জাহাঙ্গীর আলম আনসারী
দীর্ঘ দিন ধরেই আওয়ামী লীগ এমন এক অদ্ভুত রাজনীতির চর্চা করে আসছে যে, তারা যেটা বলবে সেটাই সঠিক। তারা যেটা করবে সেটাই কেবল গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক। নিজেদের দলীয় কোনো কর্মীকেও তারা নিরপেক্ষ বললে তিনিই হবেন দেশের মানুষের কাছে নিরপেক্ষ। নির্বাচন কমিশন গঠনের লক্ষ্যে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক গঠিত সার্চ কমিটির কয়েকজন সদস্যের দলীয় পরিচয় সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার পরও আওয়ামী লীগ তাদেরকে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ বলে চালিয়ে দিয়েছে। আর তাদের স্বার্থের বাইরে যেটা যাবে সেটাই হবে গণতন্ত্র ও সংবিধান পরিপন্থী। একটি বিষয় দেশের ১৬ কোটি মানুষের কাছে অযৌক্তিক বলে মনে হলেও সেটা তাদের কাছে যৌক্তিক। একজন ব্যক্তি সব শ্রেণী-পেশার মানুষের কাছে পক্ষপাতদুষ্ট এবং অগ্রহণযোগ্য হলেও তাদের কাছে তিনি নিরপেক্ষ। তাদের দাবিই এ দেশের মানুষের দাবি। ২০০৬ সালে আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল বলেছিলেন, দেশের ১৪ কোটি মানুষ প্রধান নির্বাচন কমিশনার এম এ আজিজকে চায় না। এর জবাবে বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব আবদুল মান্নান ভুঁইয়া হাসতে হাসতে বলেছিলেন ১৪ কোটি মানুষ যদি এম এ আজিজকে না চায়, তাহলে বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের কর্মী-সমর্থক ও যারা ভোট দিয়ে আমাদেরকে নির্বাচিত করেছেন তারা কি ১৪ কোটি মানুষের বাইরে?
যুক্তির রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ কখনো বিশ্বাসী ছিল না এবং এখনো নয়। দলটির রাজনীতির মূল উপাদান হলো শক্তি। তারা নিজেরা যেটাকে ভালো মনে করে সেটাকেই শক্তি দিয়ে জনগণের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়। বিভিন্ন জায়গায় কয়েকজন নির্বাচনী কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া ও ভোটার তালিকা হালনাগাদ করার কারণে এম এ আজিজকে বিএনপির দলীয় লোক আখ্যা দিয়ে তাকে মেনে নেয়নি আওয়ামী লীগ। সহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে এম এ আজিজকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছে তারা। আর রাষ্ট্রপতি এখন যাকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন তিনি যে আওয়ামী লীগের ঘরের লোক তার একাধিক প্রমাণ রয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, আগামী নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতেই বিএনপি রাষ্ট্রপতি গঠিত যোগ্য ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। অথচ নূরুল হুদাকে নিয়ে প্রশ্ন তোলার যুক্তিসঙ্গত একাধিক কারণ রয়েছে। আর কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পর্ক নেই নূরুল হুদা দাবি করলেও তিনি কর্মকাণ্ডে প্রমাণ করছেন আওয়ামী লীগের সাথে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। এরপরও আওয়ামী লীগ নেতারা নূরুল হুদাকে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ ব্যক্তি হিসেবে দাবি করে যাচ্ছেন। এমন চিত্র যদি আওয়ামী লীগের বেলায় হতো, পরিস্থিতি কী হতো সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আওয়ামী লীগ কোনোভাবেই তাকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে মেনে নিত না, বরং তাদের সহিংস আন্দোলনে এত দিন সারা দেশ নরকে পরিণত হতো।
তারপর ২০০৬ সালে সাবেক প্রধান বিচারপতি কে এম হাসানের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের অভিযোগ ছিল তিনি জিয়াউর রহমানের সময় বিএনপির কোনো একটি পদে ছিলেন। এ জন্য তারা কে এম হাসানকে কেয়ারটেকার সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে মেনে নেবে না। এ দাবিতে আন্দোলনের নামে সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যের মাধ্যমে সারা দেশে এক ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল। দাবি আদায়ের জন্য তারা বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের রাস্তায় ফেলে সাপের মতো পিটিয়ে হত্যা করেছিল। সারা দেশে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে কোটি কোটি টাকার ক্ষতি করেছিল। তারা তখন গর্বের সাথেই বলত যে ওয়ান-ইলেভেন তাদের আন্দোলনের ফসল। এরপর ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় এসে সংখ্যাগরিষ্ঠতার বলে সংবিধান সংশোধন করে তারা বহুল জনপ্রিয় নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দেয়। এখন তাদের বক্তব্য- নির্বাচন প্রধানমন্ত্রীর অধীনেই হবে। এখন স্বাভাবিকভাবেই একটি প্রশ্ন এসে যায়, বিচারপতি কে এম হাসান জিয়াউর রহমানের সময় বিএনপির কোনো একটি পদে থাকার কারণে যদি আওয়ামী লীগ তার অধীনে নির্বাচনে না আসে, তাহলে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী যিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি তার অধীনে বিএনপি নির্বাচনে আসবে কোন যুক্তিতে? একটি কারণে যদি কে এম হাসানের ওপর আপনারা আস্থা রাখতে না পারেন তাহলে আপনাদের দলের প্রধানের ওপর আরেকটি দলের লোকজন আস্থা রাখবে কী করে? আর আপনাদের সাজানো প্রশাসনের ওপরও তো বিরোধী দল আস্থা রাখতে পারে না।
আওয়ামী লীগ নেতারা এখন বিএনপিকে নিবন্ধন বাতিলের ভয় দেখাচ্ছে। তারা বলছেন, আগামী নির্বাচনে অংশ না নিলে বিএনপির নিবন্ধন বাতিল হয়ে যাবে। তাদের এ বক্তব্য খুবই হাস্যকর। যে দলটি কয়েকবার রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল। এখনো জনপ্রিয়তার শীর্ষে। তারা কি দলের নিবন্ধন টিকিয়ে রাখার জন্য রাজনীতি করে? একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্য হলো এখানে সরকারের পাশাপাশি একটি শক্তিশালী বিরোধী দল থাকবে। যারা সরকারের কর্মকাণ্ডের দোষত্রুটি জনগণের কাছে তুলে ধরবে এবং গঠনমূলক সমালোচনা করবে। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য দেশের প্রধান বিরোধী দলকে বাদ দিয়ে যেখানে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় সেটাকে আর যা-ই বলুক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলার কোনো সুযোগ নেই। একদলীয় নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে যারা সরকার গঠন করে তাদেরকেও গণতান্ত্রিক সরকার বলার সুযোগ নেই। বিরোধী দল যাতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে সেই পরিবেশ সৃষ্টি করার দায়িত্ব সরকারের। আমরা সরকারকে বলব বিরোধী দলকে দূরে ঠেলে নয়, এমন আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করুন যাতে সবাই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে।
Discussion about this post