ড. আবদুল লতিফ মাসুম
মারাত্মক সাংবিধানিক সঙ্কটে ধাবিত দেশ- এ রকম আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন বিদ্বজ্জনেরা। আশা ছিল, শুভবুদ্ধির উদয় হবে। সঙ্কটের সফল সমাপ্তি ঘটবে। শাসক দলের নরম-গরম বক্তৃতা এবং পর্দার অন্তরালে আপসরফার প্রয়াস দেখে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা ছিল সাংবিধানিক পথেই অগ্রসর হবে উভয়পক্ষ। কিন্তু আকস্মিকভাবেই প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার একটি মন্তব্য সর্বোচ্চ কর্তৃত্বকে বেসামাল করে তোলে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ব্যক্তি ও গণমাধ্যম বিষয়টিকে উসকানিমূলকভাবে পরিবেশন করে। উদাহরণস্বরূপ সস্তায় বিক্রীত একটি দৈনিকে শিরোনামটা ছিল এরকম ‘পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে অপসারণের কথা অ্যাটর্নি জেনারেলকে স্মরণ করিয়ে দিলেন এস কে সিনহা’।
অথচ বক্তব্যটি এমন ছিল না। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম যখন বলেন, চার দিকে ঝড় উঠেছে তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, ঝড় তো আপনারাই তুলেছেন। পাকিস্তানে রায়ের পরে তো কোনো ঝড় ওঠেনি। এ বক্তব্যকে বিকৃত করে যখন পরিবেশিত হয়, তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।
তার বক্তব্যের সারাংশ এ রকম : ক. ‘সব সহ্য করা যায়, কিন্তু পাকিস্তানের সাথে তুলনা করলে এটা আমরা কিছুতেই সহ্য করতে পারব না। পাকিস্তানে রায় দিলো দেখে কেউ ধমক দিবে- জনগণের কাছে এর বিচার চাই, … আজকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর সাথে কেন তুলনা করবে? খ. অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করতে দেয়া হবে না। যদি কেউ সে অপচেষ্টা চালায়, তাকে সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। গ. সব বিচারপতির স্বাধীন মতামত দেয়া নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার রায়ে সব বিচারপতি স্বাধীনভাবে মতামত দিতে পেরেছেন কি না, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সেই সুযোগটা বোধ হয় প্রধান বিচারপতি দেননি’।
প্রধানমন্ত্রী প্রধান বিচারপতির নিয়োগ, জাতীয় সংসদ, অবৈধ ক্ষমতা দখল, নারীর ক্ষমতায়ন ইত্যাদি বিষয়ে বক্তব্য দেন। এসব উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী মন্তব্য করেন, ‘এ কথাগুলো বলার আগে ওই পদ থেকে তার সরে যাওয়া উচিত ছিল’। সংসদের বৈধতা ও অবৈধতা প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘নির্বাচনী আইনে আছে, অন্য কোনো প্রার্থী না থাকলে নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়। কোনো দল নির্বাচনে অংশ না নিলে যিনি এভাবে নির্বাচিত হয়ে আসেন সেটা তো তার দোষ না। সে জন্য সংসদের বৈধতা ও অবৈধতার প্রশ্ন আসতে পারে না’।
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করলে এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, তিনি প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার ওপর মহা ক্ষিপ্ত হয়েছেন। কয়েক দিন আগে প্রধানমন্ত্রীর ভাষায় নিয়মতান্ত্রিকতার যে খানিকটা সুর ধ্বনিত হচ্ছিল, তার তীব্র বাক্যবাণে তা নস্যাৎ হয়ে গেল। তিনি প্রকারান্তরে প্রধান বিচারপতিকে পদত্যাগের আহ্বান জানিয়েছেন। পরবর্তীকালে তার এই আহ্বানকে কার্যকর করার জন্য যে অপকৌশল আওয়ামী লীগ নিয়েছে, তা যেকোনো আইনকানুন, রীতি-রেওয়াজ, ভদ্রতা-সভ্যতা, শিক্ষা-সংস্কৃতির বিরোধী।
