমানে নিন্ম রূপ হওয়াই বাঞ্চনিয় বলে আমি মনে করি।
আমার মতে গণতন্ত্রের সংজ্ঞাঃ-
আমার নিজের জন্য, জনগণের দ্বারা ধোঁকাবাজির মাধ্যমে গঠিত , আমার নিজের জন্য আমিই সরকার। অথবা আমি ও আমার পরিবারের জন্য, জনগণের দ্বারা ধোঁকাবাজির মাধ্যমে গঠিত , জনগণ থেকে দূরে থাকা আমিই সরকার। আরো গুছিয়ে বলতে গেলে এভাবে বলা জেতে পারে, গণতন্ত্র বলতে আমরা যা বুঝেছি আর যা দেখেছি তা এই রূপ যে “শুক্ষ কারচুপির মাধ্যমে আমলাদের দ্বারা নির্বাচিত, পুলিশি ব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রিত, গুম, খুন, জুলুমবাজ ও লুটপাটের সরকার।”
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা এবং সভাপতি, বাংলাদেশ নাগরিক শক্তি
[অতিথি কলামে প্রকাশিত মতামত একান্তই লেখকের নিজস্ব। লেখকের কোনো মতামতের দায়ভার অ্যানালাইসিস বিডি কর্তৃপক্ষ নিবে না]
Discussion about this post