পশ্চিমা বিশ্বের চাপে আওয়ামী সরকার বেশ নাজুক অবস্থায় আছে। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় না থাকায় বিএনপিও আছে নড়বড়ে অবস্থায়। হাসিনা সরকারের পদত্যাগ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এক দফা দাবীতে আন্দোলন করলেও বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো রূপরেখা হাজির করেনি জাতির সামনে।
বাংলাদেশে গত দু’মাসেরও বেশি সময় ধরে সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে আছে বিএনপি। সরকার পতনের আন্দোলনে আসার কারণ হিসেবে দলটির নেতারা বলছেন, নির্বাচনের সময় একটি নির্দলীয় সরকার না থাকলে অবাধ নির্বাচন সম্ভব নয়। কিন্তু একটি অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য দলটি নির্বাচন কমিশন এবং সরকারের যেসব সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে, সেটি বেশ সময়সাপেক্ষ।
বিএনপি সম্প্রতি যে আন্দোলন শুরু করেছে সেটার সূত্রপাত এক বছর আগে। গত বছরের অগাস্টে বিএনপি দেশজুড়ে প্রতিবাদ সমাবেশ এবং বিক্ষোভ শুরু করে। তবে তখন সেসব বিক্ষোভের মূল দাবি ছিল জ্বালানি ও দ্রব্যমূল্যের উর্দ্ধগতির প্রতিবাদ। গত বছরের ২২শে অগাস্ট থেকে শুরু হয়ে সেসব কর্মসূচি চলে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। বিএনপি’র বিক্ষোভে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নেতা-কর্মীর উপস্থিতিও দেখা যায়।
পরে অক্টোবর থেকে ১০ই ডিসেম্বর পর্যন্ত ১০টি বিভাগে ধারাবাহিক বিভাগীয় সমাবেশ করে বিএনপি। এসব সমাবেশে দ্রব্যমূল্যের উর্দ্ধগতির প্রতিবাদের সঙ্গে যুক্ত করা হয় ‘নেতা-কর্মীদের হত্যার বিচার’, খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং তত্ত্বাধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন।
বিভাগীয় সমাবেশের শেষটি হয় ঢাকায় ১০ ডিসেম্বর। নানা নাটকীয়তার মধ্যে অনু্ষ্ঠিত হওয়া সেই মহাসমাবেশে আন্দোলনের ১০ দফা দাবি ঘোষণা করে বিএনপি। দশ দফা দাবিতে দলটি মূলত: ৩টি বিষয়ে গুরুত্ব দেয়। সরকারের পদত্যাগ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন এবং খালেদা জিয়াসহ নেতা-কর্মীদের মুক্তি।
দশ দফা দাবি নিয়ে ছয় মাসেরও বেশি সময় আন্দোলনের পর চলতি বছরের ১২ই জুলাই সরকার পতনের একদফা আন্দোলনে যায় বিএনপি। বিএনপি শুরুতে অতীতের আদলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলে আসলেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সেটা সবসময়ই নাকচ করে দিয়েছে। এমনকি এরকম একটি সরকারের বিষয়ে বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর পক্ষ থেকেও দৃশ্যত কোন বক্তব্য বা চাপ আসেনি। ফলে একপর্যায়ে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকাররে’ বদলে বিএনপি ‘নির্দলীয়’ বা ‘নিরপেক্ষ’ সরকারের কথা বলতে শুরু করে।
যদিও সেই সরকারে কারা থাকবে এবং কিভাবে তারা কার্যক্রম পরিচালনা করবে সে বিষয়ে সুস্পষ্ট কোন রূপরেখা দিতে পারেনি দলটি। এটাকে এখনই গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে না বিএনপি। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বলছেন, নির্বাচনকালীন সরকারে কোন ধরণের লোক বসবে সেটা এখনি গুরুত্বপূর্ণ নয়।
“নির্দলীয় সরকারে রাজনৈতিক ব্যক্তি, নাকি অরাজনৈতিক ব্যক্তি, নাকি একাডেমিশিয়ান থাকলো এটা আসলে মূল প্রশ্ন নয়। মূল প্রশ্ন হচ্ছে, যারা সেই অন্তবর্তীকালীন সময়ে নির্বাচন পরিচালনা করবে, তাদের নির্বাচনী ফলাফলে কোন স্বার্থ থাকতে পারেব না,’’
“সে ধরণের কিছু মানুষকে নিয়ে আমরা তাদের দায়িত্ব দিতে চাই যে, তারা যেন একটা ট্রানজিশন (ক্ষমতার পালাবদল) সম্পন্ন করেন। ট্রানজিশন হবে কর্তৃত্ববাদী সরকার থেকে একটা গণতান্ত্রিক সরকারে উত্তরণ। সেটার প্রক্রিয়াটি কী হবে? সেটা হচ্ছে একটা সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন।”
বিএনপি জোর দিচ্ছে সুষ্ঠু নির্বাচনের উপর এবং সেক্ষেত্রে দলটির কাছে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে বিস্তারিত রূপরেখা না থাকলেও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরিতে সেই সরকারকে কী কী করতে হবে তা নিয়ে আলোচনা আছে দলটির ভেতরে। সেই তালিকাও বেশ লম্বা। যেমন – নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করা, প্রশাসনকে ‘নিরপেক্ষ’ করা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ঢেলে সাজানো, এমনকি বিচারবিভাগেও কিছু সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে দলটির নেতাদের পক্ষ থেকে।
বিএনপি’র সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক রুমিন ফারহানা বলছেন, এসব বিষয়ে সংস্কার না হলে অবাধ নির্বাচন সম্ভব হবে না। “এই নির্বাচনটি নির্বাচন কমিশন যেন নির্দলীয় সরকারের সহযোগিতায় সুষ্ঠুভাবে করতে পারে সে পরিবেশ তৈরি করা জরুরি। ভোটের পরিবেশ এমন করতে হবে যেন সকল দল, প্রার্থী এবং কর্মীরা প্রচারণায় অংশ নিতে পারে”।
এবার বিএনপি নিরপেক্ষ কিংবা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচনের যে কথা বলছে, সেখানে সেই সরকারের মেয়াদ নিয়ে নির্দিষ্ট কিছু বলা হয়নি দলটির তরফ থেকে। আবার একইসঙ্গে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যেসব কাজের কথা বিএনপি তুলে ধরছে সেটার বাস্তবায়নও সময়সাপেক্ষ।
ফলে রাজনৈতিক অঙ্গনে এমন আলোচনা আছে যে, বিএনপি এখনই নির্বাচনে না গিয়ে নির্বাচনের আগে অন্তত এক থেকে দুই বছর মেয়াদি কোন একটা অন্তর্বর্তীকালীন ‘নিরপেক্ষ’ সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চায়। যার উদ্দেশ্য হতে পারে এই সময়ের মধ্যে মামলার চাপ কমিয়ে দল গোছানো এবং দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ দেশের বাইরে থাকা নেতাদের দেশে ফেরার পরিবেশ তৈরি করা। নিজেদের নির্বাচনের উপযোগী করা।
Discussion about this post