মুহাম্মদ নোমান
কাতার ট্র্যাজেডি নিয়ে আর কিছু লেখার ইচ্ছে ছিলনা। কিন্তু বেশ কয়েকটি লেখা দেখে মনে হল- নাহ, ব্যাপারটি আরও একটু খোলাসা করা দরকার। আপনি যদি মনে করে থাকেন যে, কাতারকে নিয়ে যা চলছে তা কয়েকটি উপসাগরীয় রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, আমাদের তাতে নাক গলানোর প্রয়োজন নেই, তাহলে আপনি ভুলের মধ্যে আছেন। তবে, আপনার এই ভুল বোধগম্য। আশা করি ভবিষ্যতে আপনার এই ভুল ভাঙবে। কিন্তু যদি আপনি রিয়াদ, আবুধাবি, দুবাই, মানামায় বসে আল আরাবিয়া আর স্কাই নিউজের বিষ গলাধঃকরণ করে কাতারের সাথে ইরানী কানেকশন খোঁজেন, হামাস – ইখওয়ানের সাথে সাফাভী কানেকশনের জিগির তোলেন- তাহলে তা আমার মতো লাখো মুসলমানকে খুব আহত করে। আর যখন দেখি যে, সোশ্যাল মিডিয়ায় কোন এক অর্বাচীনের তিন মিনিটের একটি ভিডিও দেখে আপনার বিবেকের তারগুলো ছিঁড়ে যায়, এক পাগলের প্রলাপ শুনে আপনার স্বাভাবিক চিন্তা শক্তি লোপ পায়- তখন আপনার উপর আর ‘ক্ষোভ’ থাকেনা; বরং ‘করুনা’ এসে তার স্থান দখল করে।
প্রকৃত সত্য হচ্ছে, উম্মাহর সর্বশেষ প্রতিরোধবুহ্যগুলো ভেঙ্গে দেয়ার চেষ্টা চলছে। আরব রাজা বাদশাহদের গলায় গোলামীর জিঞ্জির পরানোর পর বৃহত্তর ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যে গুটিকয়েক বাধা এখনো তাদেরকে ‘বিরক্ত’ করছে সেগুলো সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা চলছে। উম্মাহর ঘাড়ে সর্বশেষ মরণ-কামড় দেয়ার ষড়যন্ত্র পুরোদমে এগিয়ে চলছে। হামাস – ইখওয়ানের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে আপনি উম্মাহর জীর্ণ শরীরে আরেকটি পেরেক ঠুকছেন। আপনি জেনেশুনে করছেন নাকি অজ্ঞতাবশতঃ করছেন সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। ইবরাহীমের জন্য জ্বালানো আগুলে যদি আপনি ঘি ঢালেন তাহলে তা নমরুদকে নিশ্চিতভাবেই খুশী করবে। আপনি অজ্ঞতাবশতঃ কাজটি করেছেন আপনার এমন দাবী আপনার দায়মুক্তির জন্য মোটেও যথেষ্ট হবে না। ক্ষতি যা হবার তা হয়ে যাবে।
গায়ে সাদা জুব্বা চড়িয়ে, মাথায় গোলগাল চাক্কা লাগিয়ে আমেরিকার মিয়ামি বীচে স্বল্পবসনা শ্বেতাঙ্গ নারীদের সাথে যারা জলকেলিতে মত্ত থাকে, যারা বৃষ্টির মতো পেট্রো ডলার উড়িয়ে তামাটে রঙের ল্যাটিন রমণীদের দেঁতো হাসি দেখতে আটলান্টিক পাড়ি দেয় আর হাভানা চুরুটের বারটা বাজায় তাদের মগজে এই বিষয়গুলো না ঢুকাই স্বাভাবিক। উম্মাহর চিন্তা করে নির্ঘুম রাত কাটানোর চেয়ে প্যারিসের বিলাসবহুল নাইট ক্লাবে নীলনয়না ষোড়শীদের সাথে নৃত্য করা আর রাশান ভদকার বোতলে ঝড় তোলা তাদের জন্য অনেক বেশী শ্রেয়। কিন্তু বাংলাদেশের মতো গরিব দেশের নাগরিক হয়ে রিয়াদ, দুবাই, আর মানামার আকাশচুম্বী ভবনগুলো দেখে আপনারও মতিভ্রম ঘটবে তা মানতে খুব কষ্ট হচ্ছে। একজন বাংলাদেশী হিসেবে আপনার জ্ঞ্যানের উপর অনেক আস্থা ছিল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে- “দিল্লি হানূয দূর আসত”।
যদি আপনি বিষয়গুলো বোঝেও না বোঝার ভান ধরেন, অথবা বুঝতে না চান- তাহলে আপনার সাথে তর্ক এখানেই শেষ। আপনার জন্য দোয়া থাকবে। কিন্তু যদি আসলেই আপনি অজ্ঞতার মধ্যে থাকেন তাহলে আপনার প্রতি অনুরুধ থাকবে- দয়া করে একটু আসুন, কাতারের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগগুলো আপনাকে নিয়ে একটু খতিয়ে দেখি।
এক.