আওয়ামী লীগের নেতা, পাতি নেতা, হাইব্রিড নেতা সবাই তারস্বরে চিৎকার করছেন প্রধান বিচারপতির পদত্যাগ চেয়ে। আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ ২৩ আগস্ট হাইকোর্টের সামনে মানববন্ধন করে প্রধান বিচারপতির পদত্যাগ দাবি করে এবং এ জন্য পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেয়। আওয়ামী লীগের নেতারা এমন কোনো কুৎসিত মন্তব্য বাকি রাখেননি, যা তারা সুরেন্দ্র কুমার সিনহার প্রতি আরোপ করেননি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মুক্তিযুদ্ধমন্ত্রী তাকে ‘মানসিক ভারসাম্যহীন’ উল্লেখ করেছেন। অপর দিকে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি বলেছেন, ‘যারা বঙ্গবন্ধুর একক নেতৃত্ব নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন তাদের রক্ত পরীক্ষা করা উচিত। এই স্বাধীনতাবিরোধী চক্র বাংলাদেশে বসবাস করলেও অন্তরে তাদের পাকিস্তান’। যেকোনো ব্যক্তি যখন কোনো না কোনোভাবে আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করে অথবা তাদের স্বার্থের প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়, তখন তারা সেই ব্যক্তিকে স্বাধীনতার চেতনাবিরোধী বলে চিহ্নিত করে। এ ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। তবে ভাগ্যবান সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। তিনি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোক। আর তা না হলে ইতোমধ্যে রাজাকার খেতাব পাকাপোক্ত হয়ে যেত। তারা সিনহাকে শান্তি কমিটির লোক বলেও প্রচার করেছে। কিন্তু, নাগরিকসাধারণ যা বোঝার তা-ই বুঝেছেন।
সবচেয়ে মৌলিক আইনগত এবং সাংবিধানিক প্রশ্ন, সরকার পক্ষ কি এটা পারেন? আইন যদি সবার জন্য সমান হয়, হাকিম নড়ে তো হুকুম নড়ে না- এ কথা যদি সত্যি হয়, তাহলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ কি এ রকম বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে পারে? এখন একজন ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি রায় ফেরানোর জন্য কি দেনদরবার করতে পারে? সে যদি তা না পারে তাহলে সরকার, সংসদ ও দল কেউই তা পারে না। তাকে অবশ্যই আইনি প্রক্রিয়ায়ই অগ্রসর হতে হবে। স্বাভাবিক ছিল ষোড়শ সংশোধনীর রায়ের পর্যালোচনা চেয়ে আবেদন করা- সরকার তা বলেছিল। কিন্তু তা না করে তারা অবৈধ, অন্যায় ও অনিয়মতান্ত্রিক পথে পা বাড়িয়েছেন। ২০১৪ সালে বিচারকদের অভিশংসনের ক্ষমতা যখন জাতীয় সংসদ নিজ হাতে তুলে নেয়, তখন সাধারণ নাগরিকেরা বিচলিত ছিল এই ভেবে যে, নাগরিক অধিকারের শেষ আলোটুকু অর্থাৎ উচ্চ আদালতের কাছে আবেদন করার শেষ সুযোগটুকুও বুঝি থাকছে না। স্মরণ করা যেতে পারে, তত দিনে ক্ষমতাসীনেরা আইনসভা বেআইনিভাবে দখল করেছে। প্রশাসনকে দলের অংশে পরিণত করেছে।
‘আইন ও শৃঙ্খলাবাহিনীর গোপালীকরণ’ করেছে। মানুষের দাঁড়ানোর আর কোনো জায়গা নেই। অবশেষে ট্যানেলের শেষে আলোর রেখা দেখা গেল। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের সূত্রে অনেক আশা করে তারা বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একজন সংখ্যালঘু ব্যক্তিত্বকে প্রধান বিচারপতি পদে অধিষ্ঠিত করেন। অনেকে তখন বিষয়টিকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করেনি। কিন্তু, তারা এখন দেখতে পাচ্ছেন যে একজন আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি কিভাবে শক্তিমত্ততার সাথে লড়াই করে চলছেন। নাগরিকসাধারণ শঙ্কিত। তারা কখন কী করে বসে!
