শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের প্রধান খলিফা ও সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার বদরুল ইসলাম শোয়েবের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগের শেষ নেই। নিজের (শোয়েব) নিয়োগ থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কর্মকাণ্ডেই বিতর্কিত হয়েছেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ নিয়ে অবৈধ সুবিধার ভাগ নিতে প্রভাবশালী এক শিক্ষকের গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধা করেননি তিনি।
মজার ব্যাপার হল এসব দুর্নীতিতে তার ভরসা সরকারবিরোধীরা। অনৈতিক সুবিধা নিয়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দিয়েছেন বিএনপি-জামায়াতের অনুসারীদের। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে বিষয়টি তথ্য প্রমাণসহ লিখিত অভিযোগ দেয়া হলেও তা সিন্ডিকেটে আড়াল করেন বদরুল ইসলাম শোয়েব।
সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বদরুল ইসলাম শোয়েবের ভয়াবহ দুর্নীতির তথ্য উঠে আসলেও অজানা কারণে তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বদরুল ইসলাম শোয়েব একটি বেসরকারি স্কুল অ্যান্ড কলেজে শিক্ষকতা করতেন। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের প্রভাব খাটিয়ে ২০১০ সালের আগস্ট মাসে তিনি সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ডেপুটি রেজিস্ট্রার হিসেবে অ্যাডহক ভিত্তিতে নিয়োগ পান। এই নিয়োগের ক্ষেত্রে সব ধরনের নিয়মনীতি উপেক্ষা করা হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় আইনে, এই পদে নিয়োগের জন্য কোন স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে সেকশন অফিসার এবং সহকারী রেজিস্ট্রার পদে ১০ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। কিন্তু শোয়েবের এ ধরনের কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। এরপরও তিনি নিয়োগ পান।
এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা বিতর্কের জন্ম হলেও শিক্ষামন্ত্রীর ভয়ে তখন কোনো প্রতিবাদ হয়নি।
এদিকে শোয়েব ডেপুটি রেজিস্ট্রার হয়ে ক্ষান্ত হননি। কারণ এই পদে থেকে প্রভাব খাটানো সম্ভব নয়। তাই তার সাধ জাগে রেজিস্ট্রার হওয়ার। শিক্ষামন্ত্রীর লোক হওয়ায় তার সে সাধও পূরণ হয়ে যায় সহজে। হয়ে যান রেজিস্ট্রার। এ ক্ষেত্রেও নিয়মনীতির তোয়াক্কা করা হয়নি।
বিশ্ববিদ্যালয় আইনে রেজিস্ট্রার পদে নিয়োগ পেতে সেকশন অফিসার, সহকারী অফিসার এবং ডেপুটি রেজিস্ট্রার হিসেবে ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা প্রয়োজন। কিন্তু শোয়েব ২০১০ সালে অভিজ্ঞতা ছাড়াই হন ডেপুটি রেজিস্ট্রার। আর এর তিন বছরের মাথায় ২০১৩ সালের অক্টোবরে পেয়ে যান রেজিস্ট্রারের দায়িত্ব।
তবে অবৈধভাবে রেজিস্ট্রার পদ দখলের বিষয়টি মেনে নিতে পারেননি বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু শিক্ষক-কর্মকর্তা। এভাবে নিয়োগের বিরুদ্ধে তারা উচ্চ আদালতে রিট করেন। তবে ওই আইনি প্রক্রিয়া চালানো সম্ভব হয়নি। কারণ রিট আবেদনকারীদের ওপর নেমে আসে হুমকি-ধমকি। রিট আবেদনকারীদের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগের একটি অংশকে লেলিয়ে দেন তিনি। পরে বাধ্য হয়ে আইনি প্রক্রিয়া থেকে সরে দাঁড়ান রিট আবেদনকারীরা।