ঘটনার শুরু হয় ২৪ শে মে থেকে। প্রায় মধ্য রাতের দিকে কাতারের রাষ্ট্রীয় সংবাদ মাধ্যম QNA এর ওয়েবসাইটে একটি সংবাদ ভেসে উঠে। “কাতারের আমীর বলেছেন- ইরান আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র এবং এই এলাকার একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি। ইরানের সাথে শত্রুতা পোষণ করা বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক নয়। ইসরাইলের সাথেও আমাদের ভালো সম্পর্ক রয়েছে।”
সংবাদটি QNA এর পেইজে ভেসে উঠার ঠিক ‘সাত’ মিনিটের মধ্যে সৌদি আরবের ‘আল- আরাবিয়া টেলিভিশন’ এবং আরব আমিরাতের ‘স্কাই নিউজ’ কাতারের উপর নজিরবিহীন আক্রমন শুরু করে। এই ‘সাত মিনিটের’ মধ্যেই তারা বিভিন্ন আলোচক জড়ো করে গরম টকশোর আয়োজন করে। শুরু হয় প্রচণ্ড মিডিয়া আক্রমণ। তারপর তাদের দেখা দেখি ওইসব দেশের অন্যান্য মিডিয়াও এক সুরে অগ্নি উদ্গিরন অব্যাহত রাখে। এই অল্প সময়ের মধ্যে কাতারের মিডিয়াগুলোও জানতে পারেনি যে, তাদের আমীর এইরকম বিবৃতি দিয়েছেন। তাহলে কি মানতে হবে যে, কাতারের সরকারী ওয়েবসাইট QNA কে কাতারের নাগরিকদের চেয়েও সৌদি আর আমিরাতের নাগরিকরা বেশী ফলো করে?
তারপর ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মধ্যেই কাতারের পক্ষ থেকে সরকারীভাবে ঘোষণা করা হয় যে, তাদের সরকারী ওয়েবসাইট হ্যাক করা করা হয়েছে। অনেকক্ষণ ধরে তারা ওয়েবসাইটে ঢুকতে পারছেনা। আমীরের নামে যা প্রচার করা হয়েছে তা সম্পূর্ণ ভুয়া। এটা হ্যাকারদের কাজ। কাতারের আমীর এই ধরণের কোন বিবৃতি দেননি, এবং বিবৃতিতে যা বলা হয়েছে তা কাতারের পররাষ্ট্রনীতির সাথে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক। আল আরাবিয়া আর স্কাই নিউজে দাবী করা হচ্ছিলো যে, ওইদিন কাতারের আমীর পুলিশের নতুন একটি ব্যাসের প্রশিক্ষণ সমাপনি অনুষ্ঠানে ঐ কথা বলেন। কিন্তু তারা তার কোন অডিও বা ভিডিও ফুটেজ দেখাতে পারছিলনা। অথচ, বাস্তবে কাতারের আমীর ঐ অনুষ্ঠানে ভাষণই দেননি।
এবার প্রশ্ন-
মধ্যরাতে কাতারের একটি সরকারী ওয়েবসাইটে প্রাচিরত একটি সংবাদ মাত্র ‘পাঁচ মিনিটের’ মাথায় কিভাবে রিয়াদ আর আবুধাবিতে ঝড় তোলে? অথচ, কাতারের নাগরিকরাও তখন তা জানতে পারেনি। সরকারিভাবে কাতারের পক্ষ থেকে তাদের ওয়েবসাইট হ্যাক হওয়ার কথাটি বার বার জোর দিয়ে বলা হলেও কেন তাদের বক্তব্য আমলে না নিয়ে সৌদি আর আমিরাতের মিডিয়াগুলোতে কাতারের বিরুদ্ধে আক্রমণ অব্যাহত রাখা হয়? কাতার সরকার নিজেদের দাবী প্রমাণ করার জন্য আমেরিকার এফবিআই এর সহযোগিতা কামনা করে। কাতারের গোয়েন্দাসংস্থা এবং এফবিআই এর যৌথ তদন্তে প্রমাণিত হয় যে, রাশান হ্যাকারদের মাধ্যমে QNA কে হ্যাক করা হয়েছে। কিন্তু তবুও সৌদি আর আমিরাত তা মানতে রাজি হয়নি। তাদের জোচ্চুরি তারা অব্যাহত রাখে।
তাহলে প্রশ্ন জাগে-
কারা রাশিয়ানদের দিয়ে হ্যাক করে এই আগুন জ্বালাল? কেন কাতারের সরকারী বক্তব্যে কান না দিয়ে মিডিয়া আক্রমণ অব্যাহত রাখা হল? গভীর রাতে, ঘটনার মাত্র ‘সাত মিনিটের’ মধ্যে কিভাবে আল আরাবিয়া আর স্কাই নিউজ টকশোর আয়োজন কোরতে পারলো? তাহলে কি সবকিছু পূর্ব পরিকল্পিত?
