মাদ্রাসা সুপারকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগে পুলিশের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা তুলে না নেয়ায় বাদীর বাড়িতে আবারো হামলা চালানো হয়েছে।
বৃহস্পতিবার ভোর সাড়ে ৩টার দিকে সাতক্ষীরা সদর উপজেলার কাথন্ডা গ্রামে হামলার ঘটনা ঘটে।
এদিকে শুক্রবারও মামলার বাদী, স্বাক্ষী ও স্বজনেরা কেউ তাদের বাড়িতে যেতে পারেননি। বাড়িতে গেলে স্থানীয় সরকার দলীয় সন্ত্রাসী ও আসামিরা ফের হামলা করতে পারে এমন আশঙ্কায়।
ক্ষতিগ্রস্তরা জানায়, বৃহস্পতিবার হামলার সময় আসামি পক্ষ বাদীর বেয়াইয়ের বাড়িতেও হামলা চালিয়েছে। এ সময় তারা ওই বাড়ির জানালা ভেঙে তার বেয়াইনকে মারপিট করে এবং ছেলের শ্যালক আল মামুনকে ধরে নিয়ে গেছে।
তাকে ছেড়ে দেয়ার জন্য এক লাখ টাকা দাবি করা হয়। টাকা না দিতে পারায় মামুনসহ তিনজনকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। পরে তাদেরকে বিভিন্ন মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। গ্রেফতারকৃতরা হলেন আল মামুন, সিদ্দিকুর রহমান ও মাওলা বক্স।
কাথন্ডা গ্রামের আব্দুল হান্নান বিশ্বাসের স্ত্রী মোসলেমা খাতুন (৬০) জানান, তার মেয়ে ফাহিমা সুলতানার সঙ্গে একই গ্রামের বজলুর রহমানের ছেলে রাকিবুজ্জামানের ৬ বছর আগে বিয়ে হয়।
তিনি জানান, বেয়াই বজলুর রহমান তার ভাই বাকসা হঠাৎগঞ্জ দাখিল মাদ্রাসার সুপার সাঈদুর রহমানকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগে গত ১৯ সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরা সদর থানার চার পুলিশ কর্মকর্তাসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে সাতক্ষীরা আদালতে মামলা দায়ের করেন। ২০ সেপ্টেম্বর অসলে চেয়ারম্যান ও মজনু চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে পুলিশের পক্ষে শহরের আলাউদ্দিন চত্বরে মানববন্ধন করা হয়।
এরপর মামলা তুলে নেয়ার জন্য ২১ সেপ্টেম্বর ভোর তিনটার দিকে বজলুর রহমানের বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর, মারপিট ও লুটপাট করে সাদা পোশাকের পুলিশ ও অসলে চেয়ারম্যানের লোকজন। এ সময় বেয়াইন মঞ্জুয়ারার বুকে বন্দুক ঠেকিয়ে স্বামী বজলুর রহমানের খবর জানতে চাওয়া হয়। মারপিট করা হয় জামাতা রাকিবুজ্জামানকেও। ২৪ সেপ্টেম্বরের মধ্যে মামলা তুলে না নিলে ফল ভালো হবে না বলেও তারা হুশিয়ারি দিয়ে যায়।
তিনি আরো জানান, বেয়াই বজলুর রহমানকে না পেয়ে সদর থানার উপপরিদর্শক বোরহানউদ্দিনের নেতৃত্বে পুলিশ ও অসলে চেয়ারম্যানের ২৫/৩০জন ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসী বৃহস্পতিবার ভোর ৩টার দিকে তাদের বাড়িতে ফের হামলা চালায়। এ সময় গ্রাম পুলিশ তরিকুল ইসলাম ও রেজাউল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন। ছেলে আল মামুন খোকনকে তাদের হাতে তুলে দিতে বলা হয়। কিন্তু গেট খুলে না দেয়ায় ও খোকনের বিরুদ্ধে কোনও গ্রেফতারি পরোয়ানা আছে কিনা জানতে চাওয়া হয়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে মেয়ে ও বৌমাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে পুলিশ।
একপর্যায়ে পুলিশ সিঁড়ির দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে আল আমিন খোকনকে ঘর থেকে টেনে বের করে। বাবাকে ছেড়ে দেয়ার জন্য পুলিশের পায়ে ধরলে ছেলে কাথন্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র সবুজ হোসেনের বুকে লাথি মারা হয়। তার নিজের (মোসলেমা) ডান হাঁটুতে কাঠের লাঠি দিয়ে পিটিয়েও জখম করা হয়।