জানা যায়, রেজিস্ট্রার হওয়ার পরই শোয়েব বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে হস্তক্ষেপ ও প্রভাব খাটাতে শুরু করেন। ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে ইউজিসির অনুমোদন ছাড়াই ১৩০ জনকে অ্যাডহক ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়া হয়। সেই নিয়োগ থেকেই বড় অংকের টাকা হাতিয়ে নেন রেজিস্ট্রার শোয়েব। সে সময় নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা সর্বনিম্ন ৫ লাখ টাকা ঘুষ দিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। অধিকাংশেরই নিয়োগ হয় শিক্ষামন্ত্রীর নাম ভাঙিয়ে বদরুল ইসলাম শোয়েবের সুপারিশে।
আর ওই বছরই অর্থ সংকটে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়। ওই বছর ৩৬৩ জন শিক্ষক কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য ইউজিসির বরাদ্দ ছিল। কিন্তু অনুমতি ছাড়া নিয়োগ দেয়ার কারণে শিক্ষক কর্মকর্তা-কর্মচারী সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৬৮ জন। আর অতিরিক্তদের বেতনসহ অন্যান্য ব্যয় নির্বাহে বড় ধরনের চাপে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়। এই চাপ কাটিয়ে উঠতে উপাচার্য রেজিস্ট্রার শোয়েবের পরামর্শে নিয়মবহির্ভূতভাবে কল্যাণ তহবিল ও উন্নয়ন তহবিল থেকে ব্যয় নির্বাহ করেন।
বদরুল ইসলাম শোয়েবের বিরুদ্ধে ২০ জুলাই যুগান্তরে প্রকাশিত খবরে তাকে (শোয়েব) নিয়ে গোয়েন্দা সংস্থার একটি প্রতিবেদনের (যেটি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানোও হয়েছে) কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। সেই প্রতিবেদনের কপি যুগান্তরের কাছে পৌঁছেছে। প্রতিবেদনে বদরুল ইসলাম শোয়েবের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগের কথা উল্লেখ রয়েছে তার অনেকটাই যুগান্তরের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ২০১৫ সালের ২ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ১০টি বিভাগে প্রভাষক পদে ১২ জন শিক্ষক নিয়োগ দেয়। এর মধ্যে ৫ জন সরকারবিরোধী ছাত্রসংগঠনের কর্মী। অনৈতিক সুবিধা গ্রহণের মাধ্যমে তাদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রেজিস্ট্রার বদরুল ইসলাম শোয়েব এবং উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম শাহি আলম মিলে অ্যাডহক ভিত্তিতে তার পূর্ব পরিচিত ১২ জনকে কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ দেন। একই বছরের ১৪, ১৫, ১৬ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬টি অনুষদের ২০টি বিভাগে ২৫টি প্রভাষক পদে নিয়োগ পরীক্ষা হয়। এসব নিয়োগে ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন বদরুল ইসলাম শোয়েবসহ আরও কিছু প্রভাবশালী শিক্ষক।
১৫ মার্চ পছন্দের প্রার্থীদের নিয়োগ নিয়ে প্রক্টর-অধ্যাপক আবদুল বাসেত ও রেজিস্ট্রার বদরুল ইসলাম শোয়েব বিতর্কের এক পর্যায়ে হাতাহাতিতে জড়ান। বিষয়টিকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়ে অচলাবস্থা তৈরি হয়। পরে স্থানীয় আওয়ামী লীগ শোয়েবের পক্ষে অবস্থান নিলে চাপের মুখে পড়েন শিক্ষকরা। এ নিয়ে এখনও ক্ষোভ রয়েছে খোদ সরকার দল সমর্থিত শিক্ষকদের মধ্যে।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বিএনপি-জামায়াতপন্থী শিক্ষকদের কৌশলে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে রেখে প্রভাব খাটাচ্ছেন রেজিস্ট্রার শোয়েব। জামায়াত মতাদর্শের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে পরিচিত ভেটেরিনারি অ্যান্ড এনিম্যাল সায়েন্সের ডিন অধ্যাপক মোহন মিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ক্রয় কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন।