প্রশ্ন আপনার বিবেকের কাছে। আপনি উত্তর খুঁজবেন।
দুই.
এবার আসুন তাদের অভিযোগগুলো একটু দেখি। প্রথম অভিযোগ কাতার ইরানের সাথে মৈত্রী প্রতিষ্ঠা করেছে। শিয়াদেরকে কাতার সহযোগিতা করছে। খুব ভালো কথা। তাহলে এবার আসুন, দেখা যাক যারা অভিযোগ করছে তাদের কি অবস্থা।
প্রথমে ইরানের সাথে ২০১০ সালের পর থেকে নিয়ে এ পর্যন্ত উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোর বাৎসরিক বানিজ্যের খতিয়ানটা একটু দেখুন-
১. ইরানের সাথে সৌদি আরবের বাৎসরিক বানিজ্যের পরিমাণ- ৫০০ মিলিয়ন ডলার।
২. ওমানের ৪৭৭ মিলিয়ন ডলার। ওমানে ২৫৯ টি সরকারী রেজিস্ট্রিভুক্ত ইরানী কোম্পানি কাজ করে। ৩. বাহরাইনের ২০০ মিলিয়ন ডলার। ৪. কুয়েতের ১ মিলিয়ন ডলার। ৫. আরব আমিরাতের অর্থমন্ত্রী সুলতান আল মানসুরীর ঘোষণা অনুযায়ী ২০১৪ সালে ইরানের সাথে আরব আমিরাতের বানিজ্যের পরিমাণ ছিল ১৭ বিলিয়ন ডলার (মিলিয়ন না)। ২০১৩ সালে ছিল ১৭.৮ বিলিয়ন ডলার। ২০১১ সালে ছিল ২৩ বিলিয়ন ডলার। ২০১০ সালে ২০ বিলিয়ন ডলার। গোটা উপসাগরীয় অঞ্চলে ইরানের শতকরা ৮০ ভাগ বানিজ্যের অংশীদার আরব আমিরাত। আর বাকী ২০ ভাগ অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে। ইরানের গোটা বৈদেশিক বানিজ্যের হিসেবে আরব আমিরাত তার ৪ নং পার্টনার। (সূত্র কমেন্টে উল্লেখ থাকবে)। যখন বুশের আমলে আমেরিকা ইরানের উপর কঠোর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে তখন দুবাই-ই ইরানের বৈদেশিক বানিজ্যের একমাত্র মাধ্যম ছিল। ইরানকে আন্তর্জাতিক অবরোধের ধকল থেকে বাঁচাতে আরব আমিরাতই সবচেয়ে বেশী ভুমিকা পালন করে।
এবার কাতারের অবস্থান দেখেন-
“আলা মারকাজুল আরাবি লিল আবহাছ” নামে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্য মতে ইরানের সাথে কাতারের বাৎসরিক বানিজ্যের পরিমাণ হচ্ছে মাত্র ৩০০ মিলিয়ন ডলার। এবার ইরানের সাথে বানিজ্যের সূচক হিসেবে ক্রমিক আকারে একটি ছক আঁকা যাক-
১. আরব আমিরাত- ২৩ বিলিয়ন। গোটা গালফে ইরানী বানিজ্যের ৮০%। ইরানের পুরা বানিজ্যের হিসেবে ৪ নং পার্টনার।
২. সৌদি আরব- ৫০০ মিলিয়ন।
৩. ওমান – ৪৭৭ মিলিয়ন।
৪. কাতার – ৩০০ মিলিয়ন।
৫. বাহরাইন – ২০০ মিলিয়ন।
৬. কুয়েত – ১ মিলিয়ন।
যদি ইরানের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্কের কারণে কাতারকে বয়কট করতে হয় তাহলে তালিকার প্রথম তিন দেশের নাম আসছেনা কেন?
