আজম খান
বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাঙালি জাতির গর্ব। এই বিপ্লবী ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে, ধর্মীয় ভণ্ডামির বিরুদ্ধে, শ্রেণী ও বর্ণ বৈষম্যের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। অথচ সেই তিনিই সম্পূর্ণ বিপরীত স্বার্থে ব্যবহৃত হচ্ছেন। তার ঘৃণা করা বিষয়গুলোও এখন তার ওপর আরোপ করা হচ্ছে।
নজরুল এখন বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের কাছে সবুজ ঘাসের নিচে শায়িত আছেন। আজানের সুর কানে আসবে, এমন এক স্থানে তিনি চিরনিন্দ্রায় শায়িত হওয়ার ইচ্ছাপ্রকাশ করেছিলেন। ধর্মীয় উগ্রবাদের তীব্র বিবাদ শোনার বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না তার।
কিন্তু ভারতে হিন্দুবাদী প্রপাগান্ডাবাদীরা এখন দৃশ্যত নজরুলকে তাদের নিজেদের সম্পদ হিসেবে দাবি করছে। এমনকি তারা আরো অগ্রসর হয়ে তাকে ‘হিন্দু দেবতা’ হিসেবেও আখ্যায়িত করছে।
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ (আরএসএস) গোয়েবলসীয় কায়দায় দাবি করেছে, ‘কাজী নজরুল ইসলাম ধর্ম অনুসরণ করলেও তিনি নিবেদিতপ্রাণ হিন্দু হিসেবে জীবনযাপন করতেন।’ সত্যের লেশমাত্র নেই এই দাবিতে। নজরুল দৃশ্যভাবে মানবতার বিরুদ্ধে তার বিশ্বাসের প্রতি অটল ছিলেন।
মুসলিম হিসেবে জন্মগ্রহণকারী নজরুল ইসলামের প্রতি শ্রদ্ধাবান ছিলেন। আবার সব ধর্মের প্রতিই ভালো ধারণা পোষণ করতেন। যেভাবে হামদ, নাতসহ ইসলামি গান লিখেছেন, সেভাবেই তিনি হিন্দু দেব-দেবতাদের প্রশংসা করে কলম ধরেছেন। তার কাছে মানুষ হলো সবার উপরে। তিনি ধর্মের বিরুদ্ধে ছিলেন না। তিনি ছিলেন ধর্মীয় ভণ্ডামির বিরুদ্ধে।
নজরুল ইসলামের জন্মবার্ষিকী ২৫ মে। আর আর এস এস পরিকল্পনা করছে তার সব সৃষ্টি ভারতীয় ভাষাগুলোতে অনুবাদ করার। মনে হতে পারে, মুসলিম কবির গৌরবগাঁথা উদারভাবে তুলে ধরার মাধ্যমে মুসলিম ভাবাবেগের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করার বিপুল উদ্যোগ নিয়েছে আর এস এস। নাকি তারা এটা তুলে ধরতে চাইছে, মুসলিম হলেও নজরুল হিন্দু বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন? যা-ই হোক না কেন, নি:সন্দেহে এটা নজরুলকে তাদের নিজেদের ছত্রছায়ায় আনার একটি নির্লজ্জ চেষ্টা।
এসব হিন্দু চরমপন্থী কি বুঝতে পারবে, নজরুল দৃঢ়ভাবে তাদের ওই অবস্থানের বিরুদ্ধেই দাঁড়িয়েছিলেন? তিনি তার গদ্য, পদ্য, গানে হিন্দু ও ইসলামি মৌলবাদের বিরুদ্ধে আঘাত হেনেছিলেন, দাড়ি ও টিকি উভয়ের বিরুদ্ধেই প্রবলভাবে সোচ্চার ছিলেন।
ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি), আরএসএস এবং এ ধরনের প্রকট হিন্দু রাজনৈতিক দলগুলো অতীতেও অন্যান্য জাতীয় বীরদের তাদের নিজেদের বলে দাবি করেছে। এদের মধ্যে রয়েছেন বি আর আম্বেদকর, বল্লভভাই প্যাটেল ও ভগত সিং। তাদেরকে কোনো না কোনো সময় আর এস এস নিজেদের মধ্যে সামিল করে নিয়েছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনী প্রচারণার সময় নরেন্দ্র মোদি প্যাটেলের প্রশংসা করে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, গুজরাটে এই নেতার সম্মানে বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা স্ট্যাচু নির্মাণ করবেন। তারা এখন নজরুলের দিকে নজর দিয়েছে।