সরকারি দলের এই অবস্থানের বিপরীত হচ্ছে বিরোধী দলের অবস্থান। এত দিন ধরে নিপীড়ন, নির্যাতন ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে অক্ষমতা বিরোধী দলকে নিঃশেষ করে ফেলছিল। ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে তাদের বিরুদ্ধে অনেক স্পর্শকাতর মন্তব্য আছে। তবুও হয়তো ‘শেষ ভালো’ হিসেবে তারা রায়টি গ্রহণ করেছে। ষোড়শ সংশোধনীর রায় এবং পর্যালোচনা অবশেষে বিরোধী দল যুক্তি উত্থাপন করেছে- প্রথমত, এ রায়ের মাধ্যমে সরকার শাসন করার নৈতিক অধিকার হারিয়েছে। দ্বিতীয়ত, সংসদ অকার্যকর এ মন্তব্যের ধারাবাহিকতায় সংসদের কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। তৃতীয়ত, সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং দলীয়করণের মাধ্যমে যেভাবে ‘সুশাসনের অভাব’ দৃশ্যমান হয়েছে তাতে শাসক দলের অযোগ্যতা প্রমাণ করেছে।
চতুর্থত, নির্বাচনব্যবস্থাকে বিশেষ করে ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে যেভাবে ‘প্রতিনিধিত্বহীন’ করা হয়েছে তাতে সংসদীয় গণতন্ত্রের অকার্যকারিতা এবং অপরিপক্বতা প্রমাণ হয়েছে। পঞ্চমত, বিগত বছরগুলোতে অনানুষ্ঠানিক যে জনমত দেখা গেছে, তাতে মানুষ তেতিয়ে উঠেছে। ‘বারুদের গন্ধ চারিদিকে’। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের ভাষায় ‘ঝড় উঠেছে’।
সুতরাং বিরোধীদের দাবি, সরকারের পদত্যাগ করা উচিত। শুধু প্রধান বিরোধী দল নয়, সব বিরোধী দল সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। বামমোর্চা সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করে যে, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী রায় নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতারা, তাদের সমর্থিত আইনজীবী, মন্ত্রী, এমপিরা যেভাবে এই রায়ের পর্যবেক্ষণ উচ্চ আদালত, এমনকি প্রধান বিচারপতিকে ধারাবাহিকভাবে আক্রমণ করে বক্তব্য দিচ্ছেন, যা উচ্চ আদালতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার শামিল। তাদের বক্তব্য-বিবৃতি শিষ্টাচারের সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে সম্মানিত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সাবেক প্রেসিডেন্ট বি. চৌধুরী, ড. কামাল হোসেন, মাহমুদুর রহমান মান্না প্রমুখ নেতৃবৃন্দ সরকারের অবস্থানের তীব্র সমালোচনা করেছেন। বিচার বিভাগ নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করায় পেশাজীবী তথা সিভিল সোসাইটি সরকারের সমালোচনায় মুখর হয়েছে। আইনজীবীদের শীর্ষ সংগঠনগুলো এবং অন্যান্য পেশাজীবী সম্প্রদায় সরকারের শক্তি প্রয়োগের সমালোচনা করেছে। সুশাসনের জন্য নাগরিক- সুজন মনে করে, বর্তমান সংসদ বহাল রেখে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। ষোড়শ সংশোধনী রায়ের ধারাবাহিকতায় এসব প্রস্তাবনা উপস্থাপন হয়। অর্থাৎ সর্বাত্মকভাবে সরকারের পদত্যাগ অথবা সংসদ ভেঙে দেয়া অথবা মধ্যবর্তী নির্বাচন নিয়ে সর্বত্র জল্পনা-কল্পনা ও আলোচনা ঘুরপাক খাচ্ছে।
পদত্যাগ আন্দোলনের প্রতিযোগিতা যখন শুরু হয়েছে, তখন কাউকে না কাউকে হয়তো পদত্যাগ করতে হতে পারে। ক্ষমতাসীন সরকারের জন্য যেহেতু এটি একটি মানসম্মানের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, তারা হয়তো চাইবে ‘ছলে, বলে, কলে, কৌশলে’ এস কে সিনহাকে পদত্যাগে বাধ্য করতে। এমনকি তারা অসাংবিধানিক পথও বেছে নিতে পারে। সংবিধানে এবং বর্তমান বাস্তবতায় তাকে অপসারণের কোনো অবকাশ নেই। এতদসত্ত্বেও সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক সরকারকে অপসারণের কুবুদ্ধি বাতলিয়েছেন। প্রধান বিচারপতিকে সামরিক সরকারের মতো বঙ্গভবনে আমন্ত্রণ জানিয়ে পদত্যাগের আহ্বান হয়তো সম্ভব হবে না। গণমাধ্যম জগতে স্ব-আরোপিত অথবা সরকার আরোপিত সেন্সর কাজ করছে কি না, জানি না।
তবে ইতোমধ্যে ফেসবুকে প্রধান বিচারপতি সিনহার পোস্ট থেকে জানা গেছে, তিনি ‘শির দেগা নেহি দেগা আমামা’। তিনি অন্যায়ের কাছে মাথা নত করবেন না। জেদাজেদি কারোর জন্যই ভালো নয়। বিশেষ করে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সাংবিধানিক সঙ্কটের ফলে কোনো ‘রাজনৈতিক দুর্যোগ’ নেমে আসুক নাগরিকসাধারণ তা কামনা করে না। এত কিছু সত্ত্বেও সমস্যাটির রাজনৈতিক সমাধানের পথে সংশ্লিষ্ট সবাই অগ্রসর হবেন- এই প্রত্যাশা সবার। ‘শুভস্য শীঘ্রম’।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
সূত্র: নয়াদিগন্ত
Discussion about this post