এবার ইরানের সাথে কোন দেশের রাজনৈতিক মৈত্রী কেমন তা দেখা যাক। উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ইরানের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক মিত্র হচ্ছে ওমান। ইরানের উপর এই পর্যন্ত যতগুলো অবরোধ আরোপ করা হয়েছে তার কোনটাতেই ওমান সায় দেয়নি। তেহরানে সৌদি দূতাবাসে হামলার পর সবকটি উপসাগরীয় রাষ্ট্র ইরান থেকে তাদের রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করে একমাত্র ওমান ছাড়া। ইয়েমেনে হাউছি শিয়াদের বিরুদ্ধে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটে ওমান অংশগ্রহণ করেনি। ২০১১ সালে বাহরাইনে শিয়া বিপ্লব ঠেকানোর জন্য সৌদির নেতৃত্বে জিসিসির সৈন্যরা যখন প্রবেশ করেছিল তখন সেখানে ওমান অংশগ্রহণ করেনি ইরান নাখোশ হবে এই ভয়ে। পরমানু ইস্যু নিয়ে ৬ বিশ্ব শক্তির সাথে ম্যারাথন আলোচনা ওমানের রাজধানী মাস্কাটে হয়েছিল।
এবার সৌদি আরবের অবস্থা দেখেন। ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে তেহরানে সৌদি দূতাবাসে বিক্ষুদ্ধ ইরানীরা হামলা করে। এই ঘটনার পর সৌদি আরব কেবল মাত্র রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করেছিল। ইরানের সাথে বানিজ্যক বা অন্যান্য সম্পর্ক ছিন্ন করেনি। আরব আমিরাতের দাবী অনুযায়ী তাদের তিনটি দ্বীপ এখনও ইরান দখল করে রেখেছে। কিন্তু আরব আমিরাত তাদের ভুমি দখলকারী একটি দেশের বিরুদ্ধে সম্পর্ক ছিন্ন করা তো দূরে থাক, মধুর সম্পর্ক বজায় রেখেছে।
এখন প্রশ্ন-
যদি ইরানী কানেকশনের কারণে কাতারের বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা নিতে হয় তাহলে ওমান আর আরব আমিরাতের ব্যাপারে তারা চুপ কেন? এই দুই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তো যুদ্ধ ঘোষণা করা উচিত। সৌদি আরবের কথা না হয় না-ই বললাম।
এবার দেখা যাক ইরানের বাইরের শিয়াদের সাথে কাদের সম্পর্ক কেমন? আরব রাষ্ট্রগুলোতে শিয়া প্রভাব ঠেকাতে কাতারের মতো অন্য কোন রাষ্ট্র অবদান রেখেছে বলে আমার জানা নেই। কাতারের কূটনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতায় সিরিয়ায় বাশারের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য ‘জাবহাতুন নুসরাহ’ নামে সবচেয়ে চৌকস এবং কার্যকর একটি যোদ্ধাদল তৈরি করা হয়। আইএস এর আবির্ভাবের আগ পর্যন্ত সিরিয়ার সরকারী বাহিনী, ইরানের বিভিন্ন শিয়া মিলিশিয়া দল এবং লেবাননের হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধে সবচেয়ে বেশী সফলতার পরিচয় দিয়েছে এই দলটি। এই ‘জাবহাতুন নুসরাহ’ গঠন করার কারণেই কাতারকে আজ সন্ত্রাসের মদদদাতা রূপে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। আশ্চর্যয়ের বিষয় হচ্ছে আমেরিকা, সিরিয়া আর ইরানের পাশাপাশি সৌদি আরবসহ অন্যান্য আরব রাষ্ট্রগুলোও এজন্য কাতারকে অভিযুক্ত করছে। ব্যাপারটা হল এমন যে, যার জন্য চুরি করি সেও বলে চোর, যার ঘরে চুরি করি সেও বলে চোর।
ইয়েমেনে সৌদির নেতৃত্বে শিয়া হাউছিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অন্যতম শরিক হচ্ছে কাতার। কাতারের আলা জাযিরা চ্যানেল যেভাবে সিরিয়া যুদ্ধকে দরদ দিয়ে কাভার করেছে তা দুনিয়ার অন্য কোন চ্যানেল করে নি। যদি আল জাযিরা না থাকতো তাহলে দুনিয়া জানতেই পারতোনা যে সিরিয়ায় কোন কেয়ামত ঘটছে।
এবার আরব আমিরাত ও মিসরের ভুমিকা দেখেন। বাশারের ফ্যামিলির বিভিন্ন সদস্য এখনও আমিরাতে নিরাপদে বসবাস করে বলে বিভিন্ন সংবাদে এসেছে। আরব আমিরাত দুনিয়ার একমাত্র দেশ যেখানে সিরিয়া যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে নিয়ে এই পর্যন্ত বাশার সরকারের বিরুদ্ধে একটি মিছিলও বের হতে পারেনি। ইয়েমেনে সৌদি নেতৃত্বে আরব মিত্রবাহিনী যখন হাউছি মিলিশিয়া আর সাবেক স্বৈরশাসক আলী আব্দুল্লাহ সালেহের বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করছে তখন সালেহের বড় ছেলে, তার আমলে ইয়েমেনের সেনাপ্রধান আহমাদ ইবনে সালেহ আবুধাবিতে বসে শায়খ যায়দের ছেলেদের আতিথেয়তায় আয়েশের জিন্দেগী যাপন করছে। গত মাসে এই আহমাদ ইবনে সালেহের নেতৃত্বে হাউছী এবং সালেহের পক্ষের একটি যৌথ প্রতিনিধিদল কায়রো সফর করে জেনারেল সিসির সাথে সাক্ষাৎ করে। সাক্ষাতের পরে সৌদি আরবকে আগ্রাসী শক্তি আখ্যা দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। এবার হাস্যকর বিষয় দেখেন- এই আমিরাত এবং মিসরই সৌদি আরবের সাথে যোগ দিয়ে কাতারের উপর অবরোধ দিয়েছে শিয়া প্রীতির ধুয়া তোলে। একজন আরব সাংবাদিক বিষয়টার দিকে ইঙ্গিত করে ব্যাঙ্গসুরে বলেছেন- “সৌদি, মিশর, আমিরাত আর বাহরাইনের রাষ্ট্রদূতরা তেহরানে বসে একসাথে ‘ইরানের সাথে সম্পর্ক রাখার অপরাধে’ কাতারের উপর অবরোধ আরোপের ঘোষণা দিয়েছে।”
তিন.