মোসলেমা বলেন, একপর্যায়ে এক লাখ টাকা দিলে খোকনকে ছেড়ে দেয়া হবে বলে জানায় পুলিশ। কিন্তু টাকা দিতে না পারায় ছেলেকে নিয়ে যায় তারা।
কাথন্ডা গ্রামের রাকিবুজ্জামান জানান, শ্যালক আল মামুনকে ধরে নিয়ে এসে বৃহস্পতিবার ভোর সাড়ে তিনটার দিকে পুলিশ ও অসলে চেয়ারম্যানের ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসীরা তাদের ও প্রতিবেশী প্রয়াত নজরুল মাস্টারের বাড়িতে হামলা চালায়। এ সময় তারা বাড়ির ফটকে লাথি মারে। বৃহস্পতিবার সকাল ১০টার মধ্যে তাদেরকে ভারতে চলে যাওয়ার কথা বলা হয়। নইলে মাদ্রাসা সুপার সাঈদুর রহমানের কবরে সকলকে একসাথে পুঁতে দেয়া হবে বলে হুশিয়ারি দেয়া হয়। এ ছাড়া আল মামুনের মতো অনেককেই জেলে পঁচতে হবে বলে অকথ্য ভাষায় গালি-গালাজ করা হয়।
বজলুর রহমান অভিযোগ করে বলেন, ভাইয়ের হত্যার ঘটনায় পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করায় তার বাড়িতে দ্বিতীয় দফায় ও বেয়াইয়ের বাড়িতে হামলা চালানো হয়েছে। যেকোনো মূল্যে মামলা তুলে নিতে বাধ্য করাতে বৃহস্পতিবার ভোরে আল মামুনকে আটক করা হয়েছে। বিষয়টি পুলিশ ইনভেসটিগেশান ব্যুরো খুলনার পুলিশ সুপারকে অবহিত করা হয়েছে।
সরেজমিনে বৃহস্পতিবার সকালে কাথন্ডা গ্রামে গেলে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি সংসদের সাতক্ষীরা জেলা শাখার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মহসীন কবীরসহ কয়েকজন জানান, পুলিশ ও সন্ত্রাসীরা যৌথভাবে আব্দুল হান্নান বিশ্বাসের সিঁড়ির পাশের দরজা ভেঙে তার ছেলে আল মামুনকে ধরে নিয়ে গেছে। একই সাথে পুলিশ তাদের গ্রামের ছিদ্দিক সানা ও মোশাররফ হোসেনকে ধরে নিয়ে যায়।
গ্রাম পুলিশ তরিকুল ইসলাম ও রেজাউল ইসলাম জানান, পুলিশ তাদেরকে আব্দুল হান্নান বিশ্বাসের বাড়ি চিনিয়ে দিতে বলেছিল।
সাতক্ষীরা সদর থানার উপপরিদর্শক বোরহানউদ্দিন জানান, তিনি আল মামুনকে ধরে এনেছেন ঠিকই। এর বাইরে কিছু জানতে হলে থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে জানতে হবে।
সাতক্ষীরা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মারুফ আহম্মেদ জানান, পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা তুলে নেয়ার জন্য হামলা, ভাঙচুর ও মারপিটের অভিযোগ ঠিক নয়।
টাকা চাওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, আল মামুনের বিরুদ্ধে মাদকের মামলা রয়েছে।
পুলিশ ব্যুরো ইনভেসটিগেশনের খুলনা শাখার পরিদর্শক গোলাম রসুল জানান, বিষয়টি লিখিত আকারে পুলিশের ঊর্ধ্বতন মহলে অবহিত করার জন্য বজলুর রহমানকে পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
প্রসঙ্গত, গত ১৯ সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরায় পুলিশের নির্যাতনে আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসধীন অবস্থায় মাদরাসা সুপারের মৃত্যুর ঘটনায় দুইজন এসআইসহ পুলিশের ছয়জনের বিরুদ্ধে আদালতে হত্যা মামলা করেন নিহতের ভাই।
নিহতের বড় ভাই মো: বজলুর রহমান বাদী হয়ে ২০ সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরা আমলি আদালত (১) এ এই মামলা করেন। আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে তদন্ত পূর্বক ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দেয়ার জন্য পিবিআইকে নির্দেশ দিয়েছেন।
মামলার আসামিরা হলেন- সাতক্ষীরা সদর থানার এসআই আসাদুজ্জামান, এসআই পাইক দেলওয়ার হোসেন, এএসআই শেখ সুমন হাসান এবং এএসআই আশরাফুজ্জামান। অপর দুজন অজ্ঞাত কনস্টেবল।
সূত্র: শীর্ষনিউজ
Discussion about this post