অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
বিচার বহির্ভূত হত্যার দায়ে আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা প্রাপ্ত পুলিশের আই জি বেনজীর আহমদ চলতি মাস শেষে অবসরে যাচ্ছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের এক প্রজ্ঞাপনে আজ বৃহস্পতিবার (২২ সেপ্টেম্বর) এ কথা জানানো হয়েছে। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, পুলিশ মহাপরিদর্শক ড. বেনজীর আহমেদের বয়স আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর ৫৯ বছর পূর্ণ হবে। তাই সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮ এর বিধান অনুযায়ী তাকে চাকরি থেকে অবসর প্রদান করা হলো।
কে এই বেনজীর?
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দীর্ঘ দিনবেনজীর ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার ছিলেন। এরপর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে সরকারের মনতুষ্ট করে ২০১৫ সালে র্যাবের মহাপরিচালক পদ বাগিয়ে নেন। পরে ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে র্যাব থেকে তাকে আইজিপি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। তখন র্যাবের মহাপরিচালক হিসেবে তার স্থলাভিষিক্ত হন চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন।
পুলিশ ক্যাডারের এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মানবতা বিরোধী অপরাধসহ বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগ রয়েছে। ফ্যাসিবাদকে ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত এবং টিকিয়ে রাখতে নিরন্তর অপচেষ্টায় ছিলেন তিনি। রাষ্ট্রীয় বেতনভুক্ত প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হওয়া সত্ত্বেও তিনি মূলত: কাজ করেছেন ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। পুলিশের বিভিন্ন সেমিনারে বক্তব্য রেখেছেন রাজনৈতিক কর্মীর মত। বিরোধী দলকে দমনে সিদ্ধহস্ত এই পুলিশ কর্মকর্তার নির্দেশে অসংখ্য বিরোধী দলীয় কর্মীকে বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং গুম করা হয়েছে। ভিকটিমদের পরিবার গুলো একদিন ন্যায় বিচারের জন্য আবেদন জানানোর অপেক্ষায় রয়েছে।
এছাড়া ২০১৩ সালে ঢাকার শাপলা চত্ত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যাকাণ্ডের সময় বেনজির আহমদ ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার ছিলেন। তার নেতৃত্বেই ২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকার শাপলা চত্ত্বরে গণহত্যা সংগঠিত হয়েছিল।
গুম-খুনের হোতা
বাংলাদেশে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার গুরুতর অভিযোগে মার্কিন প্রশাসনের কালো তালিকাভুক্ত পুলিশের মহাপরিদর্শক বেনজির আহমেদ। শুধু তাই নয় মার্কিন প্রশাসনের কালো তালিকাভুক্তের মধ্যেও ছিলেন এই বিনজীর।
২০২১ সালের ১০ই ডিসেম্বর বেনজীর আহমেদ সহ র্যাবের শীর্ষ ৭জন বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তা এবং র্যাবকে কালো তালিকাভুক্ত করে মার্কিন প্রশাসন। বাংলাদেশে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার গুরুতর অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা নেমে আসে।
কালো তালিকাভুক্তির পর বাংলাদেশের বেসরকারি এক টেলিভিশনে দেয়া এক সাক্ষাতকারে কালো তালিকাভুক্তির ব্যাপারে বেনজীর আহমেদ ঠাট্টার ছলে বলেছিলেন ‘হোয়াই এম আই”। তার এই প্রশ্নে এটা স্পষ্ট হয়েছিল যে, বাংলাদেশে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগে অন্য কাউকে কালো তালিকাভুক্ত করা উচিত। সরাসরি না বললেও, মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য মূল নির্দেশদাতা হিসেবে শেখ হাসিনার দিকেই ইঙ্গিত করেছিলেন তিনি। তার সেই প্রশ্নে মূলত মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি কার্যত স্বীকার করে নেয়া হয়েছিল।