কাতারের বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযোগ- দেশটি ইখওয়ান এবং হামাসকে সহযোগিতা করছে। এই বিষয়টা নিয়ে লম্বা কিছু বলবনা। শুধু এটুকু বলবো যে, এই অভিযোগটি কাতারের জন্য অত্যন্ত সম্মানের এবং গৌরবের বিষয়। হামাসকে সহযোগিতা করে তারা গোটা উম্মাহর পক্ষ থেকে ফরজে কেফায়া আনজাম দিচ্ছে। ফিলিস্তিনের নিভু নিভু প্রদীপকে এখনও হামাস বুকের তপ্ত খুন দিয়ে প্রজ্বলিত রেখেছে। ৭০ বছর ধরে ইসরাইল আমেরিকা যে এখনো ফিলিস্তিনকে গিলতে পারেনি তা কাদের কারণে? আপনি কি মনে করেন যে, তা আরব রাষ্ট্রগুলোর ভয়ে করতে পারেনি?
ইখওয়ান নিয়ে তাদের এতো ভয় কেন? ভয় কি এই জন্য যে, যে ইখওয়ানের কারণে হুসনী মুবারকের ৩০ বছরের গদি উলটে গিয়েছিল তাদের কারণে যাতে রিয়াদ আবুধাবিতেও তার পুনরাবৃত্তি না ঘটে? ইখওয়ানকে ঘায়েল করার জন্য তাদের বিরুদ্ধেও সেই “শিয়া কানেকশনের” ধুয়া তোলা হচ্ছে। বিষয়টা একটু খতিয়ে দেখা যাক।
মিশর ঐতিহাসিকভাবে শিয়াদের আরাধ্যভুমি। সরকারী হিসেব মতে মিসরে ৮ মিলিয়ন শিয়ার বসবাস। হযরত হুসাইন রাজিঃ এর মাথা মুবারাক এই কায়রোতেই দাফন করা হয়েছে। সে হিসেবে শিয়াদের দুটি কেবলার মধ্যে একটি হচ্ছে কায়রো আরেকটি হচ্ছে ইরাকের নাজাফ। কায়রো ছিল শিয়া ফাতেমি সালতানাতের রাজধানী। ফাতেনী শিয়ারা কায়রোয় বসে দুইশত বছর ধরে মক্কা মদিনা শাসন করেছে। এমন কি ‘কায়রো’ নামটিও শিয়াদের দেয়া। তার আগের নাম ছিল ‘ফুসতাত’। এমন একটি শিয়া প্রভাবাধীন রাষ্ট্রে বিগত একশো বছর ধরে ইখওয়ানরাই শিয়া প্রভাব মুকাবেলা করে আসছে। ইখওয়ানের দাওয়াত এবং সামাজিক প্রভাবের কারণেই মিসরে শিয়া বিস্ফোরণ ঘটতে পারেনি। প্রেসিডেন্ট মুরসির বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানে খ্রিষ্টানদের পাশাপাশি শিয়ারাও সিসির সাথে যোগ দিয়েছিল। মুরসি ক্ষমতায় থাকা কালে প্রায় সময় ইরানী মিডিয়ায় মুরসি এবং ইখওয়ানকে আক্রমণ করে সংবাদ প্রচার করা হতো। মুরসির বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের পর যে কয়েকটি রাষ্ট্র সিসিকে আভিনন্দন জানিয়েছে সেগুলোর মধ্যে একটি ইরান।
ইমাম হাসান আল বান্না কেন ইখওয়ান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তা একটু দেখা যাক। ১৯২৩ সালে যখন তুরস্কে মুস্তাফা কামাল আতাতুর্কের হাতে উসমানী খেলাফাতের বিলুপ্তি ঘটে তখন গোটা মুসলিম দুনিয়ায় এই ঘটনার বিরুদ্ধে নিন্দার ঝড় উঠে। খেলাফাতের পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন মুসলিম দেশে দাবী উঠে। ব্রিটিশ ভারতে মাওলানা মুহাম্মাদ আলী জাওহার তাঁর ভাই শওকত আলীকে নিয়ে “Khilafat Movement” প্রতিষ্ঠা করেন। মিশরও তখন ব্রিটিশদের দখলে। কৌশলে তারা মিশরীয় সমাজে বস্তুবাদ এবং উন্নয়নের নামে বেলেল্লাপনা ছড়িয়ে দিচ্ছিল। খেলাফাতের বিলুপ্তি তাদেরকে আরও উদ্যমী করে তোলে। এই সময়ে হাসান আল বান্না খেলাফাত পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবীর পাশাপাশি মিসরে সামাজিকভাবে ব্রিটিশ প্রভাব