নজরুল তার জীবনযাত্রা এবং সৃষ্টিতে সেক্যুলার হলেও অভ্রান্ত মুসলিম নামের মাধ্যমে তিনি মুসলিম। শৈশবে তিনি মোয়াজ্জিন হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন। বয়সকালে এবং অসুস্থ অবস্থায় ভারতে অবহেলিত থাকায় তাকে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। তাকে সর্বোচ্চ সম্মান ও পরিচর্যা দেয়া হয়। তাকে বাংলাদেশের জাতীয় কবির সম্মান দেয়া হয়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ভারতীয় বাঙালি এবং বাংলাদেশেরও অনেকে প্রায় দেবতার মর্যাদা দেয়া হলেও বাঙালি মুসলিম বাংলাদেশি মুসলিমরা নজরুলের সাথেই নিজেদের সম্পৃক্ত রেখেছে। তিনি তাদের মনের কথা বলেছেন। তিনি ইসলামি কবিতা লিখেছেন, কিন্তু তিনি গোঁড়া ছিলেন না। তিনি সব ধর্মের আধ্যাত্মিকতার প্রশংসা করতেন, কিন্তু ধর্মীয় বাগাড়ম্বরতার ভণ্ডামির বিরুদ্ধে, ধর্মীয় গ্রন্থের বিকৃত ব্যাখ্যা দিয়ে লোকজনকে বিভ্রান্ত করতে চাওয়া ধর্মীয় নেতাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতেন।
বাংলাদেশে কোনো কোনো মহল নজরুলকে ইসলামি কবি হিসেবে তুলে ধরতে চায়। কিন্তু তিনি প্রবাদতুল্য ‘রাম’ ও ‘রহিমকে’ এক প্লাটফর্মে রেখে তাদের হৃদয়-মন দখল করে আছেন। এর এস এস তা বাতিল করে তাকে খাঁটি হিন্দু হিসেবে তৈরি করতে চায়। যে ব্যক্তিটি মহররমের কোরবানি নিয়ে, আজানের শ্বাশত আবেদন নিয়ে লিখেছেন, পবিত্র কোরআনের বাণীর প্রশংসা করেছেন, তার প্রতি এমন কিছু আরোপ করা তাকে খর্ব করা, অশ্রদ্ধা করার সামিল।
তিনি এতটাই মহান ছিলেন যে, তার সৃষ্টির উদ্দীপনার উৎসের জন্য তিনি মহাভারত ও রামায়ণে থাকা হিন্দু নায়ক-নায়িকাদের প্রশংসা করতে পারতেন আনায়াসে। কিন্তু সেটা তাকে হিন্দুতে পরিণত করেনি। তার কাছে ‘মানুষের চেয়ে নাহি কিছু বড়ো, নাহি কিছু মহীয়ান’ – ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নেই, কিছুই মানুষের চেয়ে বড় নয়।’
ভারতের ফ্রন্টলাইন ম্যাগাজিনে বলা হয়েছে, ইতোপূর্বে আম্বেদকরকে আর এস এস হিন্দু আইকন করতে চেয়েছিল, এমনকি আম্বেদকর আর হেগেওয়ারের মধ্যে সমান্তরাল ছবি আঁকতেও পিছপা হয়নি। তারা আম্বেদকর সম্পর্কে বলে, তিনি বর্ণবাদী ব্যবস্থার সংস্কার চেয়েছিলেন, ব্যবস্থাটির বিরোধিতা করেননি। নজরুলের ব্যাপারেও তারা একই নীতি অনুসরণ করছে। তাদের ভাষায় নজরুল ভারতীয় মূল্যবোধের জন্য এবং ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন।
এতে অধ্যাপক অদিত্য মুখার্জির উদ্ধৃতি দিয়ে আরো বলা হয়, এই প্রয়াস নতুন কিছু নয়। আর এস এসের জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামে শেকড় নেই এবং অতীতেও তারা এ ধরনের প্রয়াস চালিয়েছিল। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং বিপিন চন্দ্র গ্রন্থের সহলেখক অদিত্য বলেন, নজরুলের ক্ষেত্রে অভিনব যেটা তা হলো মুসলিম নামটি। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আদিত্য মুখার্জি কিন্তু নজরুলকে মুসলিম হিসেবে অভিহিত করেননি, বলেছেন মুসলিম নাম। কারণ নজরুল অনিবার্যভাবে মানবীয় সত্তা, তিনি অবলীলায় বিভিন্ন ধর্মে অবগাহন করেছেন। বিপ্লবী কবির ওপর থিসিস রচনাকারী সৌমি রায় বলেছেন, কালী ও দুর্গা সম্পর্কে লিখেছেন, দাবি করেছে আর এস এস। তিনি শ্যাম নিয়েও লিখেছেন। তিনি ‘আল্লাহ, ইসলাম, রমজান, ঈদ’ নিয়েও লিখেছেন।
নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, আর এস এস ও বিজেপি বুঝতে পারছে, উগ্র হিন্দুদের একটি অংশের প্রতিনিধিত্ব করাই তাদের জন্য রাজনৈতিকভাবে লাভজনক নয়। তারা এখন আরো সামগ্রিকভাবে নিজেদের উপস্থাপন করার চেষ্টা করছে। তারা কেবল হিন্দু হিসেবে নয়, সার্বিকভাবে জাতির প্রতিনিধিত্ব করার চেষ্টা করছে।
তবে তারা যে কৌশলই অবলম্বন করুক না কেন, তাদের মুসলিমবিরোধী পরিচিতি দূর করা তাদের জন্য সহজ হবে না। দাঙ্গা ছড়িয়ে দেয়া, গরুর গোশত খাওয়ার জন্য হত্যা, নির্যাতন করা, ইসলাম এবং এর অনুসারীদের প্রতি পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণ করা হিন্দুবাদী মতাদর্শীদের পক্ষে তাদের বিষাক্ত তাচ্ছিল্য, প্রচণ্ড ঘৃণা গোপন করা সহজ নয়। তাদের অবশ্যই বুঝতে হবে, তারা যদি নজরুলকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে, তবে এই ঢালই তাদের প্রতি তীক্ষ্ণ তরবারি হয়ে তাদের প্রহসনকে টুকরা টুকরা করে ফেলবে।
কাজী নজরুল ইসলাম : অ্যা বায়োগ্রাফি গ্রন্থের লেখক সৌমি রায় লিখেছেন, নজরুল ছিলেন বন্ধনহীন সত্তা, মুক্তপ্রকৃতির মানুষ। কোনো রাজনৈতিক দল বা সরকারের পছন্দের মতো লোক তিনি নন। তাকে দেখা হয় বিদ্রোহী হিসেবে। তিনি সরকারি নির্যাতনের বিরুদ্ধে ছিলেন। তাকে হিন্দু দাবি করা লজ্জার এবং সেইসাথে উদ্ভটও। তিনি পণ্ডিতদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন, ঠিক একইভাবে তিনি মৌলভীদের বিরুদ্ধেও কথা বলেছেন। এবং হ্যাঁ, তিনি ছিলেন বহুত্ববাদী।
সৌমি রায় লিখেছেন, তিনি যেমন ইসলাম সম্পর্কে লিখেছেন, সেভাবেই লিখেছেন শ্যাম সম্পর্কে। তাকে কোনো একটি প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে আবদ্ধ করাটা হবে হাস্যকর বিষয়। ভালো কাজ করে বা করেছে এমন কাউকে হিন্দু হিসেবে অভিহিত করাটা নিতান্তই মাত্রা ছাড়ানো ব্যাপার।
পশ্চিমবঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিও নজরুল বিতর্কে যোগ দিয়েছেন। তিনি তার রাজ্যে বিপুল মুসলিম ভোটারকে কাছে টানতে চাইছেন। তিনি মুসলিম হওয়ায় তার নামে একটি বিমানবন্দর এবং একটি রেলস্টেশনের নামকরণ করেছেন।
সারা জীবন নজরুল লড়াই করেছেন অবিচারের বিরুদ্ধে। তিনি রাজনীতিবিদ, ধর্মনেতা এবং জনগণের মধ্যে বিভক্তি ও বৈষম্য সৃষ্টিকারী সবার বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। আজ তিনি কবরে শুয়ে আছেন, নামাজে শরিক হতে মোয়াজ্জিনের আহ্বান শোনেন। নিশ্চিতভাবেই তার প্রতি ভিত্তিহীন দাবি করায় তিনি কুঁচকে ওঠছেন। কিংবা তিনি এসব কথা শুনে হাসছেন। তিনি কারো নন। কিন্তু তিনি সবার।
সূত্র: সাউথ এশিয়ান মনিটর
Discussion about this post