পাকিস্তানের ৭০ বছরের ইতিহাসে কোনো প্রধানমন্ত্রীই যা পারেননি, নওয়াজ শরিফও তা পারলেন না। পূর্বসূরিদের মতোই পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই প্রধানমন্ত্রী পদ ছাড়তে হলো তাঁকে।
নিজের ও পরিবারের সদস্যদের বিপুল পরিমাণ সম্পদের উৎস জানাতে ব্যর্থ হওয়ায় আজ শুক্রবার প্রধানমন্ত্রী পদে নওয়াজকে অযোগ্য ঘোষণা করেন দেশটির সুপ্রিম কোর্ট। এর কিছুক্ষণ পরই পদত্যাগের ঘোষণা দেন নওয়াজ।
মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়ার এই অভিজ্ঞতা অবশ্য নওয়াজের নতুন নয়। ১৯৯০ সালে প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর ১৯৯৩ সালে মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেই দুর্নীতির কারণে প্রধানমন্ত্রিত্ব চলে যায় নওয়াজের। দ্বিতীয়বার ১৯৯৭ সালে প্রধানমন্ত্রী হয়ে ১৯৯৯ সালে সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারান তিনি। তবে ২০১৩ সালের জুনে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর এবারই সবচেয়ে বেশি সময় ক্ষমতায় থাকলেন নওয়াজ। আগামী বছর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার কথা ছিল।
এখন পর্যন্ত সামরিক অভ্যুত্থানের কারণে ক্ষমতা হারাতে হয়েছে পাকিস্তানের চারজন প্রধানমন্ত্রীকে। আর ক্ষমতায় থাকতেই খুন হতে হয় একজনকে। আরেকজনকে সামরিক আদালতের রায়ে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলতে হয়। বেশ কয়েকজনকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে।
পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান। দেশটির প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট দায়িত্ব নেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেই ১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর রাওয়ালপিন্ডিতে খুন হন তিনি।
প্রথম প্রধানমন্ত্রী খুন হওয়ার পর দেশটির প্রধানমন্ত্রী হন খাজা নাজিমুদ্দিন। ১৯৫১ সালের ১৭ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি শপথ নেন। দুই বছর না হতেই ১৯৫৩ সালের ১৭ এপ্রিল তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করেন গভর্নর জেনারেল গুলাম মোহাম্মদ। একই দিনে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন মোহাম্মদ আলী (বগুড়া)। দুই বছরের কিছু বেশি সময় পর ১৯৫৫ সালের ১২ আগস্ট গভর্নর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা বরখাস্ত করেন মোহাম্মদ আলীকে।
মোহাম্মদ আলীর পর প্রধানমন্ত্রী হন চৌধুরী মোহাম্মদ আলী। ১৯৫৫ সালের ১২ আগস্ট দায়িত্ব নেন তিনি। ১৯৫৬ সালে সাংবিধানিক পরিবর্তনে দেশটির প্রেসিডেন্ট হন ইস্কান্দার মির্জা। তাঁর সঙ্গে দ্বন্দ্বের জের ধরে এক বছর এক মাস দায়িত্ব পালনের পর ১৯৫৬ সালের ১২ সেপ্টেম্বর পদত্যাগ করেন চৌধুরী মোহাম্মদ আলী।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পান ১৯৫৬ সালের ১২ সেপ্টেম্বর। ইস্কান্দার মির্জার সঙ্গে মেলেনি তাঁরও। ১৯৫৭ সালের ১৭ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দিন তিনি। এরপর ইস্কান্দার মির্জা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন ইব্রাহিম ইসমাইলকে। টিকতে পারেননি তিনিও। মাত্র দুই মাসের মাথায় পদত্যাগ করেন তিনি। এরপর মির্জা দেশটির সপ্তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেছে নেন ফিরোজ খান নূনকে। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান সামরিক আইন জারি করলে ফিরোজের সরকার ভেঙে যায়।
এরপর ১৩ বছর সামরিক শাসন জারি থাকে পাকিস্তানে। সামরিক শাসন শেষে ক্ষমতায় আসেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। তিনি ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সংবিধান পরিবর্তনের পর ১৯৭৩ সালে প্রধানমন্ত্রী হন তিনি। ১৯৭৭ সালের নির্বাচনে আবার জয়ী হন ভুট্টো। ওই বছরের জুলাইয়ে সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতা দখল করেন জিয়াউল হক। ১৯৭৯ সালে ভুট্টোকে সামরিক আদালতের রায়ে ফাঁসি দেওয়া হয়।
এরপর মোহাম্মদ খান (১৯৮৫-৮৮), বেনজির ভুট্টো (১৯৮৮-৯০), গুলাম মুস্তফা (আগস্ট’ ৯০-নভেম্বর’ ৯০) প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মইনুদ্দিন আহমেদ কুরেশি (জুলাই’ ৯৩-অক্টোবর’ ৯৩), বেনজির (১৯৯৩-১৯৯৬), মালিক মেরাজ খালিদ (১৯৯৬-১৯৯৭), জাফরুল্লাহ খান জামালি (২০০২-২০০৪), সুজাত হোসেন (জুন’ ২০০৪-আগস্ট ২০০৪), শওকত আজিজ (২০০৪-২০০৭), মোহাম্মদ মিয়া সুমরো (২০০৭-২০০৮), ইউসুফ রাজা গিলানি (২০০৮-২০১২), রাজা পারভেজ আশরাফ (২০১২-২০১৩) ও মির হাসান খান খোসা (মার্চ ১৩-জুন ১৩) প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কেউই পাঁচ বছরের মেয়াদ পূরণ করতে পারেননি।
উল্লেখ্য, পাকিস্তানের ৬৬ বছরের ইতিহাসে পিপিপি সরকার (২০০৮-২০১৩) গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম সরকার হিসেবে পাঁচ বছর মেয়াদ পূরণ করতে সক্ষম হয়। সেই সরকারেও প্রধানমন্ত্রীও পাঁচ বছরের মেয়াদ পূরণ করতে পারেননি।
(পাকিস্তান প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের ওয়েবসাইট ও একাধিক বার্তা সংস্থা থেকে প্রতিবেদন তৈরি করেছেন মাহফুজার রহমান)
সূত্র: প্রথম আলো
Discussion about this post