মুকাবেলা করতে এবং খেলাফাতের শুন্যতা পূরণ করতে ‘ইখওয়ানুল মুসলিমীন’ প্রতিষ্ঠা করেন। খেলাফাতে উসমানীয়ার বিলুপ্তিতে সবচেয়ে বেশী খুশী হয়েছিল দুটি গ্রুপ। ইরানের সাফাভী শিয়ারা এবং হেজাজের মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাবের অনুসারীরা। কারণ উসমানীদের হাতে সাফাভীরা এবং মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাবের অনুসারীরা যেভাবে নাকানি চুবানি খেয়েছিল তা তারা কোন দিন ভুলতে পারবেনা। উসমানীরা না থাকলে ফাতেমীদের মতো সাফভীরাও ইরানের কূমে বসে আরও তিনশ বছর হেজায শাসন করতো। এবার প্রশ্ন- বান্নার সাথে বা ইখওয়ানের সাথে যদি সামান্য শিয়া কানেকশন থাকতো তাহলে শিয়াদের জানের দুশমন উসমানী খেলাফাত প্রতিষ্ঠার জন্য তারা কেন লড়াই করেছিলেন? খেলাফাত বিলুপ্ত হয়েছিল ১৯০২৩ সালে আর বান্না শহীদ হয়েছিলেন ১৯৪৯ সালে। খেলাফাতের বিলুপ্তির পরেও ২৬ বছর ধরে তিনি তুর্কি ফেজ টুপি পরেছেন খেলাফাতে উসমানীয়ার প্রতি আনুগত্য এবং ভালবাসার নিদর্শন স্বরূপ।
চার.
কাতারের বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযোগ তারা আল জাযীরার মাধ্যমে ‘ফেতনা’ ছড়াচ্ছে। আরব রাষ্ট্রগুলোর নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। আরব জনগণের শান্তি বিনষ্ট করছে। এই বিষয়ে আগের পোষ্টগুলোতেও লেখা হয়েছে, তাই বেশী কিছু লেখার প্রয়োজন মনে করছিনা। কেবল সংক্ষেপে আল জাযীরা অত্র এলাকায় কি কি ‘ফেতনা’ ছড়াচ্ছে তার কিছু নমুনা দেখেন-
আবুধাবী আর দুবাইতে যখন ইসরাইলী জেনারেলরা ওখানকার শাসকদের সাথে গোপন বৈঠকে মিলিত হয় তখন তা আল জাযীরা জনসম্মুখে প্রচার করে দেয়। সৌদি আরবে যখন গাড়ি ড্রাইভ করার অপরাধে একজন নারীকে জেলে ঢুকানো হয় তখন আল জাযীরা সেই সংবাদ প্রচার করে তাদের পাহাড়সম ইজ্জতের গায়ে একটু আঁচড় দেয়। ফিলিস্তিনে ইসরাইলী ট্যাঙ্কের নিচে পিষ্ট হয়ে হয়ে যাওয়া শিশুটির থেতলে যাওয়া লাশটির ছবি আল জাযীরা প্রচার করে। সিরিয়ায় নুসাইরি শিয়াদের নাবালন বোমার আঘাতে পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া শিশুটির ছবি আল জাযীরা প্রকাশ করে। এতে সমস্যা কি? সমস্যা হচ্ছে আল জাযীরার এসব ফালতু রিপোর্টগুলোর কারণে আরব জনগণের অন্তরে তাদের শাসকদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ বাড়ে। তাদের তখতে একটু হলেও কাঁপন ধরে। এই জন্য খাদেমুল হারামাইনসহ আরও তিনটি রাষ্ট্রের মহানায়করা আল জাযিরার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। তাঁরা আল জাযীরা বন্ধ করে দিতে চান। কারণ তাদের চাওয়া হচ্ছে- ফিলিস্তিন আর সিরিয়ার শিশুটির মৃত্যুর গোঙানি তাদের জাতির কর্ণকুহরে না পৌঁছুক। কায়রোর অন্ধকার জিন্দানখানায় হাড় গুড়ো করার ঠুস-ঠাস শব্দগুলো আল জাযিরার মাধ্যমে লাউড হয়ে যেন তাদের জাতির ঘুমে ব্যাঘাত সৃষ্টি না করে। কারণ পেট্রোডলারের নেশা আর ট্যাঙ্কের ব্যারেলের ভয়- কোনটাই স্থায়ী নয়। মিশর-তিউনিসিয়ার বিপ্লবের স্মৃতিই তাদের দুশ্চিন্তার বড় কারণ।
পাঁচ.