এরপর জার্মানীতে পুলিশের এক প্রতিনিধি দল নিয়ে এই পুলিশ কর্মকর্তার ভ্রমণের পরিকল্পনার বিষয়টিও ঘটা করে প্রচার করেছিল পুলিশ সদর দপ্তর। পুলিশের জন্য বালিশ কিনতে ইউরোপের সেই দেশে তাদের যাবার কথা ছিলো। বালিশ কিনতে লাটবহর নিয়ে ইউরোপ ভ্রমণের পরিকল্পনার বিষয়টি নিয়ে পরে বেশ হাস্যরসের সৃষ্টি হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে বলা হয়েছিল যে, প্রেস রিলিজটি ভুলবশত গণমাধ্যমে পাঠানো হয়েছিল। এরপর গোপালগঞ্জের বেনজীরের জার্মানী সফর বাতিল করা হয়।
মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোনো ব্যক্তিকে তালিকাভুক্ত করলে সেই নিষেধাজ্ঞা যুক্তরাজ্য ও কানাডার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে বলে তখন জানিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের রাজস্ব বিভাগের ডেপুটি সেক্রেটারি ওয়ালি আডেয়েমো। এছাড়া, মানবাধিকার লঙ্ঘন বা দুর্নীতিতে সম্পৃক্ত ব্যক্তির সম্পদ বাজেয়াপ্তের কথা বলা হয়েছিল সেই আদেশে।
এখানেই শেষ নয়, মালয়েশিয়া সফরকালে সেই দেশের ইমিগ্রেশন ডিপার্টমেন্টের মহাপরিচালক দাতো ‘শ্রী খায়রুল দাজাইমি বিন দাউদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাত চেয়ে বেনজীর পক্ষ থেকে আবেদন করেছে মালয়েশিয়ায় অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাস।
২৯শে মার্চ থেকে পহেলা এপ্রিলের মধ্যে কোনো একদিন সুবিধা অনুযায়ী এই সৌজন্য সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা করার জন্য মালয়েশিয়ার কর্তৃপক্ষের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়।
বেনজীর আহমেদ বাংলাদেশ পুলিশের ৩০তম মহাপরিদর্শক। ২০২০ সালের ১৫ এপ্রিল থেকে পুলিশ মহাপরিদর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এর আগে তিনি র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এর মহাপরিচালক এবং ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের পুলিশ কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি যখন ডিএমপির কমিশনার ছিলেন, তখন তথাকথিত “অপারেশন সিকিউর শাপলা বা শাপলা চত্বর অভিযান” এর নামে ২০১৩ সালের ৫ ও ৬ ই মে ইসলামী অরাজনৈতিক জোট হেফাজতে ইসলামের গণসমাবেশে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়।
র্যাব মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্বপালনের সময় দেশব্যাপী তথাকথিত মাদক উদ্ধারের নাম বিরোধী দলে নেতাকর্মীদের ব্যাপকভাবে দমন-পীড়ন, গুম ও তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে পুলিশ হেফাজতে হাতকড়া অবস্থায় অনেক মানুষকে নির্মমভাবে হত্যার নির্দেশদাতা এই পুলিশ কর্মকর্তা।
মার্কিনবিরোধী অবস্থান নিতে আলেমদেরকে উস্কানি
আলেমদেরকে গণহারে হত্যার এই খলনায়ক রোববার (২৪ জুলাই) রাজধানী ঢাকার রাজারবাগে বাংলাদেশ পুলিশ অডিটোরিয়ামে এক অনুষ্ঠানে নিজেকে ইসলাম দরদী সাজিয়ে বলেন, গোটা বিশ্বে ইসলামকে জঙ্গি ধর্ম হিসেবে হাজিরের চেষ্টা চলছে।
এন্টি টেররিজম ইউনিট “ইসলামের দৃষ্টিতে উগ্রবাদ ও সন্ত্রাসবাদ” শীর্ষক একটি কাউন্টার ন্যারেটিভ (মূলত সেক্যুলারদের চোখে ইসলামকে বর্ণনা) সংকলন প্রকাশ উপলক্ষ্যে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এমন বক্তব্য দেন বেনজির আহমদ।
বিভিন্ন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে আমেরিকার আক্রমনের প্রতি ইঙ্গিত করে মার্কিন স্যাংশনের আওতায় থাকা বেনজীর আহমদ প্রশ্ন রেখে বলেন, “আইসিস পয়দা করল কারা?”
