বাংলাদেশের জ্বালানী তেলের মূল্যবৃদ্ধির বেসিক কারণ হলো রিজার্ভ সংকট। আর রিজার্ভ সংকটের কারণ হলো মেগাপ্রজেক্টের নামে মেগাদুর্নীতি। সরকারের আমলা ও ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীরা ছোটখাটো কাজ থেকে শুরু করে বড় কাজ সব স্থানে হরিলুট চালিয়েছে।
যে সড়কের মেরামতে লাগার কথা এক কোটি টাকা সেখানে ব্যয় করেছে ১০ কোটি টাকা। একেকটা বালিশ কিনেছে ৫৫ হাজার টাকায়। ১০ হাজার কোটি টাকার পদ্মাসেতু ৪০ হাজার কোটি টাকায়। এভাবে এমন কোনো সেক্টর নেই যেখানে সরকারি অর্থের হরিলুট হয় নাই। সরকারের কোনো কেনাকাটা বাজারদরের দশগুণের চাইতে কম হয়নি। এসব কারণে জনগণের ওপর বার বার ট্যাক্স আরোপ করেও রিজার্ভ সংকট কাটানো যায়নি।
এছাড়া যেসব কারণে রিজার্ভ বাড়ার কথা সেসব খাতে সরকারের কোনো সঠিক ব্যবস্থাপনা নেই। প্রবাসী কল্যাণে সরকারের কোনো ভূমিকা নেই। নতুন নতুন দেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নেই। তৈরি পোষাক ও চামড়া শিল্পের বিকাশ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ভারতকে সুবিধা দেওয়ার জন্য। ইত্যাদি বহু কারণে রিজার্ভ সংকট তৈরি হয়েছে। বিশ্বব্যাংক, এডিবি, চীন, রাশিয়া ও ভারতের কাছে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ। সেগুলো পরিশোধের কোনো ব্যবস্থা নেই। নেই কোনো পরিকল্পনা।
এমতাবস্তায় অযোগ্য, দুর্নীতিবাজ ও স্বৈরাচারী সরকার IMF-এর কাছে ঋণ চেয়েছে। IMF সাধারণত যে শর্তগুলো দেয় তার একটি হলো জ্বালানী খাতে ভর্তুকি না দেওয়া। IMF তাদের ঋণ ফেরত পাওয়ার সক্ষমতা যাচাই করে। সে অনুযায়ী শর্তারোপ করে এবং ঋণ দেয়। বাংলাদেশ এখনো ঋণ দাতা গোষ্ঠীগুলোর সাথে বৈঠক করেনি। বৈঠকের আগেই হাসিনা সরকার তেলের মূল্য বড় আকারে বাড়িয়ে IMF ও দাতা গোষ্ঠীকে বুঝাতে চায়, শুধু জ্বালানীতে ভর্তুকি বন্ধ নয়, জ্বালানী তেল থেকে লাভ করেও আমরা ঋণ পরিশোধে সক্ষম।
মহাদুর্নীতি ও হরিলুটের ফলে তৈরি হওয়া অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ থেকে প্রায় সাড়ে চারশো কোটি ডলার ঋণ নেয়ার চেষ্টা করছে সরকার। কিন্তু এ সংস্থা থেকে ঋণের প্রধানতম শর্তই হলো জ্বালানি খাত থেকে ভর্তুকি তুলে নেয়া। এখন বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন, সরকার যে ঋণ চেয়েছে সংস্থাটির কাছ থেকে তা নিয়ে আনুষ্ঠানিক বৈঠকের আগেই তেলের দাম বাড়িয়ে তাদের শর্ত পূরণ করে নিলো।
বাংলাদেশে চলতি অর্থবছরের বাজেটে ৮২ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা যে ভর্তুকি বরাদ্দ রাখা হয়েছে তার বড় অংশই জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের জন্য। গত মাসে আইএমএফ’র একটি প্রতিনিধিদল ঢাকায় এসেছিলো এবং সে সময় সরকারকে এ ভর্তুকি কমিয়ে আনার পরামর্শ দিয়েছিলো।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে যত সরকার এসেছে তারা সবাই জ্বালানীতে ভর্তুকি দিয়েছে। কিন্তু ব্যতিক্রম হাসিনা সরকার। ২০১৪ সালে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত হাজার হাজার কোটি টাকা লাভ করেছে। ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত এই মাত্র ছয় মাস তারা কিছুটা সাবসিডি বা ভর্তুকি দিয়েছে বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধির কারণে। ৭ বছরের লাভ তারা লুট করে ফেলেছে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন বা বিপিসি জানিয়েছে ছয়মাসে জ্বালানি তেল বিক্রয়ে ৮০১৪.৫১ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে।
বিশ্ব বাজারে তেলের দাম নজিরবিহীন কমে আসায় ২০১৪-১৫ অর্থ বছর থেকে ২০২০-২১ সাল পর্যন্ত সাত বছরে জ্বালানি তেল বিক্রি করেই সংস্থাটি মুনাফা করেছিলো প্রায় ৪৭ হাজার কোটি টাকা। এটা তাদের হিসাব। কিন্তু এখানে ব্যাপক গড়বড় রয়েছে। এত কম হওয়ার কথা নয়। জ্বালানী প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু বলেছেন ডিজেলের দাম ১১৪ টাকা নির্ধারণের পরও নাকি তাদের সাবসিডি দিতে হচ্ছে। এটা ডাহা মিথ্যা কথা।
সরকারের পক্ষ থেকে জ্বালানী নিয়ে বার বার মিথ্যা তথ্য দেওয়া হয়েছে। গত জুলাই মাসে হাসিনাও মিথ্যা বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়েছে। এমনকি IMF-এর ঋণ নিয়েও মিথ্যা তথ্য দিয়েছে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল। তিনি বলেছেন তাদের নাকি ঋণের দরকার নেই। আবার এখন ঋণের জন্য জ্বালানী তেলের মূল্য বহুগুণে বাড়িয়ে দেওয়া হলো।
গত সপ্তাহের বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ৮৮ ডলার। বাংলাদেশের ডলার রেট ৯৫ টাকা। এই হিসেবে অপরিশোধিত তেলের ক্রয়মূল্য ৫২ টাকা লিটার প্রতি। এটাকে পরিশোধন করতে ২ টাকা যুক্ত হয় লিটার প্রতি। বাকী, এলসি, পরিবহন, ভ্যাট-ট্যাক্স ইত্যাদি মিলে সর্বোচ্চ ৮ টাকা যুক্ত হতে পারে লিটার প্রতি। ডিজেলের মূল্য সর্বোচ্চ হতে পারে ৬২-৬৫ টাকা। ভর্তুকি বন্ধ করলেও ৭০ টাকায় ভোক্তা পর্যায়ে ডিজেল পাওয়ার কথা। এটা বর্তমান রেট। কিন্তু গত ৭ বছরে ব্যারেল প্রতি দাম ছিল মাত্র ২২-২৭ ডলার এবং ডলার রেট ছিল ৮৫ টাকা প্রায়। তাহলে অনুমান করুন জ্বালানী তেলে কী পরিমাণ হরিলুট করেছে সরকার।
সরকার তেলের দাম বাড়িয়েছে দুইটা বিষয়কে টার্গেট করে। প্রথমত IMF থেকে ঋণ বাগিয়ে নেওয়া, দ্বিতীয়ত জ্বালানী তেল থেকে মুনাফা করে তাদের লুট জনিত ঘাটতি কিছুটা ব্যাকআপ দেওয়া। সরকারের লুটের দায় জনগণকে পরিশোধ করতে হচ্ছে।
Discussion about this post