আরব আমিরাতের ‘ইহুদী কানেকশানের’ চিত্র আরও ভয়ঙ্কর। ইসরাইলের সাথে হাত মিলিয়ে আমিরাতে হামাসের যত নেতা ছিল সবাইকে তারা হত্যা করে আর না হয় গুম করে। ২০১০ সালে দুবাইয়ে হামাসের গুরুত্বপূর্ণ নেতা মাভুহকে মোসাদের গোয়েন্দারা আমিরাতের প্রত্যক্ষ মদদে হত্যা করে। ইসরাইল নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন ইহুদী অস্ত্র নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে আমিরাতের চুক্তি কারও অজানা নয়। ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে দুবাইতে বিশ্ব জ্বালানি সম্মেলনে ইসরাইলী মন্ত্রী সিল্ভান শ্যালোমের নেতৃত্বে ইসরাইলী প্রতিনিধিদল যোগদান করে এবং সম্মেলন কক্ষের বাইরে ইসরাইলী পতাকা উত্তোলন করা হয়। এই প্রথম উপসাগরীয় কোন রাষ্ট্রে ইসরাইলী পতাকা উড়েছে। আমেরিকার সকল ইহুদী লবির সাথে আমিরাতের সম্পর্ক। চলতি মাসের চার তারিখে আমেরিকায় আরব আমিরাতের রাষ্ট্রদূত ইউসুফ আল উতাইবার ইমেল ফাঁসের মাধ্যমে যা গোটা দুনিয়ার সামনে আসে। দুবাইয়ের পুলিশ প্রধান ‘দাহী খালফান’ তো হরহামেশাই বলে থাকেন যে, “ফিলিস্তিন ইহুদীদের বৈধ দেশ। সেখানে আরবদের কোন অধিকার নেই। ইহুদীরা আমাদের চাচার (ইসহাক আঃ এর) বংশধর।” এই কুলাঙ্গার ফিলিস্তিনকে ব্যাঙ্গ করে “ফিলস” (পয়সা) এবং “তীন” (মাটি) বলে। উদ্দেশ্য ফিলিস্তিনিদেরকে ভিক্ষুকের জাতি বলা। এগুলো সে টুইট করে। কিন্তু এর কারণে এপর্যন্ত আমিরাতে তার বিরুদ্ধে কিছু হয়েছে বলে কোন নজির নাই। সে এখনও দিব্বি তার সরকারী কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
ইসরাইলের সাথে সৌদি আরবের সম্পর্ক আরব আমিরাতের মতো না হলেও যা আছে তাও কোন অংশে কম নয়। সৌদি আরবের সাবেক গোয়েন্দা প্রধান আনোয়ার ইশকী ২০১৬ সালে ইসরাইল সফর করেন এবং ইসরাইলী প্রেসিডেন্টসহ সে দেশের গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিবিদ এবং সেনা অফিসারদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। আমেরিকার মিডিয়ায় সংবাদ এসেছে যে, ট্রাম্পের সাথে সৌদি আরব অস্ত্র কেনার যে বিশাল চুক্তি করেছে তার অধিকাংশ অস্ত্র আসবে ইসরাইল থেকে। মানে ঐ অর্থ ইসরাইলী কোষাগারে যোগ হবে।
আর এখন সৌদির নেতৃত্বে কাতারের উপর নিষেধাজ্ঞার কারণে সবচেয়ে বেশী খুশী হয়েছে ইসরাইল। নেতানিয়াহু বলেছেন – “আরবদের সাথে আমাদের আর কোন শত্রুতা রইলো না।” ইসরাইলী প্রতিরক্ষা মন্ত্রী লিভারম্যানের বক্তব্য – “এতো দিন পরে আরবদের বুঝে আসলো যে আমদের আর তাদের শত্রু এক ও অভিন্ন।” সৌদি মিডিয়ায় হামাসের উপর যেভাবে আক্রমণ করা হচ্ছে তা দেখে অধিকৃত পশ্চিম তীরের ইসরাইলী গভর্নর ‘মারদুখাঈ’ বলছেন- “হামাসের সন্ত্রাসের কথা আমরা এতো দিন আরবদের বোঝাতে পারিনি। কিন্তু সৌদি পত্রিকা ‘ওকাজ’ এবং ‘আল রিয়াদ’ তা খুব সুচারুরূপে আনজাম দিচ্ছে।”
ইমাম শাফেয়ী রাহঃ বলেছিলেন – “যদি তুমি হক এবং বাতিল কোনটি তা পার্থক্য করতে চাও তাহলে শত্রুর তীর কোথায় গিয়ে বিঁধছে তা দেখ।” শেরে বাংলা একে ফজলুল হক বলতেন- “হিন্দুরা যখন আমার প্রশংসা করে তখন আমি খুব বিচলিত হয়ে যাই। কারণ তখন আমার মনে হয় যে, আমি আমার স্বজাতি মুসমানদের বিরুদ্ধে কোন কিছু করেছি।”
ছয়.