আর একই আদর্শের কৃষি অনুষদের ডিন অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালক (গবেষণা) পদে দায়িত্ব পালন করছেন। শোয়েব এবং উপাচার্যের আস্থাভাজন হওয়ায় এরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম সিন্ডিকেটেরও সদস্য হয়েছেন।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ গত বছরের ২১ এপ্রিল সিন্ডিকেট বরাবরে পাঠানো এক আবেদনে সরকারবিরোধী ছাত্র সংগঠনের তিন কর্মীকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ না দেয়ার অনুরোধ করে। এরা হলেন- নুর মুজাহিদ (কৃষি অর্থনীতি বিভাগ), শারমিন আক্তার (কৃষি পরিসংখ্যান) ও নাজমুল হোসেন (প্রাণী উৎপাদন)।
কিন্তু রেজিস্ট্রার ছাত্রলীগের আবেদন গোপন রেখে সিন্ডিকেটে তিনজনের নিয়োগ পাস করিয়ে নেন। ছাত্রলীগ তাদের আবেদনের সঙ্গে বেশ কিছু প্রমাণপত্র দাখিল করেছিল।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি শক্তি ও যন্ত্র বিভাগে মোছা. শারমিন আক্তার রিমি নামে একজনকে প্রভাষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তার পিতার নাম আবুল হোসেন। বাড়ি- শেরপুর সদর উপজেলার বাজিতখিলার কুমড়িমুদি পাড়া গ্রামে। এই পরিবারের সবাই জামায়াত মতাদর্শে বিশ্বাসী এবং তারা যুদ্ধপরাধের অভিযোগে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কামারুজ্জামানের প্রতিবেশী। কিন্তু অনৈতিক সুবিধার মাধ্যমে তাকে নিয়োগ দিতে বাধ্য করান রেজিস্ট্রার বদরুল ইসলাম শোয়েব।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক সিনিয়র শিক্ষক যুগান্তরকে জানান, রেজিস্ট্রার তার স্বার্থের প্রশ্নে কাউকেই পরোয়া করেন না। ভয় দেখান শিক্ষামন্ত্রীর।
তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে আওয়ামী মতাদর্শী শিক্ষকদেরও জামায়াতপন্থী বানিয়ে দেন তিনি। শিক্ষকরা অভিযোগ করে বলেন, ‘শোয়েব রেজিস্ট্রার হওয়ার পর যেসব নিয়োগ হয়েছে সে বিষয়ে একটি নিরপেক্ষ তদন্ত হলেও কোন নিয়োগে কত টাকা লেনদেন হয়েছে তা বেরিয়ে আসবে।’
একজন শিক্ষক বলেন, তার জানামতে সর্বশেষ ১০ কর্মকর্তা নিয়োগে দু’একটি ছাড়া সব ক’টিতেই সর্বোচ্চ ১০ লাখ লেনদেন হয়েছে। যার বড় অংশ নিয়েছেন বদরুল ইসলাম শোয়েব।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে রেজিস্ট্রার বদরুল ইসলাম শোয়েব যুগান্তরকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের পর অনেক অনিয়ম, দুর্নীতি রুখে দিয়েছি। আমি যাদের দুর্নীতি করতে দেই না তারাই অপপ্রচার চালাচ্ছেন। হয়তো তাদের দেয়া ভুল তথ্যের ওপর ভিত্তি করে গোয়েন্দা প্রতিবেদন তৈরি হয়েছে।’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. গোলাম শাহী আলম যুগান্তরকে বলেন, ‘এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। আমি দায়িত্ব নেয়ার পর একটি লোকও বিধিবহির্ভূতভাবে নেয়া হয়নি। রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে তার কাছে কেউ কোনো অভিযোগও দেয়নি।’
বিশ্ববিদ্যালয়ে কতজন স্টাফের জন্য বরাদ্দ আছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ফাইল না দেখে তা বলতে পারব না।
সূত্র: যুগান্তর
Discussion about this post