কেয়ারটেকার সরকারের অধীনেই আগামী জাতীয় নির্বাচন করতে হবে বলে দাবি করেছেন জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। গত দুটি নির্বাচনের প্রসঙ্গ টেনে জামায়াতের এই নেতা বলেছেন, ‘২০১৪ গিয়েছে যাক, ২০১৮ গিয়েছে যাক, কিন্তু ২০২৩ সাল এভাবে অতীতের মতো আর যাবে না। দিস ইজ দা লাস্ট টাইম, এবার নির্বাচন হবে নিরপেক্ষ কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে ইনশা আল্লাহ।’
গতকাল শনিবার বিকেলে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে জামায়াতের এক সমাবেশে আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের এ কথা বলেন।
এক দশকের বেশি সময় পর জামায়াত পুলিশের মৌখিক অনুমতি পেয়ে ঢাকায় এই সমাবেশ করল। এর আগে ৫ জুন সমাবেশের অনুমতি না পেয়ে জামায়াত তাদের কর্মসূচির তারিখ পরিবর্তন করেছিল। শেষ পর্যন্ত পরিবর্তিত তারিখে অনুমতি পেয়ে আজ সমাবেশ করল জামায়াত। দলটি অনুমতির শর্ত অনুযায়ী রাস্তায় সমাবেশ করেনি। তারা সমাবেশ করেছে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে। দীর্ঘদিন পর দলীয় এই সমাবেশে বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মী উপস্থিত হন।
‘দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ, দলের আমির শফিকুর রহমানসহ কারাবন্দী রাজনৈতিক নেতা ও আলেমদের মুক্তি এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার’ দাবিতে জামায়াত এই সমাবেশ করে।
সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, ‘আমি বেশি ব্যাখ্যা দেব না, শুধু বলব, এবারের নির্বাচন হবে একমাত্র কেয়ারটেকার, কেয়ারটেকার, কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে। এবং সে দাবি আদায় করার জন্য যা করা দরকার, আন্দোলন করা দরকার, ইনশা আল্লাহ সে আন্দোলন আমরা করব।’
দেশের এই সংকটময় মুহূর্তে দলমত-নির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান এই জামায়াত নেতা। তিনি বলেন, ‘আজকের জাতির জন্য সবচেয়ে প্রয়োজন হচ্ছে একটি জাতীয় ঐক্য। আমি দলমত–নির্বিশেষে, সরকার-বিরোধী দল সবাই মিলে একটি জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানাই।’
জামায়াত নেতা আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের জন্য সরকারের সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের বন্ধুরা খুব সংবিধান মানতে চান এখন। যাহাই হইবে, সংবিধানের ভিতরে হইতে হইবে, এতই সংবিধানের প্রতি তাদের আস্থা-বিশ্বাস। সংবিধানের ভেতরেই তো লেখা আছে মানুষের অধিকারের কথা, বাক্স্বাধীনতার কথা, অবাধ নির্বাচনের কথা—ওইটা তো মানছেন না।’
তাহের বলেন, ‘একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সবার সমান সুবিধা প্রয়োজন। আপনি ক্ষমতায় থাকবেন, আর আমরা নিচে থাকব, তাহলে তো মাঠ সমান হবে না। সংবিধানের আলোকে দেশ পরিচালিত হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। সংবিধান প্রয়োজনে পরিবর্তন করতে হবে।’
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের একটি বক্তব্যের উল্লেখ করে আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, ‘উন্নত বিশ্বে সরকারের অধীনেই নির্বাচন হয়। এটা সবাই জানে। কিন্তু নির্বাচনের সময় দিনের ভোট রাতে হয়, নির্বাচনের আগেই প্রায় সংখ্যাগরিষ্ঠ এমপি ঘোষণা হয়ে যায়, এমন কোনো দেশ কি আছে?’ তিনি বলেন, ‘লজ্জা ইমানের একটি অংশ। রাজনৈতিক নেতাদের কিছুটা হলেও লজ্জা থাকতে হয়। বুঝেশুনে নেতারা পুরো চোখ মেলে অগাধ মিথ্যা কথা বললে, সেটা জাতির জন্য সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক।’