এখানে এই বিষয়টি খোলাসা করা খুবই দরকার যে, আরব দেশের সরকারগুলো তাদের দেশের জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেনা। আবার কোন দেশের সরকারের সমালোচনা করা মানে সে দেশের প্রতি অশ্রদ্ধা জ্ঞ্যাপন করা নয়। হেজাযের মুল্য আমাদের কাছে দুনিয়ার সব কিছুর চেয়ে বেশী। হেজায ইসলামের প্রাণকেন্দ্র। তার প্রেম ভালোবাসা আমাদের অন্তরে কোন দিন কমবে না। তবে তার মানে এই নয় যে, সেখানকার শাসকদের ভুলগুলো আমরা ধরতে পারবোনা। হেজায কারও বাপের সম্পত্তি নয়, এটি গোটা দুনিয়ার মুসলমানদের সম্পত্তি। অতএব, হেজায নিয়ে কথা বলার অধিকার আমাদের আছে। আর হেজায শাসন করার জন্য যে আল্লাহ তায়ালা সবসময় ফিরিশতা পাঠিয়েছেন তা নয়। ৬৩ হিজরিতে উমাইয়া খলীফা ইয়াজিদের নির্দেশে তিন দিন ধরে মদিনায় গনহত্যা চালানো হয়েছিল। মসজিদে নববীতে আযান দেওয়াও সম্ভব হয়নি। ৭৩ হিজরিতে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ মিঞ্জানিক দিয়ে পাথর মেরে কাবার দেয়াল গুড়ো করেছিল। ৩১৭ হিজরি থেকে নিয়ে ৩৬৩ হিজরি পর্যন্ত শিয়া ‘কারামিতা’ সম্প্রদায় হেজায শাসন করেছিল এবং কাবা থেকে হাজরে আসওয়াদ খুলে নিয়ে গিয়েছিল। দীর্ঘ ২২ বছর পরে তারা হাজরে আসওয়াদ ফিরিয়ে দিয়েছিল। ৩৩৬ হিজরি থেকে নিয়ে ৫৬৬ হিজরি পর্যন্ত দীর্ঘ ২০২ বছর ফাতেমী শিয়ারা হেজায শাসন করে। এখন কারামিতা আর ফাতেমীরা হেজায শাসন করেছে এই জন্য তাদের সমালোচনা করা যাবেনা এ কথা তো কেউ বলেনি। আর তাদের সমালোচনা করা মানে যে হেজাযবাসির অমঙ্গল কামনা করা তাও নিশ্চয়ই নয়। হেজাযের উপর যখন শকুনদের শ্যান দৃষ্টি পড়ে তখন তা আমাদেরকে বিচলিত করে। সেখানকার শাসকদের বিলাসিতা আর মসনদ প্রীতির কারণে যদি খায়বারের উপর ইহুদীরা আবার গরম নিঃশ্বাস ফেলার সাহস পায় তখন মুসলমান হিসেবে তা আমাদেরকে বিদ্রোহী করে তোলে।
সবশেষে একটি কাহিনী দিয়ে কাতার ট্র্যাজেডি শেষ করি-
একবার একদল শত্রু সেনা একটি গ্রামে হামলা করে। গ্রামের সব পুরুষকে হত্যা করে এবং নারীদেরকে সারা রাত ধরে ধর্ষণ করে। কিন্তু একটি ঘরে ঘটেছিলো ব্যাতিক্রম ঘটনা। ঐ ঘরে ছিল এক সাহসী যুবতী। সে তার ঘরে প্রবেশকারি সৈন্যটির সাথে লড়াই করে তাকে হত্যা করে। সকালে গ্রামের সব নারী যখন রাস্তায় বের হয়ে আসলো দেখা গেলো যে, সবার চুল এলোমেলো। পরনে ছেঁড়া কাপড়। মস্তক অবনত। কিন্তু তাদের মধ্যে একটি যুবতী মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে আর তার হাতে একটি ছিন্ন মস্তক। গ্রামের মেয়েরা তাকে দেখেই হিংসায় জ্বলে উঠলো। একজন বলল – এই শয়তানী তো আমাদের মাঝে মাথা উঁচু করবে চলবে আর আমাদেরকে সারা জীবন ধিক্কার দেবে। তখন তারা সবাই বুদ্ধি করে একসাথে চিৎকার করে উঠলো – ধর হারামজাদীকে, সে সন্ত্রাসী। বেচারা নিরীহ সৈনিকটিকে সে হত্যা করেছে।
Discussion about this post