সিরিয়া ও ইরাকে ধ্বংসযজ্ঞের উদাহরণ টেনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাম উল্লেখ না করে বিচারবহির্ভূত হত্যাকারী হিসাবে চিহ্নিত এই গোপালী পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, “ইরাকে খাদ্যের অবরোধ দেয়া হয়েছিল… এসব ব্যাপারে যদি মূলধারার হুজুররা এগিয়ে না আসেন তাহলে তো কোণঠাসা করা হবে। ইসলামে বিশ্বাসীদের বিশ্বব্যাপী কোণঠাসা করার চেষ্টা হচ্ছে।”
অথচ এই পুলিশ কর্মকর্তাই অতীতে একবার বলেছিলেন, “যারা শুদ্ধভাবে সালাম দেয় তাদেরকে পুলিশে ধরিয়ে দিন।”
এই পুলিশ কর্মকর্তা অতীতে আলেম-ওলামাদের বিরুদ্ধে হুমকি-ধমকিসহ নানা ব্যঙ্গাত্মক কটুবাক্যে ও বিষোদ্গার করেছেন। আলেম-ওলামাদের শাসিয়ে চুপ থাকার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন বহুবার। নতুবা হাড্ডি গুড়া করে দেবার হুঙ্কার অতীতে দিয়েছেন।
শেখ মুজিবুর রহমানের মূর্তির পক্ষে ২০২০ সালের ১২ই ডিসেম্বর ঢাকা শেরেবাংলা নগরে আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে সরকারি কর্মকর্তা ফোরামের নামে এক প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছিল। সেই সমাবেশে আওয়ামী লীগ নেতাদের মতোই দলীয় বক্তব্য দিয়েছিলেন বেনজীর। অদ্ভুত ভঙ্গিমায় বক্তব্যের সময় দুই-একজন ইসলামী বক্তার নাম উচ্চারণ করে নিজের পাণ্ডিত্য জাহির করার চেষ্টা করেছিলেন। সেই বক্তব্যে আলেমদেরকে নিয়ে মিথ্যাচার, মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি নিয়ে ভুল তথ্য দেয়া এবং ইসলামপন্থী নেতাদের নিয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যও করেছিলেন ইসলাম-বিদ্বেষী এই আইজিপি। ওই সমাবেশে বেনজির আহমদসহ অন্যান্য সরকারি উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের বক্তব্য ছিল আওয়ামী লীগের দলীয় বক্তব্যের কপি ভার্সন।
সেই সমাবেশে বেনজির আহমদের বক্তব্যের ১৬ মিনিটের একটি ভিডিও পরবর্তীতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছিল। শেখ মুজিবুর রহানের মূর্তির বিরুদ্ধে কথা বলাকে রাষ্ট্র, সংবিধান ও দেশের মানুষের ওপর হামলা বলে মন্তব্য করেছিলেন তিনি।
সেই বক্তব্যে বেনজীর বলেছিলেন, ‘এই মঞ্চে দাঁড়িয়ে রি-এশিউর করতে চাই, রাষ্ট্র অবশ্যই তাদেরকে (মূর্তির বিরোধিতাকারীদের) কঠোর হস্তে মোকাবেলা করবে।’
আলেমদের প্রতি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে তিনি বলেছিলেন, আজকে আমরা দেখি অনেকে উল্লম্ফন করেন। মাসল ফ্লেক্সিং করেন। রাষ্ট্রের সঙ্গে মাসল ফ্লেক্সিং? গো ব্যাক এন্ড সিট ব্যাক। এন্ড ট্রাই টু রিয়েলাইজ হোয়াট ইউ আর ডুইং।
মাদ্রাসায় ‘জাকাত দেই, চামড়া দেই’ এবং এর মাধ্যমে কিছু পড়ালেখা করে এখন ফতোয়া দিচ্ছেন বলে আলেমদের প্রতি তাচ্ছিল্যভাবে কথা বলেছিলেন পুলিশের বড় কর্তা বেনজির আহমদ। তিনি বলেছিলেন, ‘কেন তাদেরকে এসব দেই? কারণ তারা ধর্ম প্রচার করবেন। সাধারণ মানুষকে তারা ধর্মকর্মে উৎসাহিত করবেন— এইজন্য।’
মাদ্রাসা ছাত্র ও আলেমদের তাচ্ছিল্যের সুরে জঙ্গি আখ্যায়িত করে বেনজীর বলেছিলেন, ‘কিন্তু, অনেকে দেখি রাজনৈতিক স্পেসে জায়গা নিতে চান। দেশটাকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মৌলবাদী চরিত্র দিতে চান। এই যে এক শ্রেণির আলেম যারা এই কাজটি করছেন কোন উদ্দেশ্যে করছেন? কিছু একটা হলেই ঢাকা শহরে জঙ্গি মিছিল। মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশে তো মিছিল দেখি না! তাহলে কথায় কথায় আমাদের এখানে জঙ্গি মিছিল কেন? দেশটাকে জঙ্গির চরিত্র দিচ্ছেন কেন?’
এখানে উল্লেখ্য, শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনকে টিকিয়ে রাখতে এই বেনজীর আহমেদ এমন কোনো মানবতা বিরোধী কাজ নেই যা করছেন না।
এই বেনজীর আহমেদ যখন র্যাবের প্রধান ছিলেন তখন শেখ হাসিনার নির্দেশে ভিন্নমতকে দমন করতে অনেক নিরীহ মানুষকে গুম ও খুন করেছেন। অথচ সরকারি কর্মকর্তাদের সমাবেশে তিনি বলেন, একজন মুসলমান আরেকজন নিরপরাধ মুসলমানকে কীভাবে খুন করতে পারে?
‘মাইক নিয়া বইসা গেলো। আর পরকালের ব্যবস্থা করার জন্য বছরের পর বছর চললো’ মসজিদের জন্য অনুদান চাওয়া নিয়েও সেদিন কটূক্তি করেছিলেন গোপালগঞ্জের এই পুলিশ কর্মকর্তা।
Discussion about this post