সমাবেশের অনুমতি দেওয়ার জন্য পুলিশ প্রশাসনকে ধন্যবাদ জানান আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। এ প্রসঙ্গে তাহের বলেন, ‘আমি পুলিশ প্রশাসনকে আশ্বস্ত করতে চাই, জামায়াতে ইসলামী তার কোনো সমাবেশে, মিটিংয়ে, কোথাও নিজে থেকে কোনো কিছু হওয়ার সম্ভাবনা অতীতে ছিল না, এখনো নাই, ভবিষ্যতেও থাকবে না। যদি কিছু হয়, সেটা হয় স্যাবোটেজ, বাইরে থেকে উসকানিমূলক, ষড়যন্ত্রমূলক।’
সমাবেশে জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমির মুজিবুর রহমানের একটি লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান দলের কেন্দ্রীয় নেতা মতিউর রহমান আকন্দ। সেই লিখিত বক্তব্যে দলটির ভারপ্রাপ্ত আমির সারা দেশের জামায়াতের সব কার্যালয় খুলে দেওয়া এবং সভা–সমাবেশের বাধা দূর করার দাবি জানান। উল্লেখ্য, প্রায় ১৩ বছর ধরে ঢাকাসহ সারা দেশে জামায়াতের কার্যালয় বন্ধ রয়েছে।
সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এ এইচ এম হামিদুর রহমান বলেন, ‘আপনারা আমাদের সভা-সমাবেশ করতে দিচ্ছেন না। আজকে দিয়েছেন। ১৩ সালে দিয়েছিলেন চার বছর পর, এবার ১০ বছর পর দিয়েছেন। তাও পরিপূর্ণ অধিকার আমরা পাইনি। আমরা অনুমতি চেয়েছিলাম রাজপথে। সব দল যদি রাজপথে সমাবেশ করে, জামায়াতে ইসলামীও করবে।…এবার কথা বন্ধ হবে না ইনশা আল্লাহ। ’
আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল হালিম বলেন, ‘যারা আমাদের (জামায়াতকে) নিষিদ্ধ সংগঠন, অবৈধ সংগঠন বলেছেন, তারাই আজকে বাধ্য হয়েছেন এই সমাবেশের অনুমতি দিতে। জামায়াতে ইসলামীকে সন্ত্রাসী দল হিসেবে চিহ্নিত করা, অগণতান্ত্রিক পথে ঠেলে দেওয়ার জন্য বর্তমান সরকার এবং প্রশাসন অনেক অপকৌশল করেছে। আমাদের নেতৃবৃন্দকে গ্রেপ্তার করে, ছাত্রশিবিরে হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করে বলা হয়েছে, এরা সন্ত্রাসী। কিন্তু আজ কী প্রমাণ হচ্ছে।’
জামায়াত অনিবন্ধিত রাজনৈতিক দল—এ কথা ডাহা মিথ্যা, অসাংবিধানিক এবং বেআইনি বলে দাবি করেন কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য ও আইনজীবী মতিউর রহমান আকন্দ। তিনি বলেন, ২০০৮ সালে জামায়াত নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন লাভ করেছে। এই নিবন্ধনের বিরুদ্ধে রিট করে আদালতে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছিল। হাইকোর্টের তিনজন বিচারপতির একজন পক্ষে রায় দিয়েছেন, দুজন বলেছেন এটা (জামায়াতের নিবন্ধন) বেআইনি। এটা সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন আছে। এই অবস্থায় জামায়াতে ইসলামীকে বেআইনি, নিবন্ধন নাই- এ কথা বলার ক্ষমতা বাংলাদেশে কোনো ব্যক্তির নাই।’
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ জামায়াতের আমির নুরুল ইসলাম বুলবুলের সভাপতিত্বে সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন মহানগর উত্তরের ভারপ্রাপ্ত আমির আবদুর রহমান মুসা, সেক্রেটারি রেজাউল করিম, দক্ষিণের সেক্রেটারি শফিকুল ইসলাম মাসুদ প্রমুখ।
Discussion about this post